জয়ঢাকে প্রকাশিত দিলীপ রায়চৌধুরীর বিভিন্ন লেখার লিংক–>
নেরগাল প্লুটোর অভিশাপ শিলাকান্থ ধূসর চাঁদ অগ্নির দেবতা হেফেসটাস চলো যাই যাদুঘরে
বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের দুনিয়ায় দিলীপ রায়চৌধুরী একটি উজ্জ্বল নাম। গত শতকের ছয়ের দশকে ক্ষণপ্রভ ধূমকেতুর মতো লেখক হিসেবে তাঁর আবির্ভাব এবং মাত্র কয়েক বছর পরেই অত্যন্ত দুঃখজনক অকালপ্রয়াণ। আলোচ্য সংকলনে গ্রন্থিত হয়েছে তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সমস্ত রচনা। লেখাগুলির বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়েছিল সেই সময়ের ‘আশ্চর্য!’, ‘তরুণ তীর্থ’, ‘প্রথম প্রয়াস’ ইত্যাদি পত্রিকায়। পত্রিকাগুলি এখন আর প্রকাশিত হয় না, তাদের পুরোনো সংখ্যাগুলি সংগ্রহ করে পড়াও সাধারণ পাঠকের পক্ষে সম্ভব নয়। আন্তর্জালে দিলীপ রায়চৌধুরীর কিছু কিছু গল্প পড়ার সুযোগ পাঠকের হয়েছে, তাতে এরকম একটি রচনাসমগ্রের জন্য প্রত্যাশা এবং সাগ্রহ প্রতীক্ষা বেড়েছে। অবশেষে এ বছরের কলকাতা বইমেলায় হযবরল প্রকাশন থেকে সেই বহুপ্রতীক্ষিত বইটি পাওয়া গেল। এ জন্য পাঠকের তরফ থেকে, বিশেষ করে বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের অনুরাগী পাঠকদের পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ প্রকাশকের পাওনা।
ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯২৮ সালে কলকাতায়, শৈশব কেটেছে বহরমপুরে দাদু-দিদিমার কাছে, সেখানেই স্কুল শেষ করে কলেজে রসায়ন নিয়ে বি এস সি পাস করেন তিনি, তারপর কলকাতায় বিজ্ঞান কলেজে স্নাতকোত্তর। কিছুদিন খড়গপুর আই আই টি-তে গবেষণা করার পর ১৯৫৩ সালে দিলীপ উচ্চতর গবেষণার জন্য পাড়ি দেন আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ সালে দেশে ফিরে কেমিস্ট হিসেবে যোগ দেন বহুজাতিক সংস্থা আই সি আই-তে, যাদের কারখানা ছিল রিষড়ায়। এই সময়েই শুরু হয় তাঁর লেখালেখি এবং সমাজসেবামূলক কাজকর্ম, গড়ে তোলেন নিজের সংস্থা ‘তরুণ তীর্থ’, লিখতে শুরু করেন অদ্রীশ বর্ধন সম্পাদিত কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’ এবং নিজের সংস্থার ‘তরুণ তীর্থ’ পত্রিকায়। একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কল্পবিজ্ঞানের গল্প এবং বিজ্ঞানবিষয়ক ও অন্যান্য রচনাগুলি। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প, আর ১৯৬৬-র সেপ্টেম্বরে এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র দু’দিনের মধ্যে আকস্মিকভাবে মৃত্যু হয় তাঁর। তখন তাঁর বয়স সবে সাঁইত্রিশ। বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের জগৎ হারায় সৃষ্টিশীলতার শিখরে থাকা এক প্রতিভাবান সাহিত্যিককে।
