দীপঙ্কর চৌধুরী
।।১।।
শীতকালে কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায় তোমরা নিশ্চয়ই বেড়াতে এসেছ? দেখেছ নিশ্চয়ই যে মাঝের ঐ মস্ত ঝিলটায় নানান রঙের নানান সাইজের পাখিতে ভর্তি হয়ে আছে, তাদের কারো কারোর নাম জানি, অনেকেরই জানিনা। আবার যদি গরমকালে কোনো একদিন চিড়িয়াখানায় যাও তো ঐ ঝিল প্রায় ফাঁকাই দেখতে পাবে। পরের শীতকালে গেলে কিন্তু আবার ঝিলভর্তি পাখি পাবে, এমনকি কোনো এক নির্দিষ্ট পাখিকে যদি চিহ্নিত করে দিয়ে আসতে পারতে আগের শীতে, হয়তো তা্রই দেখা পেয়ে যেতে পারো ঠিক পরের শীতকালে, বা তার পরের পরের বেশ কয়েকটি শীতে! কী, বেশ আশ্চর্য নয় ব্যাপারটা?
কোথা থেকে আসে ঐ ঐ সব অজানা অচেনা পাখিগুলি…..সাইবেরিয় সারস , আমুরের বাজ, রাঙামুড়ি বা লালঝুঁটি ভুতিহাঁস, গাদোয়াল, বৈকাল তিলিহাঁস? কোথায় চলে যায় শীত ফুরোলে? কেন আসে, কেন যায়? কেন বা কী করে একই জায়গায় বছর বছর ফিরে ফিরে আসে বা আসতে পারে তারা? আসা-যাওয়ার পথে বিপদ-আপদ হয় না কি তাদের? এইসবের গল্পই আজ করব তোমাদের সঙ্গে, আর দেখো কত সব আশ্চর্য আর মজার মজার তথ্য বেরিয়ে আসবে, যা ‘সর্বশ্রেষ্ঠ জীব’ হিসেবে মানুষের সিংহাসনটাকেই বোধহয় টলিয়ে দেবে!
এই রেকর্ডেড ঘটনাটা দু’বছর আগে ঘটলেও বিষয়টা যে কত লক্ষ বছর আগে থেকে চলে আসছে, জানি না। প্রশান্ত মহাসাগরীয় সোনালী প্লোভার [Pacific golden plover (Pluvialis fulva)] হলো ‘ওয়েডার’ গোত্রের ছোট্ট এক পাখি, যারা সাধারণতঃ সমুদ্রতীরের বালি খুঁটে খুঁটে ছোট ছোট মাছ,চিংড়ি,পোকা খেয়ে বাঁচে। পূর্ণবয়সী এমন এক পুং পাখির দেহের ওজন মাত্র দেড়শ’ গ্রামেরও কম হয়ে থাকে, দৈর্ঘ্য পঁচিশ সেন্টিমিটারের মধ্যে।
২০১৪সালে এক কানাডিয়ান জীববিজ্ঞানী আলাস্কাতে এমন এক প্লোভার দেখতে পেয়ে তার পিঠে একটি স্যাটিলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে ছেড়ে দেন। প্রায় বছর খানেক পরে তার উড়ানের যে তথ্য পাওয়া গেল, তা বিস্ময়কর! নীচের ছবি দেখোঃ
আলাস্কার ভয়ংকর শীত পড়বার ঠিক আগে আগে আমাদের এই পাখিবন্ধু (‘নাম’ দেওয়া হয়েছিল ‘৯৭’) পাশের ইয়ুকন প্রদেশের কুস্কোকউইম বদ্বীপে এসে এরকম আরও হাজার হাজার পাখির সঙ্গে যোগ দেয় যারা পেট ভরে পোকা-টোকা খেয়ে নিয়ে দীর্ঘ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৪ এই পাখিটা যাত্রা শুরু করলো এবং ৮ ইন্টু ২৪ ঘণ্টা= ১৯২ ঘণ্টায় লাগাতার ৮,৮০০ কিলোমিটার উড়ে উড়ে (হাওয়াই দ্বীপের পাশ দিয়ে উঃ প্রশান্ত মহাসাগরকে প্রায় অর্ধচক্রাকারে উড়ে নিয়ে) জাপানের দক্ষিণতম দ্বীপ ওকিনাওয়াতে পৌঁছল ২৩শে সেপ্টেম্বর।
ভাবো, আটদিন আটরাত এক ছোট্ট পাখি অকূল মহাসমুদ্রের বুকে উড়ে চলেছে…..খাওয়া নেই ঘুম নেই দিন নেই রাত নেই রৌদ্র আছে বৃষ্টি আছে। মেঘলা আকাশে দিগভ্রান্ত হয় না? ক্লান্ত হলে যে দু’দণ্ড বসে জিরিয়ে নেবে কোথাও তার কোনো সুযোগ নেই (এবং সেটা জেনেই বেরিয়েছে!)।
