পরপর সব পর্ব বইবাতিক-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭(শেষ পর্ব)
৭
ধারাপাতে এক থেকে একশ গোনাকে বলে শতকিয়া, চলতি কথায় শটকে। ছোটবেলায় তোমাদের সবাইকেই এটা শিখতে হয়েছে– তা সে এক-দুই-তিন-চার গুনেই হোক, বা ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর। দু’ একজন ফাঁকিবাজ ছাত্র সব জায়গাতেই থাকে, যারা একশ পর্যন্ত ঠিকঠাক মুখস্ত করতে পারে না বা করতে চায় না। গবেশ্বর পণ্ডিতের পাঠশালাতেও সেই রকম দুই ছাত্র ছিল নরু (নরেন) আর বরু (বরেন), যে দুই ভাইকে পণ্ডিতমশাই ‘গরু’ বলেই ডাকতেন, কারণ এক বছরের চেষ্টাতেও পণ্ডিত তাদের শতকিয়া মুখস্ত করাতে পারেননি। একদিন দুই ভাই তালপুকুরে সাঁতার কাটছে, এমন সময় গবেশ্বর পণ্ডিতও নাইতে এলেন। ওদের দেখে ভাবলেন একটু অন্যভাবে যদি গরুদুটোকে শতকিয়া শেখানো যায়! জিজ্ঞাসা করলেন, নরু বলতো পুকুরের দক্ষিণপাড়ে ক’টা তাল গাছ আছে? নরু গুণে বললো– চারটে। পণ্ডিত আবার বললেন, এর সঙ্গে পূবপাড়ের একটা যোগ করলে ক’টা হয়? নরু বললো, পাঁচটা। পণ্ডিত খুব খুশি, বললেন তার সঙ্গে উত্তরপাড়ের দুটো যোগ করলে? নরু গুণতে শুরু করার আগেই বরু বলে উঠল, বলিস না রে দাদা, এই করে পণ্ডিতমশাই শটকে শেখাচ্ছে।
শটকে না শিখলেও এতদিনে তোমরাও নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছ যে নানা গালগল্পের ছলে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের কিছু নিয়ম কানুন জানতে চাইছি আমরা। অবশ্য কথাটা গোপনও করা হয়নি। কারণ বিজ্ঞান মানেই তো রীতিবদ্ধ শাস্ত্র। আর এই নিয়মগুলো যে শুধুমাত্র বইএর রাজত্বে খাটে, তা নয়। আমাদের জীবনের প্রতিদিনের কাজগুলোকেও এরা বারবার ছুঁয়ে যায়। জীবনে ভালভাবে বাঁচার জন্যও এসব জানা দরকার। একথায় তোমাদের সন্দেহ হতেই পারে। রঙ্গনাথনের মতন বড় লাইব্রেরিয়ান বলে গেছেন, তাই বইয়ের রাজত্বে না হয় পাঁচটা ‘গোল্ডেন রুল’ নিয়ে আমরা মাতামাতি করলাম। কিন্তু আমাদের নিজেদের জীবনে অনেক নিয়মকানুনের মাঝে এ আবার নতুন কী ফ্যাচাং! তাহলে আমাদের জীবনটাই আরও একটু কাছ থেকে দেখা যাক। ধর, তোমার বাবার একটা কাপড়ের দোকান আছে– যাকে সাইনবোর্ডের ভাষায় ‘বস্ত্রালয়’ বলা হয়। তোমাদের খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে জামাকাপড়, পড়াশোনা, আমোদ-আহ্লাদ, এমনকি পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যাবার খরচও আসে এই দোকানের আয় থেকে। দেখা যাক এই
গোল্ডেন রুলগুলো তাঁকে কীভাবে সাহায্য করতে পারে। ক্রেতা মানে খরিদ্দার বা খদ্দের, যাঁরা দোকানে জিনিস কিনতে আসেন। সেখানে মালপত্র (এক্ষেত্রে কাপড়চোপড়) রাখা হয় তাঁদের জন্যেই। প্রথম নিয়মটাকে একটু বদলে আমরা যদি বলি দোকানের সব কাপড়চোপড়ই বিক্রির জন্য–ভুল হবে কি? যে জিনিস বিক্রি করা যাবে না, সে জিনিস দোকানে রেখে লাভ কি? দোকান ব্যাবসার জন্য। সেটা তো কোনও আর্ট গ্যালারির এক্সিবিশন নয়, যে ইচ্ছামত যে কোনও ছবির নীচে ‘NOT FOR SALE’ লিখে দিলাম, আর খদ্দেরদের বললাম, ‘মশায়, এই কাপড়টা বেচার জন্যে নয়, শুধু দেখাতে এনেছি।’ তাতে ব্যাবসা হবে? অর্থাৎ কাপড়ের দোকান মালিকের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হবে সব ধরণের কাপড়, যা তিনি মজুত করেছেন, সেগুলো যেন বিক্রি করা যায়।
দ্বিতীয় নিয়মটা এইভাবে বলা যাক– প্রত্যেক খদ্দেরই তাঁর পছন্দমতো কাপড় তোমাদের দোকানে পাবেন। অবশ্য এক্ষেত্রে খদ্দেরদেরও জানতে হবে, কোন জিনিস কোন দোকানে পাওয়া সম্ভব। তেলের দোকানে বেল চাইলে কি কোনদিন পাওয়া যাবে? সেদিন আমাদের এক বন্ধু বল্টু এসে বলল : ‘তোরা তো সব বাড়িতে মলত্যাগ করিস আর বাইরে mall-এ mall-এ ঘুরিস। জানিস, সেদিন একটা খুব দরকারি জিনিস সিটি সেন্টার ওয়ান, সেটি সেন্টার টু, এমনকি সাউথ সিটি মলেও পেলাম না। অথচ শেয়ালদা বাজারে ছোট্ট একটা দোকানে পাওয়া গেল।’
