গত মঙ্গলবার, হুস্টনে যখন বাঙলাভাষা নিয়ে উৎসব চলেছে, চলেছে আলোচনা, খাওয়াদাওয়া কবিতাপাঠের জমজমাট আসর, ঠিক সেইসময় আমেরিকার মেরিল্যান্ডে হাজারো মানুষ অন্য একটা উৎসব করছিল। সেটা হল মানুষের এক বিরাট জয়লাভের উৎসব। কেমন ব্যাপার সেটা? বলি শোন তবে।
সেদিন মানুষ প্লুটোর কাছে গিয়ে পৌঁছোল।
১৯৩০ সালে যখন প্লুটো আবিষ্কার হয় তখন একটা প্রতিযোগিতা ডাকা হয়েছিল তার নামকরণের জন্যে। ১১ বছুরে মেয়ে ভেনেশিয়া বার্নি তার নাম রাখে প্লুটো, কেন না, তাকে তখন দুরবিণে দেখিয়েছিল, অনেক দূরের এক অন্ধকার গোলকের মতই—ঠিক যেন পাতালপুরীর রাজা প্লুটো।
মজার কথা হল, ১৪ জুলাই তারিখে যখন মানুষের তৈরি এখন অবধি সবচেয়ে দ্রুতগামী মহাকাশযান ‘নবদিগন্ত’ (নিউ হরাইজন) প্লুটোর কাছে গিয়ে পৌঁছুল, তখন সে দেখল, তার গায়ে সত্যিসত্যিই যেন আঁকা রয়েছে অন্য এক প্লুটোর ছবি—ওয়াল্ট ডিজনির তৈরি মজারু কুকুর প্লুটো যেন উঁকি মারছে এই বামন গ্রহের বুক থেকে। এই যে সঙ্গের ভিডিওটাতে দেখে নাও সত্যি কি না?
প্লুটোর বুকে প্লুটো
ন বছর ধরে একটানা ঘন্টায় তিরিশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার মাইল বেগে (সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৫২০০০ মাইলের একটু বেশি, যা কিনা মানুষের তৈরি যেকোন মহাকাশযানের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড) ছুটে, তিনশো কোটিরও বেশি মাইল রাস্তা পেরিয়ে যখন ‘নাসা’র ‘নবদিগন্ত’ (নিউ হরাইজন) নামের আকাশগাড়ি প্লুটোর সবচেয়ে কাছে, মাত্রই ৭৭৫০ মাইল কাছে গিয়ে পৌঁছোল, তখন সে দেখে, কোথায় সেই পাতালরাজা প্লুটোর মতন গম্ভীর, কালো, বরফে ঢাকা জায়গা! সে আসলে ১৪৭৩ মাইল ব্যাসের একটা হাসিখুশি গ্রহ। গায়ের রঙ অনেকটা মঙ্গলগ্রহের মতন লালচে। আর, সবচেয়ে মজার কথা হল, তার গায়ে আঁকা রয়েছে ভালোবাসার প্রতীকের মত একটা বিরাট হার্ট চিহ্ন।
সেই ছবি দেখে সব্বাই মাথা নেড়ে খুশি হয়ে বলল, প্লুটো আমাদের ভালোবাসার চিঠি পাঠিয়েছে।
ওহো, আরো একটা মজার খবর বলি। নবদিগন্তে চড়ে একজন মানুষ প্লুটোয় গিয়েছেন। না না, জীবন্ত কেউ নন। আমেরিকান বিজ্ঞানী ক্লাইড টমবাউ ছিলেন প্লুটোর আবিষ্কর্তা। ১৯৯৭ সালে তিনি মারা যান। মারা যাবার আগে তাঁর শেষ ইচ্ছেটা ছিল, তাঁর দেহভস্মটুকু যেন মহাকাশে বিসর্জন দেয়া হয়। তার ঠিক ন’বছর পরে, যখন প্লুটোর উদ্দেশ্যে ন বছরের যাত্রায় রওনা হল নিউ হরাইজন, তখন একটা ছোট্টো পাত্রে করে টমবাউয়ের দেহভস্ম রেখে দেয়া হল যানের ভেতরে। তার গায়ে লেখা, “এইখানে সমাধিস্থ আছেন সৌরজগতের তৃতীয় অঞ্চল এবং প্লুটোর আবিষ্কর্তা আমেরিকান ক্লাইড ডাবলু টমবাউ।”