দক্ষিণ জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপের তাপমাত্রা অনেক বেশি। তার খাদ্যও ভালো জোটে সেখানে।অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মিলে রইলো সে জাপানে মাস খানেক। ক্রমে এখানে আরও অনেক উত্তুরে পাখি এসে পড়াতে স্থান অসংকুলান হল, ও ১৮ অক্টোবর এই অস্থায়ী বাসা ত্যাগ করে তারা আরও দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসিতে এক ধানক্ষেতে গিয়ে গ্রীষ্মাবাস পাতল।
এবারের উড়ান দিন দশেকের, কিন্তু পার হয়েছিল ‘মাত্র’ হাজার কি.মি.-র মতো আকাশপথ। ২৮শে অক্টোবর থেকে পাঁচ মাস ইন্দোনেশিয়ার অতিথি হয়ে থেকে গেল পুরো শীতকালটা সেই দেশেই (এমনই আরেকটা দল হয়তো এসেছিল আমাদের আলিপুর চিড়িয়াখানায় বা সাঁতরাগাছি জলায়) ।
তারপর? শীতশেষে তারপর ঘরে ফেরার পালা। স্যাটিলাইট তথ্য বলছে, ৩রা এপ্রিল দুগগা বলে বেরিয়ে পড়লো আমাদের এই বন্ধুপাখিটি তার আরও সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে, বাড়ি ফিরতে। দু-তিন দিন…দু-তিন দিন করে করে হংকং ও সাংহাই উড়ে উড়ে ও দিন তিনেক করে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে উত্তর-পূর্ব চীনের মাঞ্চুরিয়া প্রদেশে পৌঁছে দিন দশেকের বিশ্রাম । এবং ফের পেট পুরে খেয়ে নেওয়া, কারণ এবার ফের লম্বা ও শেষ উড়ান পর্বটি শুরু হবে। দিন চারেকের মধ্যে হাজার কি.মি. লাগাতার উড়ে আলাস্কার সেই নোম-অঞ্চলে এবার ফিরে এলো আমাদের ৯৭ নং পক্ষী। দিনটা ৩১শে মে ২০১৫তে। টোটাল ২৭,০০০ কিলোমিটার উড়ানপথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সেই ছোট্ট পাখি। মানুষ পারবে এমন? হেঁটে হেঁটেও? তাই, মানুষের ‘শ্রেষ্ঠ জীব’-এর তকমাটা এক নিরিখে। কিন্তু অন্য অন্য নিরিখে? সে বাবুই পাখির মতো বাসা বুনতে পারে না, পারেনা এই সোনালী প্লোভারের মত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বা….বা…..এমন অনেক কাজ। তবে, ৯৭-এর সঙ্গের অনেক সাথীপক্ষীই আর বেঁচে রইল না। কারণ লোভী-নিষ্ঠুর মানুষ সব দেশেই আছে। প্রাণ গেছে তাদের হাতে।
বন্যপ্রাণী ও শিকারী পাখিদের হাতে ইন্দোনেশিয়ায় প্রাণ গেছে অনেকের। তবু এই পরিযান চলতেই থাকবে আগামী বছর, তার পরের বছর, তার পরেরও…..কারণ কবে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল, কত লক্ষ বছর আগে আমরা তা জানি না ঠিকঠাক।
কেন এই পরিযান (migration)? কী করে অগাধ মহাসাগরের বুকে হাজার হাজার মাইল দিবারাত্র উড়ে চলতে পারে পরিযায়ী পাখির দল সঠিক দিশায়? এসো, এইবার এই এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজি আমরা।
।।২।।
