আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া
কাজল পাখি
এই পাখি দেখলেই আমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বিখ্যাত সেই গানটির কথা মনে পড়ে, ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী’। কিন্তু এ তো আর হরিণ নয়, এ যে কেবলমাত্র এক পক্ষি—নয়নে কাজল পরা। প্রকৃতি ভগবান ওকে কী সুন্দর সাজিয়ে, চোখে কাজল পরিয়ে আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আর তারপর আমরা এর নাম রেখেছি কাজল পাখি, ইংরেজিতে ব্রাউন শ্রাইক (Brown Shrike) বলা হয়ে থাকে। প্রধানত এরা পরিযায়ী পাখি এবং বারবার শীতের সময় এরা একই জায়গায় ফিরে আসে, সমতলে। গ্রীষ্মেও এদের দেখা পাওয়া যায়, তবে সংখ্যায় কম। সুন্দর চেহারা দেখে ভুলবেন না যেন। শ্রাইক নামের পাখিটি বড়োই নিষ্ঠুর। ছোট্ট পাখিটির ধারালো নখের শিকারে কব্জা হয় ইঁদুর, লিজার্ড ও অন্য পাখি। সহজ কথায়, এদের বলা যায় কিলার বার্ড। কারণ, ক্ষুধার্ত না থাকলেও এরা প্রাণীহত্যা করে পরবর্তী সময়ে ক্ষুধা মেটানোর জন্য। কখনও বা ব্যাঙ শিকার করে না খেয়ে ফেলে রাখে। এসব প্রাণী শিকার করতে এরা যে সে কৌশল ব্যবহার করে না, অন্য পাখিদের গান অনুকরণ করে শিকারকে কাছে টানে। শিকারের মাথা ও ঘাড়ে ঠোকর দিয়ে মেরে ফেলে এরা। যেহেতু তুলনামূলক আকারে বড়ো এসব প্রাণীকে শ্রাইক বহন করে নিয়ে যেতে পারে না তাই তারা গাছের কাঁটাযুক্ত ডাল, তারকাটা এমনি কাঁটা চামচও ব্যবহার করে। এসব সূঁচালো জিনিসে শিকারকে গেঁথে তারপরই শুরু হয় খাওয়া। শ্রাইকের মোট ৩০টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে গ্রেট গ্রে শ্রাইক। এরা নর্দান শ্রাইক নামেও পরিচিত। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা এসব দেশে এদের দেখা যায়। আকারে ছোটো পাখিটির ওজন ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম। এদের খাদ্যতালিকায় কী কী খাবার থাকবে তা নির্ভর করে এদের বাসস্থান ও এলাকার ওপর।
কাজল কালো চোখ। স্লিম গড়ন। প্রথম দেখায় যে কেউ মুগ্ধ হবেন। মায়াবী দর্শনের হলেও প্রজাতিটি স্বভাবে হিংস্র। চটপটে। দ্রুত উড়তে পারে। চেলাফেরায় খুব হুঁশিয়ার। নিজেদের তুলনায় ছোটো পাখিদের আশপাশে ভিড়তে দেয় না। সুযোগ পেলে বড়সড় পাখিদেরও আক্রমণ করে। এই কারণে এদের কসাই পাখিও বলা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক আবাসস্থল আংশিক তুন্দ্রা বন, শুষ্ক এবং উষ্ণ এলাকার বিক্ষিপ্ত ঝোপ-জঙ্গল কিংবা গাছগাছালি। এছাড়াও খোলা কৃষিভূমির আশেপাশে অবস্থিত গাছগাছালিতে বিচরণ রয়েছে। বিশেষ করে কাঁটাগাছ কিংবা কাঁটাঝোপে বিচরণ অধিক। বিচরণ করে একাকী কিংবা জোড়ায়। দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ-ভারত ছাড়া এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, আফ্রিকা, দক্ষিণ ফ্রান্স পর্যন্ত। বিশ্বে এরা ভালো অবস্থানে নেই। কৃষিজমিতে কীটনাশক ছিটানোর ফলে প্রজাতিটি হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
শ্রাইকের বিভিন্ন উপপ্রজাতিভেদে রকমফের হয়। হিমালয়ের কোলে কাজল পাখির বেশ অনেকরকমের দেখা পেয়েছিলাম। প্রথমে গরুমারাতে গিয়ে চা বাগানে দেখতে পাই ব্রাউন শ্রাইক। পরে জঙ্গলে প্রবেশ করার পর একের পর এক দেখা পেলাম ধূসর পিঠ লাটোরা (Grey Backed Shrike),
