একশো জানলার রাজ্যের আলোকিত
মহামহিম রাজাধিরাজ বেচারা বাহাদুরের সভার কাণ্ডকারখানা যত
আলিস ভিয়েইরা
রিভিউ করলেন তাপস মৌলিক
বাপ রে! কী বিরাট নাম বইয়ের! নামেই এগারোটা শব্দ! বাংলা বইয়ের এতবড় নাম আমি অন্তত দেখিনি এর আগে। মূল বইটা অবশ্য বাংলা নয়, পর্তুগিজ ভাষায় লেখা। সে ভাষায় বইটার নাম হল ‘গ্রাসাশ্ ই দিশগ্রাসাশ্ দা কর্ত দ্য এল-রেই তাদিন্যিউ মনার্কা ইলুমিনাদু দু রেইনু দাশ্ সেঁই জানেলাশ্’। পনেরোটা শব্দ। মূল পর্তুগিজ থেকে বাংলায় অনুবাদ করার সময় অনুবাদক ঋতা রায় সেটা এগারোটা শব্দে নামিয়ে এনেছেন! পর্তুগিজ ভাষা আমি মোটেই জানি না, আর তোমরা জানো না বলে সুযোগ বুঝে গুলও মারছি না, মূল পর্তুগিজ নামটা বাংলা বইটাতেই লেখা আছে। বললাম একটা কারণে; শেষের ওই পর্তুগিজ শব্দটা – ‘জানেলাশ্’ – বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। তার মানে আমরা যাকে জানালা বলি পর্তুগিজরা তাকে ‘জানেলা’ বলে! যাক, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সঙ্গে যদি কোনওদিন দেখা হয়ে যায়, তাহলে একটা শব্দ অন্তত বলতে পারব!
বড়ো বড়ো লম্বাচওড়া নামের প্রতি ছোটো থেকেই আমার একটা আকর্ষণ আছে। আমি যে স্কুলে পড়তাম তার নাম ছিল ‘কালনা অম্বিকা মহিষমর্দিনী বহুমুখী সর্বার্থসাধক উচ্চ ও উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। মনে হয় আকর্ষণের মূলে সেই স্কুলের নাম। পি টি ঊষার পুরো নাম যে পিলাভুল্লাকান্দি থেক্কেপরমবিল ঊষা, কিম্বা এ বি এ গণী খান চৌধুরী যে আবু বারকাত আতাউর গণী খান চৌধুরী সেটা ছোটবেলায় মুখস্থ ছিল। তাই বইমেলায় এ বইটার নাম দেখেই খপাৎ করে কিনে ফেললাম, আর তারপর চটপট পড়েও ফেললাম। ও বাবা! পড়ে দেখি, শুধু নাম কেন, এ বইয়ের পাতায় পাতায় প্রতিটা লাইনে ছড়িয়ে আছে দুর্ধর্ষ দারুণ সব মজা! একবার ধরলে ছাড়ে কার সাধ্যি!
তবে বইটার কথায় যাওয়ার আগে লেখিকার কথা একটু বলে নি। আলিস ভিয়েইরার জন্ম ১৯৪৩ সালে পর্তুগালের লিসবনে। বেশ কিছু বছর সাংবাদিকতা করার পর ১৯৭৯ সালে মেয়ে কাতারিনার জন্য নতুন-নতুন গল্প তৈরি করার তাগিদে শুরু করলেন ছোটোদের জন্য লেখালেখি। সে বছরই বই হয়ে বেরোল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘রজা, মিন্যিয়া ইরমাঁ রজা’ বা ‘রজা, আমার বোন রজা’, আর সে বই ১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যের পুরস্কার পেল। তারপর গড়গড়িয়ে চলল লেখালিখি। এখন অবধি তিনি আট ডজনের ওপর বই লিখে ফেলেছেন। এ বইটা আলিসের ছ’নম্বর বই, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে।
বইয়ের ভূমিকায় অনুবাদক বলছেন, ‘গল্পটা কবে কোথায় ঠিক ঘটেছে বা ঘটছে, জানার উপায় নেই। একদিকে রূপকথার গল্প মনে পড়ে, অন্য দিকে বর্তমানের নানান ছাপও গল্পে পরিষ্কার। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রূপকথা। বইটিকে শুধু ছোটদের বলে মনে করলে ভুল করা হবে।’