পরিযান—migration. প্রাণীর পরিযান! পক্ষী পরিযান! কেবলমাত্র পাখি নয়, আফ্রিকার সেরেঙ্গেটির বন্যগাভী (wildebeest) থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের স্যামন মাছ (আমাদের ইলিশ মাছও) থেকে নানান পোকা মাকড় নিয়মিত ভাবে পরিযান (migration) করে থাকে। কোন্ ধরনের যাত্রাকে ‘পরিযান’ বলবো, সাধারণ ‘সরণ’ (displacement) নয়? যে যে লক্ষণগুলো থাকলে প্রাণীর পরিযান বলা যাবে তা হলোঃ (১)নিয়মিত বাৎসরিক বা মৌসুমী যাওয়া-আসা; (২) হ্যাঁ, শুধু যাওয়া নয়, ফিরে আসাও। চক্রাকারে। প্রতি বৎসর; (৩)এটা জৈবিক ও পরিবেশগত প্রয়োজনে হয়ে থাকে, যেমন তাপের তারতম্য, ডিমপাড়া ও খাদ্যাভাব । পাখিদের বাৎসরিক পরিযানে এই তিনটি লক্ষণই দেখতে পাওয়া যায়। এবং দীর্ঘতম পরিযান পাখিরাই করে থাকে। প্রায় আঠের শ’ প্রজাতির পাখি বিশ্বের বিভিন্ন অংশ থেকে অন্যত্র বাৎসরিক পরিযানে উড়ে যায় হাজার হাজার মাইল পথ।

arctic tern
উত্তরমেরু অঞ্চলের টার্ন পাখি (arctic tern । Sterna paradisaea ) হলো পরিযানে ফার্স্ট! বছর গড়ে আশি হাজার কি.মি. উড়ান দেয় সে, হ্যাঁ, ঠিক পড়েছ, আশি হাজার কিলোমিটার—আসা-যাওয়া নিয়ে। উত্তরমেরু অঞ্চলে শীত পড়তে শুরু করলেই এরা উড়ে উড়ে দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে চলে যায় আবার সেখানে শীত পড়তে শুরু করলেই ফের উত্তরে ফেরা, ডিম পাড়তে। মানে, বছরে দুটো গ্রীষ্মকাল উপভোগ করে আর্কটিক টার্ন পাখিরা।

Ruff
উত্তর সাইবেরিয়ার ওয়েডার গোত্রের পাখি ‘রাফ’ (Ruff)ও কম যায় না। সমগ্র উত্তর সাইবেরিয়া থেকে উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়া হলো এদের মূল গ্রীষ্মবসত ও চারণভূমি ও প্রজননস্থান। আর শীত পড়তে পড়তে এরা গড়ে বিশ হাজার কিমি উড়ে চলে যায় পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত। ভারতীয় উপমহাদেশেও আসে অনেক রাফ পাখি। ‘রাফ’ আবার এক সাহেবি ফ্যাশান পোশাক ছিল এককালে, জানো তো? মহারানি এলিজাবেথ বা মহাকবি শেক্সপিয়রের ছবিতে ওঁদের গলায় যে লেসের কাজ করা ব—ড়ো গোল কলার দেখা যায় তাকে বলে ‘রাফ’, এসেছে এই ‘রাফ’ পাখি থেকেই, কারণ প্রজননকালে পুং রাফ পাখির গলায় ঠিক এমন দেখতে পালক গজিয়ে ওঠে।

হুইটিয়ার
একটা তথ্য লক্ষ্য করবার মতো। আর্কটিক টার্ন বলো বা রাফ পাখি বা ছোট্ট উত্তুরে হুইটিয়ার (Oenanthe oenanthe) যারা দীর্ঘ দীর্ঘ পরিযায়ী উড়ানের জন্য বিখ্যাত তার প্রত্যেকেই কিন্ত উত্তর গোলার্ধের পাখি, অর্থাৎ তাদের স্বাভাবিক বাসা উত্তরে, ডিমও পাড়ে সেখানে, কেবল শীত থেকে বাঁচতে দক্ষিণে পালিয়ে গিয়ে কয়েকমাস বাঁচে। কিন্তু শীত তো দক্ষিণ গোলার্ধেও পড়ে, ভয়ংকরই পড়ে। তা, সেখানকার কোনো পাখি কি নেই যারা উত্তর গোলার্ধে উড়ে যায় শীত থেকে বাঁচতে?