বলো দেখি এই তৃতীয় অঞ্চল ব্যাপারখানা কী? শোন বলি, সৌরজগতের তিনটে এলাকা। সূর্য থেকে গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় অবধি হল গিয়ে তার ভেতরবাড়ি বা ইনার জোন। এখানে থাকে বুধ থেকে মঙ্গল অবধি পাথুরে গ্রহের দল। তারপর রয়েছে মাঝবাড়ি। এখানের বাসিন্দা হচ্ছেন বৃহস্পতি , শনি ইউরেনাস আর নেপচুন এই চার গ্যাসদানব আর তাঁদের অসংখ্য সভাসদ উপগ্রহের দল। আর ওর বাইরে থাকে বহুদূর অবধি ছড়ানো কুইপার বেল্ট আর তাকে ঘিরে ধুলো আর বরফকুঁচির এক অতিকায় মেঘ। তার নাম উর্ট মেঘমালা। এই তৃতীয় এলাকা হল গিয়ে ধুমকেতুদের দেশ। তারা ছাড়াও ছোটোবড়ো বেশ কিছু বামন গ্রহও ঘুরে বেড়ায় এখানে কুইপার বেল্ট এলাকাতে। প্লুটো হল তাদের রাজা। তাদের মধ্যে আকারে সবচাইতে বড়ো সে।
প্লুটোতে হালকা আবহাওয়ার খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাতে রয়েছে মিথেন, নাইট্রোজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইড। অনুমান হচ্ছে, তার জমাটবাঁধা ভূপৃষ্ঠের ভেতরে লুকিয়ে আছে তরল জল। হয়ত কখনো তার বুকে আগ্নেয়গিরিরা আগুনও ওগরাতো। এইবারে সে খবরও ঠিকঠাক পাওয়া যাবে বলে সবার আশা।
১৯৬৫ সালের ১৪ই জুলাই মেরিনার ৪ নামের মহাকাশযানটা মঙ্গলগ্রহের পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে মানুষের সৌরজগত অভিযানের সূচনা করেছিল। তার ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে ১৪ জুলাই ২০১৫ তারিখে প্লুটোর কাছে পৌঁছে গিয়ে শেষ হল প্রত্যেকটা গ্রহকে ছুঁয়ে ফেলবার অভিযান।
নীচের ভিডিও লিংকটাতে বিলিতি খবরের কাগজ দ্য টেলিগ্রাফের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া একটা ভিডিওতে ষাট সেকেন্ডে নবদিগন্তের সম্পূর্ণ অভিযানটাকে ধরা রয়েছে।
এইবার শুরু হয়ে গেল মহাকাশে ঘুরে বেড়াবার এক নতুন অধ্যায়। প্লুটোর ধারে পৌঁছে গিয়ে মানুষ শুরু করে দিল সৌরজগতের তৃতীয় অঞ্চলে তার অনুসন্ধানের কাজ। নবদিগন্ত নিজেও এরপর কুইপার বেল্ট পেরিয়ে, উর্ট মেঘমণ্ডলের মাঝখান দিয়ে উড়ে যাবে অনেক-অনেক দূরে, কিন্তু সেইসব অঞ্চলে অভিযান সে চালাবে না। চলে যাবে সে তার ফেরবার কোন উপায় নেই বলেই। কিন্তু এইবারে মানুষ তৈরি করবে নতুন নতুন , আরো শক্তিশালী আকাশগাড়ি। তাইতে করে যন্ত্রমাথারা পাড়ি দেবে কুইপার বেল্ট আর উর্ট মেঘমালার ভেতরে। খুঁজে ফিরবে নতুন নতুন বিস্ময়। সেই জ্ঞানের ডানায় ভর করে আমরা এগিয়ে চলব—অনেক অনে-ক বড়ো একটা সভ্যতা তৈরির রাস্তায়।
Darun
LikeLike
ভিডিও লিংকটি খুজেঁ পাচ্ছি না, এট্টু হেল্প কর্বেন?
LikeLike
অজস্র ধন্যবাদ পলাশ। যে অজস্র মানুষজন এ পোস্টটা গত দুদিনে পড়েছেন বলে বলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত একজন পাঠক যে সিরিয়াস এবং কৌতুহলী, সেইটে জানতে পেয়ে ধন্য হলাম। লিংক ঠিক করে দেয়া হয়েছে।
LikeLike