পরপর সব পর্ব বইবাতিক-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭(শেষ পর্ব)
৬
কোনও প্রাণী যে জীবন্ত তা প্রমাণ করার যে ক’টি উপায় আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তার বৃদ্ধি ও পরিবর্তন আছে কিনা নির্ণয় করা। জীবন্ত মানুষ পশুপক্ষী গাছপালা– সকলেরই এই ক্ষমতা আছে। কোনও জীবের বৃদ্ধি এবং পরিবর্তন থেমে গিয়ে যেমন তা ক্রমে বিনষ্ট হয়ে যায়, গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রেও তার ভবিষ্যৎ একই রকম। এই বৃদ্ধি বহুমাত্রিক– শুধু আকারে নয়, প্রকারেও। জীবিত মানুষের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি দু’রকমের– শৈশবের বৃদ্ধি এবং বয়স হবার পরের বৃদ্ধি। কোনও শিশুর জন্মের পর থেকে তার শৈশব কৈশোর যৌবনের একটা সময় (প্রায় পঁচিশ বছর) পর্যন্ত বৃদ্ধি চলতেই থাকে। তারপরে যা বাড়ে তা শুধু গোঁফ দাড়ি বা চর্বি নয়, বুদ্ধিও এবং পরিবর্তন হতে থাকে হাড় অস্থি পঞ্জর ও ত্বকের।
একটা জীবন্ত গ্রন্থাগারেরও অন্যতম বৈশিষ্ট তার বৃদ্ধি। সেই বৃদ্ধি প্রকাশিত হয় তার সংগ্রহ, কর্মী, পাঠক ও অন্যান উপাদানগুলির বিকাশের মধ্য দিয়ে। প্রাথমিক বৃদ্ধির পর্যায়টাকে সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায়, যেমন এক শ’ বই দেড় শ’ হল বা সদস্য দশ থেকে পনেরো হল, কিংবা পড়বার টেবিল দুটো থেকে চারটে হল। কিন্তু পরিণত একটা গ্রন্থাগারে সব সময় বৃদ্ধিটা এরকম নাও হতে পারে। অর্থাৎ আকারে না বেড়ে হয়ত গুণগত পরিবর্তন হল। মোটা খাতায় লিখে বই ধার দেওয়ার পুরনো পদ্ধতি বদল করে এমন একটা নতুন পদ্ধতি চালু করা হল যাতে অল্প সময়ে অনেক বেশি বই ধার দেওয়া যায়। এটাও বৃদ্ধি– তবে পরিমাণগত নয়, গুণগত।
আর সেটাই রঙ্গনাথন প্রকাশ করলেন তাঁর পঞ্চম সূত্রে। গত এক বছর ধরে আমরা রঙ্গনাথনের চারটে সূত্র দেখেছি। এক বছর ভুলে যাওয়ার পক্ষে অনেকটা সময়। তাই সেগুলো আর একবার মনে করা যাক :
প্রথম : বই ব্যবহারের জন্য।
দ্বিতীয় : (সংগ্রহে) প্রত্যেক পাঠক তাঁর বই পাবেন।
তৃতীয় : (সংগ্রহে) প্রত্যেক বই তার পাঠক পাবে।
চতুর্থ : পাঠকের সময় সাশ্রয় করতে হবে।
এবার এই বৃদ্ধি ও পরিবর্তনকে ভিত্তি করে তাঁর ‘গোল্ডেন রুল’-এর পঞ্চম এবং শেষ সূত্র হল :
গ্রন্থাগার এক ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠান
মনে রাখতে হবে যে রঙ্গনাথন যখন ‘পঞ্চসূত্র’ আবিষ্কার করেন তখন ডিজিটাল জগতের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। পার্সোনাল কম্পিউটার তো দূরের কথা মেন-ফ্রেম কী– সেটা খায় না মাথায় দেয়, সে সবও লোকে জানত না। জ্ঞানের প্রধান উৎসই ছিল বই।
‘লাইব্রেরি’ শব্দের সঙ্গে বই (book) শব্দটা জড়িয়ে আছে আজন্ম কাল থেকে। ‘বই’ জ্ঞানের একটা বাস্তব রূপ। তাই গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত রঙ্গনাথনের সব কটা সূত্রেই তখন বই-এর কথা এসেছে। একই ভাবে প্রলেখ (document)-ও আর একটা বাস্তব রূপ। বই বা প্রলেখ– যাই হোক না কেন, দু’টোর মধ্যেই ভরা আছে তথ্য (data)। তোমরা লক্ষ করেছ নিশ্চয়ই, গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই সারা জগৎ জুড়ে এক অন্তহীন তথ্য বিস্ফোরণ শুরু হয়েছে। ফলত যে সমাজ যত বেশি এইসব তথ্য ব্যবহার করতে পারে, তাদের তত বেশি উন্নত বলে মনে করা হয়। কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার, পি.সি-র আবিষ্কার, সর্বোপরি ইন্টারনেটের বিশ্বজালে পৃথিবীটা মুড়ে ফেলতে পারায় যে পরিমান তথ্যের সৃষ্টি হয়েছে, সে সবই আছড়ে পড়েছে সমগ্র আধুনিক গ্রন্থাগার ব্যবস্থার ওপর। নতুন ব্যবস্থায় লাইব্রেরি এখন তথ্যকেন্দ্রও। সেই হিসাবে রঙ্গনাথনের সূত্রগুলোর পরিবর্তিত রূপ দাঁড়াল:
প্রথম : তথ্য ব্যবহারের জন্য।
দ্বিতীয় : (সংগ্রহে) ব্যবহারকারী তাঁর উপযোগী তথ্য পাবেন।
তৃতীয় : (সংগ্রহের) তথ্য তার ব্যবহারকারী পাবে।
চতুর্থ : ব্যবহারকারীর সময় সাশ্রয় করতে হবে।
পঞ্চম : তথ্য ব্যবস্থা এক ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠান।
পঞ্চম সূত্রটির ব্যাখ্যা করার আগে বলে নেওয়া ভাল যে ইতিপূর্বে আলোচনা করা প্রথম চারটে সূত্রের সঙ্গে এই সূত্রের একটু তফাৎ আছে। ওই চারটে নীতি প্রধানত বর্তমান সময়ে গ্রন্থাগারকে কীভাবে পরিচালনা করা হবে, তার উপায় দেখিয়ে দেয়। কিন্তু এই পঞ্চম নীতিটি ভবিষ্যতে লাইব্রেরি কী রূপ নেবে, তার সম্পর্কে নির্দেশ করে। মনে রাখতে হবে, ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠান হিসাবে গ্রন্থাগার কখনই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না– ক্রমাগত বড় ও পরিবর্তিত হতে থাকবে। আর এই কথা মনে রেখেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও সেই ভাবে করতে হবে।
এই বড় হওয়া ব্যাপারটা কেমন ? সব গ্রন্থাগারে প্রথমেই যেটা বাড়ে, সেটা সংগ্রহ (stock)– বইএর গ্রন্থাগার হলে বইএর সংগ্রহ। হাজার খানেক বই নিয়ে একটা সংগ্রহ শুরু হলে পাঠকের পছন্দমতো এইসব বই পড়া শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। তার পরে তারা লাইব্রেরিতে কেন আসবে যদি না তাদের জন্য নতুন বইএর ব্যবস্থা করা যায়। অর্থাৎ বইএর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এক হাজার দু’ হাজার হবে, দু’ হাজার চার হাজার, তারপর পাঁচ– এভাবে বাড়তেই থাকবে।
আর বই বাড়ার অর্থ শুধু বইএর সংখ্যা বৃদ্ধিই নয়, সেগুলো রাখারও ব্যবস্থা করা। যদি হাজার বই রাখতে পাঁচটা বুক শেলফ লাগে, তবে পাঁচ হাজার বইএর জন্য পঁচিশটা শেলফ লাগবে। সেগুলো থাকবে কোথায়? নিশ্চয় হাওয়ায় নয়। অর্থাৎ সেগুলো রাখার জন্যও আলাদা জায়গা, মানে ঘর দরকার। আবার ঘর হলেই সেখানে আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। লাইব্রেরিতে পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বইকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত ওষুধ ছিটোতে হয়। এখন একটার জায়গায় তিনটে ঘরে পেস্টিসাইড স্প্রে করতে হবে। আর নতুন শেলফ, ঘর, আলো, ওষুধ, ইত্যাদি সবগুলোর জন্যই বেশি খরচ হবে। বোঝা যাচ্ছে সংগ্রহ কীভাবে আকারে বাড়ছে ?
আবার আকারে না হলেও গ্রন্থাগার পরিষেবা (service)-এর দিক দিয়েও বাড়তে পারে। ধরা যাক, এতদিন পাঠকদের শুধু বই ধার দেওয়া হত। এবার ঠিক হল, বইএর সঙ্গে পত্র-পত্রিকার পুরনো সংখ্যাও ধার দেওয়া হবে। এটা একটা নতুন পরিষেবা। এই নতুন পরিষেবার জন্য নিয়ম প্রণয়ন করা থেকে শুরু করে, সেগুলিকে আলাদা করে গুছিয়ে রাখা, ধার দেবার জন্য তৈরি করা, ইত্যাদি অনেক নতুন কাজ করতে হবে। এমনি ভাবেই আরও অনেক পরিষেবা যোগ হতে পারে, যেমন আলোকপ্রতিলিপি (photocopying) সেবা।
সি.ডি (Compact Disc) অথবা ডি.ভি.ডি (Digital Video Disc অথবা digital versatile disc) সেবা, সম্প্রতি চালু হওয়া ওয়াইফাই (WiFi) সেবা, ইত্যাদি। এগুলো বাড়তেই থাকবে এবং নতুন নতুন সেবা যোগ হবে।
ওয়াইফাই পরিষেবার নির্দেশিকা (signage)
“Wireless Fidelity, wireless internet”
এর আগে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে আমরা এক বিপুল তথ্য বিস্ফোরণের কথা বলেছি। এই বিস্ফোরণের পর থেকেই সমগ্র জ্ঞানের জগৎটা এমন এক পর্যায়ে এসেছে যে, কোন বিভাগ কীভাবে বাড়বে তা আগে থেকে অনুমান করা খুবই শক্ত, হয়ত অসম্ভবও। কেন শক্ত বা অসম্ভব সেটা আমরা আগামী বারে দেখব। আর সেই বিস্তারিত আলোচনা থেকেই বোঝা যাবে রঙ্গনাথনের পঞ্চম সূত্রের তাৎপর্য।
ক্রমশ