muttonbird
আমাদের এখানে ব্রয়লার মুরগি খাওয়ার মতো অস্ট্রেলিয়ায় ‘চাঁদপাখি’ বা ‘muttonbird’ [short-tailed shearwater or slender-billed shearwater (Ardenna tenuirostris)] খুব জনপ্রিয় । এদের ‘ইওলা’ পাখিও বলে, কারণ টাসমানিয়া দ্বীপের ইওলা-ই হলো এদের মূল বাসস্থান। একমাত্র দীর্ঘ-পরিযায়ী পাখি এরা, খাদ্যের জন্যে যাদের মারা বেআইনি নয়, কারণ সংখ্যায় এরা প্রচুর হয়ে থাকে। মাংস অতীব সুস্বাদু। আধা কেজির মতো দেহের ওজন হয় এদের , গড় দৈর্ঘ্য ৪০-৪৪ সে.মি.। দীর্ঘ ডানার অগ্রভাগ ছুঁচলো হয়। এপ্রিল মাস নাগাদ অস্ট্রেলিয়ার শীতকাল শুরু হতে হতে এরা দল-কে-দল উড়ান দেয় উত্তরমেরুর দিকে, আর নভেম্বর নাগাদ ফিরে আসে। এদের উড়ানপথ পুরোটাই প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে।চক্রাকারে।

বার-টেইল্ড গডউইট
দক্ষিণ গোলার্ধের আর একটি পাখির গল্প এখানে না করলে অন্যায় হবে, সে হলো ‘বার-টেইল্ড গডউইট’ (Limosa lapponica) । দীর্ঘতম নন-স্টপ উড়ানের রেকর্ডটি এই পাখির, দশ হাজার কিলোমিটারেরও অধিক পথ এক্কেবারে না থেমে উড়ে চলে সে! নিউজিল্যান্ড থেকে সোজা উত্তরে উড়ে উড়ে উত্তর কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড! পুরোটাই প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে চলা!