আলোচ্য বইটিতে সিদ্ধার্থ মজুমদারের ভূমিকার পর রয়েছে দিলীপ রায়চৌধুরীর জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে লেখা তাঁর কন্যা যশোধরা রায়চৌধুরীর মূল্যবান একটি রচনা। তার থেকে দিলীপের জীবন সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত জানতে পারি আমরা। সংক্ষিপ্ত সাহিত্যজীবনে দিলীপ কল্পবিজ্ঞানকে আধার করে লিখেছিলেন একটি উপন্যাস এবং আটটি ছোটোগল্প। এগুলি ছাড়া এ বইয়ে রয়েছে ছোটোদের জন্য লেখা বিজ্ঞানবিষয়ক তিনটি রচনা, দুটি ছোটো ভ্রমণ আলেখ্য, একটি ছোটো নাটিকা এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখা একটি বড়ো গল্প।
বইটি সম্পর্কে সিদ্ধার্থ মজুমদার বলেছেন – ‘আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে লেখা এই গল্পগুলি, যা এখানে গ্রন্থিত হয়েছে, পড়ে চমকে উঠতে হয়। কী সাবলীল এই ভাষা, কী প্রাঞ্জল এই গল্পবলা আর বর্ণনা। একই সঙ্গে গভীর আর রসোত্তীর্ণ, সতথ্য আর চিত্তাকর্ষক। বাংলা ভাষায় এমন গল্প, যেখানে পরতে পরতে রয়েছে বিজ্ঞানের কথা, তা যে কত সহজ, স্বচ্ছন্দ আর সরস ভঙ্গিতে বলা যায়, তারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলি। আধুনিক বিজ্ঞানের নানান বিষয়ের দুরূহ কথা সহজ করে বলবার ম্যাজিক জানেন যেন লেখক, তাই প্রতিটি গল্পের প্রথম থেকে শেষ অবধি আবিষ্ট করে রাখে পাঠককে। রসায়ন বিজ্ঞান থেকে পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে ভূবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান থেকে জীববিজ্ঞান – এইভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের নানান বিষয় নিয়ে এই বইয়ের একেকটি গল্প। সাহিত্যের নান্দনিকতা ও লালিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের তত্ত্ব, রোমান্স আর উপলব্ধির এক অনবদ্য মিশেল প্রতিটি লেখাকে করে তুলেছে স্বতন্ত্র ও স্বমহিম।’
‘…কাহিনির মাধ্যমে বিজ্ঞানের কোনও ধারণা, তথ্য বা তত্ত্বের কথা উপস্থাপিত করে পাঠকের ভাবনার আঁচকে উসকে দিয়ে উৎসাহিত করে তোলার কাজটি করেন কল্পবিজ্ঞান লেখক। আর এই উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে কল্পনার যে আয়োজন থাকে, তা অবশ্যই বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হয়। রং চড়ানো, কল্পনার ফানুস ওড়ানো কোনও অবাস্তব গল্পকে আর যাই হোক, কল্পবিজ্ঞান বলা যায় না।… (দিলীপ রায়চৌধুরীর) প্রত্যেকটি লেখা বিষয়বস্তু কিংবা মেজাজে ভিন্ন হলেও, যে একটি বিষয়ে মিল, তা হল বিজ্ঞানের তথ্য বা ভাবনার অবিকৃত থাকা। লেখার রোমাঞ্চকর বস্তুর প্রয়োজনে বিজ্ঞানবিরোধী কোনও জিনিস অন্তর্ভুক্ত হয়নি কোনও গল্পে। এভাবেই ডক্টর রায়চৌধুরীর প্রত্যেকটি লেখা সার্থক কল্পবিজ্ঞান কাহিনি হয়ে উঠেছে। আসলে কোনও লেখাকে রোমাঞ্চিত করার প্রয়োজনে যে বিজ্ঞানবিরোধী কোনও ভাবনা আনার প্রয়োজন পড়ে না, তা একজন কৃতবিদ্য রসায়নবিদ হিসেবে ডক্টর রায়চৌধুরী সম্যক জানতেন। বিজ্ঞান যে নিজেই অত্যন্ত রোমাঞ্চকর আর রোমহর্ষক, তাই লেখার মধ্যে আলাদা করে এসব আরোপ করার প্রয়োজন পড়ে না, সে কথা দিলীপের মতন একজন আদ্যোপান্ত বিজ্ঞানী খুব ভালো করেই বুঝতেন।’
