বর্ণদূত , ১০০ টাকা, ওয়েবস্টোর থেকে কিনতেঃ http://www.bornodoot.com/
কিশোরদের গল্প উপন্যাস লেখার অন্যতম প্রধান উপাদান হল অ্যাডভেঞ্চার। তা গোয়েন্দা, অজানা আবিষ্কার, ভৌতিক বা নিছক বেড়াতে যাবার গল্পই হোক না কেন। সমুদ্রগুপ্তের তরবারি বইটিতে পুষ্পেন যথাযথভাবে সেই সুরটি গোড়াতেই ধরে ফেলেছেন। এ বইটিতে তিনটি বড়ো গল্প, লেখকের কথায় ‘উপন্যাসিকা’, রয়েছে। প্রথমটা ‘নবাব ওয়াজিদ আলির বাক্স’। আদতে একটি গোয়েন্দা গল্প, এক তরুণী আইনজীবি, শখের গোয়েন্দাগিরি তার নেশা। বাপ প্রাক্তন পুলিশকর্তা। এই জড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত রহস্যে যা শুরু হয় কলকাতার এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে অপহরণ দিয়ে। এই কাহিনীটার একটা চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল ক্রমাগত বাঁকবদল এবং গোয়েন্দাকে হিম্যান বা উওম্যান হিসেবে দেখানোর চেষ্টা না করা। ফলে পাঠক শুধু উৎকন্ঠাতেই টান টান থাকেন না তার মধ্যে একটা চাপা আশঙ্কাও কাজ করে, যা গল্পের শেষ অবধি অনায়াসে টেনে নিয়ে যায়। ওয়াজিদ আলির বাক্স-র শেষ পরিণতিটা চমকপ্রদ, বস্তুত রহস্যের একশ শতাংশ সমাধান হল কি হল না এই ধন্ধে পাঠক শেষ অবধি বিমূঢ় থাকেন। গোয়েন্দা রহস্যকে ছাপিয়ে যায় ঐতিহাসিক রহস্য।
দ্বিতীয় গল্পটা, ‘ওরেসাম্বাদের শেষ বংশধর’, কাল্পনিক অভিযানবিশেষ। অনায়াসে ঘনাদা বা তারিণী খুড়োর অত্যাশ্চর্য অভিযানগুলোর তালিকায় ফেলা যেতে পারে। শুধু পুষ্পেনের মধ্যে কেন, আমাদের সবারই মনের মধ্যে ছেলেবেলা থেকেই যে এক-একটা চাঁদের পাহাড়ের শঙ্কর বাসা বেঁধে আছে তা গল্পটা পড়তে পড়তে বেশ টের পাওয়া যায়। গভীর অরণ্য, বিপদসঙ্কুল পাহাড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অজানা প্রাণী, কে নেই! সব মিলিয়ে একলা পড়ার অভিজ্ঞতায় ছমছমে ভাবটা বেশ টের পাওয়া গেল। বিশেষত ওরেসাম্বাদের এলাকাতে বা শেষ পর্যন্ত তাদের মন্দিরে পৌঁছে যে গা শিউরে ওঠা অভিজ্ঞতা হল, তা এ বইয়ের আগামী পাঠকদের জন্য তোলা থাকল। একটা কথাই যোগ করতে পারি এ অভিজ্ঞতা কোনো অংশেই এযাবৎ পড়া ভয়াল অ্যাডভেঞ্চার গল্পের চেয়ে কম নয়।
‘সমুদ্রগুপ্তের তরবারি’, শেষ উপন্যাসিকা, এবং তুল্যমূল্য বিচারে এ বইয়ের শ্রেষ্ঠতম। যদিও পাঠসুখ বাকি দুটিরও কিছু কম নেই। এই কাহিনীর পটভূমিকা শিলং এর পাহাড়ি অঞ্চল। বাঙালি চাকুরে, কামাখ্যাদেবীর মন্দির এবং প্রাচীন রাজঘরানার সঞ্চিত ধনসম্পত্তির এক কুহেলী-মিশ্রণ। রহস্যকাহিনীর গল্প বলে দিলে তা নাকি ফ্যাকাশে হয়ে যায়, অথচ এই গল্প আপনাকে বলে দিলেও আপনি পড়বার সময় একইরকম উজ্জ্বল অনুভব করবেন। তবু সম্পাদকের নির্দেশে আমি গোটা গল্পটা বলা থেকে বিরত থাকলাম। সমুদ্রগুপ্তের তরবারি কীভাবে এক বাঙালি চাকুরেকে তার শৈশবের স্মৃতি ফিরিয়ে দিল, কীভাবে রাজসম্পত্তির লোভে দস্যু তস্কর তথা বিশ্বাসঘাতকেরা প্রকৃতির হাতেই শাস্তি পেল, আর কীভাবেই বা সাধক হেমগিরি তার প্রাণপ্রিয় রাজকুমারকে প্রাণে বাঁচালেন, তার একটা চমৎকার জাল বুনেছেন পুষ্পেন। একবার তাতে প্রবেশ করলে শেষ অবধি সে জাল কেটে পাঠকের বেরোনোর রাস্তা নেই।
অ্যাডভঞ্চার পছন্দ করেন এমন কিশোর কিশোরীরা তো বটেই, মনেপ্রাণে আগাগোড়া যারা কৈশোরে আজীবন আবদ্ধ, এ বইটি তাদের কাছে একটুকরো খুশি বয়ে আনবে একথা হলফ করেই বলা যায়। এবছর এপ্রিল মাসে বইটি প্রকাশ করেছে বর্ণদূত। দাম ১০০ টাকা। এখনো যারা পড়েননি, অনুরোধ পড়ে ফেলুন, বাড়ির ছোটোটা, পাড়ার ছোটোদেরও উপহার দিয়ে পড়িয়ে ফেলুন।
আলোচনা করেছেনঃ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়