দাগি রাজহাঁস
বেশ কয়েকটি বিখ্যাত পরিযায়ী পাখির গল্প করলাম, এখন আর একটির কথা বলেই এই অংশে দাঁড়ি টানবো। আমাদের ঘরের পাশের পুকুরে চড়া বালিহাঁস [Nettapus coromandelianus // Cotton Pygmy Goose) ] কে না দেখেছে? সেই Anatidae (অ্যানাটিডি) গোষ্ঠীরই এক হংস হলো Bar-headed goose , বাংলায় দাগি রাজহাঁস (বৈজ্ঞানিক নাম: Anser indicus) । ঐ লাতিন নামটির অর্থই কিন্তু ‘ভারতীয় রাজহংস’ , যদিও এদের বর্তমান বাসস্থান মধ্য এশিয়াতে, এবং শীতকালে এরা হাজারে হাজারে এসে ভারতীয় উপমহাদেশ ছেয়ে ফেলে। সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা ডিঙিয়ে উড়ে আসে এরা। এটাই এদের বিশেষত্ব। এরা সর্বোচ্চ স্তরে, প্রায় ত্রিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে যায়—-আজকের কোনো জেট প্লেন যে উচ্চতায় ওড়ে! তৃতীয় ছবিটিতে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির উড়ান-উচ্চতা দেখানো হয়েছে, এরোপ্লেনের সঙ্গে তুলনা করে। এই ‘দাগি হাঁস’ Anser Indicas ই হলো উড়ান-উচ্চতায় নাম্বার ওয়ান।
আরও এমন অনেক পাখির দল আছে, হাজারে হাজারে। তাদের সকলের কথা তো আর এই লেখার মধ্যে আঁটবে না। শেষে কিছু ভালো ভালো বইয়ের কথা বলে দেব তোমাদের । আরও উৎসাহ থাকলে সেগুলো পাতা উল্টিয়ে দেখতে পারো। বহু বহু ওয়েবসাইট রয়েছে। একটা এমন হলো https://www.allaboutbirds.org । আরেকটা https://www.rspb.org.uk
।।৩।।
সব পাখিই কিন্তু পরিযায়ী নয়। যারা নিজের বাসস্থানের আশেপাশেই যথেষ্ট খাদ্য খুঁটে নিতে পারে তাদের অন্যত্র যাবার দরকার পড়ে না। যেমন, ‘তিতির’জাতীয় পাখি (Partridge)। যেমন, আমাদের চারিপাশে দেখা কাক, চড়ুই, ফিঙে, দোয়েল, শালিক ইত্যাদি। এটা দেখা গেছে যে যখন খাদ্য-বাসস্থানের অভাব হয় না, তখন ‘হামিংবার্ড’এর মতো ছোট্ট পাখিও বরফপড়া আবহাওয়াতে থেকে যেতে পারে। নতুবা পরিযানে উড়ে যায় দীর্ঘ পথ। পরিযায়ীদের মধ্যেও আবার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ পরিযায়ী পাখি হয়ে থাকে, যারা কয়েকশ’ মাইল থেকে দেশের অন্যপ্রান্তে, বা সুদূর অন্যদেশে পরিযান করে। হিমালয়ের ‘গ্রেট ক্রেসেটেড গ্রেব’ (Podiceps cristatus) পাখি সেখানে বড্ড শীত পড়লে নিচে নেমে আসে। এটাও এক ধরনের পরিযান। অর্থাৎ, দাঁড়ালো এই যে খাদ্যে টান পড়লে বা পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে পড়লে ও ভিড় বেড়ে গেলে পাখিদের পরিযান শুরু হয়ে যায়।
কিন্তু, বিশেষ করে অতিদীর্ঘপথের পরিযায়ী পাখিরা কী করে মহাসমুদ্রে পথ চিনে চিনে ওড়ে, যেখানে কোনো নিশানা দেখতে পাওয়া যায় না?