আমরা তো অবাক, ‘কী এমন জিনিস রে যে তুই এত বড় বড় মলেও পেলি না?’ বল্টু বলল, ‘বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো ছিল। মা ঘটের জন্য একটা দেড়হাতি গামছা আনতে বলেছিল।’ এভাবে খুঁজলে দেড় হাতি গামছাসাউথ সিটি মলে পাওয়া যায় না ঠিকই, কিন্তু যাঁরা সচেতন খদ্দের তাঁদের তো এরকম ভুল হয় না। তাঁরা যেসব কাপড়ের দোকানে যাবেন, সেখানে যেমন দু-তিন হাজার টাকা দামের কাপড় থাকবে, তেমনি দু-তিন শো টাকা দামের কাপড়ও থাকবে। আবার যেমন পশ্চিমবঙ্গের বালুচরি থাকবে, তেমনি তামিলনাড়ুর কাঞ্জিভরম বা বাংলা দেশের ঢাকাইও থাকবে। অর্থাৎ সব ক্রেতাই তাঁর পছন্দমতো জিনিস পাবেন।
দ্বিতীয় নিয়মের সূত্র ধরেই আমরা তৃতীয় নিয়মে যেতে পারি। সেটা হল– দোকানের প্রত্যেক জিনিসই তার খদ্দের পাবে। অর্থাৎ দোকানে অবিক্রিত জিনিস পড়ে থাকবে না। সেটা কীভাবে সম্ভব? এর জন্য প্রথমেই তোমাকে জানতে হবে– যেখানে দোকান করা হয়েছে, সেখানকার খদ্দেরদের আঞ্চলিক অবস্থানটা কী? অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন? রুচি কীরকম? আর এই সবগুলোকে মাথায় রেখে মাল মজুত করলে কোনও কিছুই অবিক্রিত পড়ে থাকার কারণ নেই।
চতুর্থ সূত্রটাকে বোধহয় বিশেষ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। সময়ের গুরুত্ব সকলেরই কাছেই সমান– তারা লাইব্রেরির পাঠকই হোন, বা ডাক্তারের রোগী বা উকিলের মক্কেল কিংবা দোকানের খদ্দের। তাদের সময় যতই বাঁচবে, ততই তারা তোমার দোকানের প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে। এখানে আর একটি ব্যাপারও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করার ব্যাপারে তোমার মনোভাব ও আচরণ। তোমরা নিশ্চয়ই এমন দোকান দেখেছ, যেখানে ঢুকলে মালিক বা কর্মচারীর হাসিমুখ দেখতে পাওয়া তো দূরের কথা, তোমার কিনতে আসা জিনিসগুলো দেখাবার ব্যাপারেও তাদের কোনও আগ্রহ থাকে না। খুবই অনিচ্ছায় দু-একটা জিনিস তারা দেখায়। আবার এমনও অনেক দোকান আছে যেখানে ঢুকতে না ঢুকতেই সেলসম্যানরা ছুটে আসে। একটা চাইলে চারটে জিনিস বার করে দেয়। হয়ত তেমন দরকার না থাকলেও লজ্জার খাতিরে একটা জিনিস কিনতেই হয়। কিন্তু তাদের সুন্দর ব্যবহারের জন্য তাতেও কোনও আফশোস হয় না। তাহলে সময় বাঁচানোর ব্যাপারটাও বোঝা গেল।
আর পঞ্চম সূত্র কী বলে? গ্রন্থাগার একটা ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠান। দোকানটা যদি প্রতিষ্ঠান হয়, তবে ঠিকমতো চালালে সেটা তো ক্রমবর্ধমান হবেই। হয়ত জায়গার অভাবে পরিমাপে সব সময় বাড়বে না। কিন্তু মজুত জিনিসের পরিমাণে, ক্রেতার সংখ্যায়, বিক্রিতে, সুনামে এর বৃদ্ধি কেউ রোধ করতে পারবে না। তবে মনে রাখা দরকার, ‘ঠিক মতো’ চালানো কথাটা যথেষ্ট আপেক্ষিক। কাকে ‘ঠিক মতো’ বলবো, যদি প্রযুক্তিগত উন্নতি পুরোনো ব্যবস্থাটাকেই ধ্বংশ করে দেয়? লন্ডনের বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘ফয়েলস’ তাদের সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও বিক্রি বাড়াতে পারেনি বরং কমে গেছে, যার
জন্য তারা e-books-কেই দায়ী করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বই সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে ই-বুকস-প্রতিহত করার নীতি নির্ধারণও ঠিক মতো চালানোর প্রাক-শর্ত।
যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে আসি। সেটা হল– গ্রন্থাগার বিজ্ঞান সব কিছু ত্যাগ করা চশমাআঁটা পড়ুয়াদের বিষয় নয়। এটা আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত একটা শাস্ত্র, যা প্রতি মূহুর্তে আমাদের উন্নততর জীবনের পথেই চলতে সাহায্য করে।
ক্রমশ