বইটি পড়ার পর সিদ্ধার্থবাবুর বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত, তাই হুবহু তুলে দিলাম এখানে। কল্পবিজ্ঞানের গল্প যাদের ভালো লাগে তাদের কাছে এ বই এক ঝলক টাটকা হাওয়ার মতো, প্রতিটি গল্প পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও একেবারে সতেজ-সজীব, শুরু করলে শেষ না করে উপায় নেই। গল্প-উপন্যাসগুলির মধ্যে আমার নিজের সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘ক্যুগেল ব্লিৎস’ নামে গল্পটি, এ ছাড়াও দুর্দান্ত লেগেছে উপন্যাস ‘অগ্নির দেবতা হেফেস্টাস’, গল্প ‘শিলাকান্থ’, ‘নেরগাল’ এবং বাংলার এক ছোটো শহরে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা বড়ো গল্প ‘চিত্ত ভাবনাহীন’। সব গল্পই ভালো – কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি! তবে ‘সৌর-ঝঞ্ঝা’ গল্পটি কেমন অসম্পূর্ণ মনে হল; গল্পটি লেখকের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত, হয়তো তিনি ঠিকঠাক শেষ করে যেতে পারেননি।
বইটির প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ খুবই ভালো, ছাপা ঝকঝকে। তবে বইয়ের পেছনে অর্থাৎ ব্যাক কভারে সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি, লেখকের একটি ছবি এবং বইটি সম্পর্কে দু’চার কথা থাকলে বেশ হত। শিল্পী সুমিত রায়ের আঁকা অসাধারণ অলঙ্করণের কথা আলাদা করে বলতে হয়, এ রকম দুর্দান্ত ছবি সঙ্গে থাকলে গল্পের আকর্ষণ বহুগুণ বেড়ে যায়।
দিলীপ রায়চৌধুরী নামটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর লেখা বিখ্যাত ‘সবুজ মানুষ’ গল্পটির সূত্রে। আকাশবাণীর ‘সাহিত্য বাসর’ অনুষ্ঠানের জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, দিলীপ রায়চৌধুরী এবং সত্যজিৎ রায় -চারজন দিকপাল কল্পবিজ্ঞান লিখিয়ে মিলে লিখেছিলেন ‘সবুজ মানুষ’ – একই নামের চারটি আলাদা গল্প। ১৯৬৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আকাশবাণীতে ‘সবুজ মানুষ’ প্রথম সম্প্রচারিত হয়, চার লেখক নিজকন্ঠে নিজের নিজের গল্প পড়েন। পরে আরও অনেকবার অনুষ্ঠানটি পুনঃপ্রচারিত হয়েছে, আমরা ছোটোবেলায় রেডিওয় শুনেছি। এই সমগ্রে দিলীপ রায়চৌধুরীর সেই ‘সবুজ মানুষ’ গল্পটি আশা করেছিলাম, যেমন সত্যজিৎ রায়ের গল্পটি সংকলিত আছে ‘পিকুর ডায়রি ও অন্যান্য’ বইতে। না পেয়ে খুব আপশোশ হয়েছে।
এ ছাড়া বইটির অনেক লেখায় ছোটোখাটো কিছু ছাপার ভুল চোখে পড়েছে, গল্পের টানে মন সে সব অগ্রাহ্য করতে চায়, তবু খুঁতখুঁত করে। কল্পবিজ্ঞানের গল্প-উপন্যাসগুলি ছাড়া সংকলিত অন্যান্য লেখায় লেখকের মূল রচনার বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, তার কারণও আমার মাথায় ঢোকেনি! পুরো বইটাই এখনকার বানানরীতি অনুযায়ী সম্পাদনা করলে চোখের হোঁচট খাওয়া কমত বলে মনে হয়। আশা রাখি দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশক ওপরের ব্যাপারগুলির দিকে নজর দেবেন যাতে বইটি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে ওঠে।
জয়ঢাকের বইপড়া লাইব্রেরি