এ’ প্রশ্নের উত্তরটা এখনও পক্ষিবিজ্ঞানীদের (ornithologist) সম্পূর্ণ জানা নেই। সম্ভবতঃ, এটি পাখিরা করে থাকে অনেক রকম বিষয় মিলিয়ে, যেমন সকাল-বিকেলের সূর্যের অবস্থান, রাতের চাঁদ-তারার প্যাটার্ন দেখে চেনা, এবং বিশেষত পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে পারা। দঙ্গলের মধ্যে থাকা, উড়তে উড়তে গলার স্বর দিয়ে ডেকে ডেকে নিজের অবস্থান বোঝানো এবং অনেক ক্ষেত্রে মাটির গন্ধ চিনে রাখা (বিশেষতঃ, পায়রা জাতীয় পাখির ক্ষেত্রে)—এ’সবও ওদের সঠিক পথে উড়ে চলার চাবিকাঠি।
যদিও এই নিরবচ্ছিন্ন উড়ে চলাটা শুনতে যত রোমান্টিক লাগে পাখিদের ক্ষেত্রে বাস্তবে কিন্ত মোটেই তা নয়, বরং বড়ই বিপজ্জনক। কারণ প্রতি উড়ানেই কত কত পাখি যে মারা যায়—শিকারী মানুষ ও প্রাণীদ্বারা, খারাপ আবহাওয়ার কারণে , এবং সম্ভবতঃ শারীরিক পরিশ্রমেও—কোনো লেখাজোকা নেই তার। আধুনিক কালের লম্বা লম্বা ইমারৎ, টেলিকম টাওয়ার ইত্যাদি এদের বড় শত্রু। বহুতল বাড়ির আলো দেখে এসে অনেক অনেক নিশাচর পরিযায়ী পাখি তাতে ধাক্কা খেয়ে মরে। কিছু দেশে, যেমন কানাডায়, FLAP (Fatal Light Awareness Program) এর মতো সংস্থা তৈরি হয়েছে তাই এদের বাঁচাতে।বস্তুতঃ, ‘bird migration’ এর মতো ‘drift migration’-ও একটি জানবার বিষয়, যাতে পথভোলা পাখিদের লক্ষ্য করা হয়। ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের সমুদ্রোপকূলে ছোট্ট গ্রাম স্পার্ন এ’কারণে বিখ্যাত, যেখানে স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা উত্তর আমেরিকা এমন কি সাইবেরিয়ার ফিরতি-পাখিরাও পথভুলে বা উলটো হাওয়ায় এসে পড়ে, এমনকি দলে দলে এসে মরে, (অনেকটা হয়তো) আমাদের আসামের ঝটিংগা গ্রামের মতো। দলে দলে পক্ষীদর্শকেরা তা দেখতে যান ইয়র্কশায়ারের স্পার্ন-এ।
ছোট্ট এই রঙচঙে উড়ন্ত জীব পক্ষীকুলকে কে না ভালোবাসে? কিন্তু মানুষেরই সভ্যতা বিস্তারের পথ মাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে এদের বাঁচার পথ। যদিও, আশার কথা, মানুষই এদের বাঁচাবার প্রয়াস করছে। আমেরিকাতে Migratory Bird Treaty হয়েছিল ১৯১৮ সালে। সম্প্রতি, ১৯৯৫তে, জাতিসংঘের ছত্রছায়ায় African-Eurasian Waterbird Agreement(AEWA) হয়েছে, এবং এই ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর প্রাণীগুলিকে বাঁচাতে সক্রিয় হয়েছে মানুষ।
।।৪।।
পাখি দেখার মতো পাখিদের পরিযান (migration) নিয়ে জানাশোনা এক চমৎকার শখ। তোমরা সালিম আলি (১৮৯৬-১৯৮৭) সাহেবের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ—ভারতের শ্রেষ্ঠ পক্ষিবিশারদ! স্বয়ং জওহরলাল নেহ্রু ওঁর বিশেষ ভক্ত ছিলেন। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল না সালিমের কিন্তু চাকুরি হারিয়ে বম্বের মফস্বলের সাগরতীরে ওঁর বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে যুবক সালিমের পাখি দেখার নেশার শুরু, যা তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দিয়েছিল। ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৫৮) ও ,‘পদ্মবিভূষণ’ (১৯৭৬) সম্মান পেয়েছিলেন, সাম্মানিক ডক্টরেটও। তাই পক্ষী-পরিযানের মতো বিষয় তোমাদের মধ্যে কারোর সিরিয়াস শখ হয়ে উঠতে পারে। অন্ততঃ, আমাদের দেশের অতিথি এই পরিযায়ী পাখিদের প্রতি কোনো নির্মমতা না করতে আমরা তো প্রতিবেশিদের উদ্বুদ্ধ করতে পারি, কী বলো?
দুর্দান্ত.. একটানা পড়ে গেলাম.. লেখককে অনেক অনেক ধন্যবাদ.. লেখাটা বুক মার্ক করলাম
LikeLike
Dipu, anekdin badey tor lekhata porey khub valo lago.
Soobroto
LikeLike
সুন্দর লেখা ।
LikeLike