একশো জানলার রাজ্যটা যে ঠিক কোথায় কেউ জানে না। আমাদের অ্যাটলাসে যেমন সে রাজ্যের কথা নেই, ওদের ম্যাপেও তেমনি আমাদের দেশ দেখানো নেই, শুধু ওদের নিজেদের রাজ্যটাই আছে। সে রাজ্যের রাজা, মহারাজ বেচারা বাহাদুর হলেন এক আলোকিত রাজা, অর্থাৎ কিনা তাঁর মাথায় মাঝে মাঝেই ১২০ কিম্বা তারও বেশি ভোল্টের বুদ্ধি খেলে যায়। সে রাজ্যের সব মন্ত্রী সারাক্ষণ নতুন নতুন ডিক্রি সই করার জন্য ব্যাকুল, কেননা প্রতিটা ডিক্রি সই করলে তারা মাইনের ওপর ২.৮% বেশি পায়। সব রাজ্যেই যেমন থাকে, তেমন একশো জানলার রাজ্যেও ছিল এক ড্রাগন, আর এক ডাইনি। ডিক্রি সই করতে করতে করতে করতে যখন আর কোনও নতুন ডিক্রির আইডিয়া মাথায় আসছে না, তখন মহামন্ত্রী করলেন কী – ভেবে ভেবে ছোটবেলায় পড়া গল্প থেকে আইডিয়া নিয়ে এক ডিক্রি জারি করলেন – ঐ ড্রাগনকে যে মারতে পারবে তার সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দেওয়া হবে। খবর পেয়ে ড্রাগন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পাঁচটা মাথার নাক-চোখ-মুখ দিয়ে আগুন ঝরাতে ঝরাতে চড়াও হল রাজসভায়। কী? তার সাপ্লাই করা বিদ্যুতেই এই রাজ্য চলে, তার জন্যই এই রাজ্য খেয়ে-পরে বেঁচে আছে, আর তাকেই কিনা বধ করার প্ল্যান? এক্ষুনি এর একটা হেস্তনেস্ত চাই। এদিকে রাজা তো ডিক্রির ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানেন না, তিনি পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। ড্রাগনের রোষ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য শেষমেশ মরিয়া হয়ে প্রস্তাব দিলেন, ড্রাগনের সঙ্গেই রাজকন্যার বিয়ে দেওয়া হবে। হঠাৎ তাঁর মাথায় এক ২০০ ভোল্টের আলোকিত বুদ্ধি খেলে গেল কিনা! অবশেষে ড্রাগন শান্ত হল, প্রস্তাব স্বীকার করল, বলল ঠিক এক সপ্তাহ পরে এসে রাজকন্যেকে নিয়ে যাবে। তারপর ভালোয় ভালোয় বিদেয় নিল সে। তখন কিনা রাজার মনে পড়ল – আরে! তাঁর তো এখনও বিয়েই হয়নি, আর কোনও ছেলেমেয়েও নেই! এইবারে জমে উঠল গল্প, আসরে নামল ডাইনি, শুরু হল নানা শলাপরামর্শ… সবটা বলে দিলে কি ভালো হবে? বইটা জোগাড় করে বাকিটা নয় পড়ে নিও তোমরা।
আমাদের সুকুমার রায় চলে গেছেন প্রায় একশো বছর হতে চলল। তারপর ‘ননসেন্স’ অর্থাৎ উদ্ভট রসের বেদম হাসির গপ্পো লেখকরা কেউ আর তেমন লিখলেন কই? তাই বিদেশি বইয়ের অনুবাদই ভরসা। তবে ‘হ য ব র ল’ পড়তে পড়তে যেমন বারবার হাসতে হাসতে পেট ফেটে যায়, তাড়াতাড়ি গুণসুতো দিয়ে পেট সেলাই করে নিয়ে ফের পড়তে হয়, এ বইটার হাসি সেরকম নয়। এ হাসি সারাক্ষণ পেটের মধ্যে গজগজ করে, ফসফস করে, সোডার বোতলের মতো ভসভসিয়ে ওঠে; আর তার রেশ চলতে থাকে, চলতেই থাকে – বহুক্ষণ, যতক্ষণ না ফের একটা রদ্দি গোয়েন্দা গল্প পড়ার দুর্ভাগ্য হবে।
বইটার মলাটটা ভালোই হয়েছে, ছাপাও ঝকঝকে, অনুবাদও দিব্যি ঝরঝরে মজাদার, তবে কিনা ভেতরে কোনও ছবিছাপা নেই। ছোটদের বইয়ে কোনও ছবি থাকবে না? তাও আবার এরকম একটা অসাধারণ উপভোগ্য বইয়ে? ছবি-টবি না থাকলে ছোটরা পড়বে? এ বইয়ের গল্পে রাজকন্যা নয় সত্যিসত্যিই কম পড়িয়াছিল, তাই বলিয়া বঙ্গদেশে চিত্রশিল্পীও কি কম পড়িয়াছে?
তাপস মৌলিক
বইপড়া-র সব পাতা একত্রে