ছোটো লাটোরা (Bay Backed Shrike)।
দেখতে আলাদা হলেও এইসব শ্রাইক প্রজাতি পাখিদের সেই চোখ বরাবর কালো রঙের চওড়া পটি, অর্থাৎ ঠিক কাজল পরা বলে মনে হয়। পরবর্তী সময় উত্তরাখণ্ডের জিম করবেট অভয়ারণ্য অথবা টংলু যাওয়ার পথে সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে শ্রাইক প্রজাতির বেশ কিছু পাখির দেখা পাওয়া যায়।
শীতকালে ব্রাউন শ্রাইক অথবা কাজল পাখি প্রায়ই দেখা যাবে আমাদের ঝোপঝাড়ে। দেখতে গিয়ে প্রথমবারে এদেরকে চড়াই পাখির সাথে যে কেউ গুলিয়ে ফেলতে পারে। এই পাখির কপাল সমেত লম্বা সাদাটে ভ্রূ আর চোখ বরাবর কালো রঙের চওড়া পটি। মাথার চাঁদির থেকে ঘাড় এবং কোমরে হালকা কমলাটে বাদামি ভাব। ওপরে পিঠ প্রায় একরঙা ধূসর-বাদামি। ডানা আবার কালচে বাদামি।
‘ধূসর কসাই’, ইংরেজি নামঃ ইন্ডিয়ান গ্রে শ্রাইক / সাউদার্ন গ্রে শ্রাইক, (Indian Grey Shrike / Southern Grey Shrike), বৈজ্ঞানিক নামঃ Lanius meridionalis। এরা ‘দক্ষিণে মেটে লাটোরা’ নামেও পরিচিত।
প্রজাতি দৈর্ঘ্যে কমবেশি ২৪-২৫ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ৩০-৩৪ সেন্টিমিটার। মাথা, ডানা ধূসর সাদা। ডানার প্রান্ত-পালক কালো। কোমর সাদা। কালো রঙের লম্বা লেজের নিচের পালক সাদা। ঠোঁট শক্ত মজবুত খাটো, ধাতব কালো রঙের। ঠোঁটের গোড়া থেকে কপালের ওপর হয়ে চোখের দু’পাশ দিয়ে চওড়া কালো টান ঘাড়ের কাছে গিয়ে ঠেকেছে। গলা সাদাটে। দেহতল ময়লা সাদা। পা কালচে। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। প্রধান খাবার ছোটো মেরুদণ্ডী প্রাণী, পোকামাকড়, ফড়িং, পঙ্গপাল, ঝিঁঝিঁ পোকা, টিকটিকি ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম মার্চ থেকে জুলাই। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। বাসা বাঁধে ভূমি থেকে ৩-৫ মিটার উচ্চতায় গাছের ডালে। বাসা বানাতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, পশম, মাকড়শার জাল ইত্যাদি। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪-১৫ দিন। শাবক উড়তে শিখে তিন সপ্তাহের মধ্যে। গড় আয়ু ৬ বছর।
‘তামাপিঠ লাটোরা’, ইংরেজি নামঃ ইন্ডিয়ান বে-ব্যাকড শ্রাইক (Indian Bay-backed shrike), বৈজ্ঞানিক নামঃ Lanius vittatus। এরা ‘লালচে-পিঠ কসাই’ নামেও পরিচিত। এরা দৈর্ঘ্যে কমবেশি ১৭-১৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২০-২৮ গ্রাম। কপাল কালো। মাথা ফিকে ধূসর, ঘাড় গাঢ় ধূসর। পিঠের মধ্যখানটা তামাটে বাদামি। পাশের দিকে কালোর ওপর সাদা ছোপ। লেজ কালো। গলা সাদাটে। দেহতল বাদামি সাদা। স্ত্রী পাখির কপালের কালো অংশটুকু সরু। উভয়ের চোখ বাদামি। কালচে বাদামি। পা ময়লা কালচে। প্রধান খাবার ফড়িং, পঙ্গপাল, ঝিঁঝিঁ পোকা, টিকটিকি ইত্যাদি। অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি। ভারত ছাড়া বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও তুরস্ক পর্যন্ত। বিচরণ করে আবাদি জমি, বনপ্রান্তরের খোলা মাঠে এবং ঝোপ-জঙ্গলের কাছাকাছি এলাকায়। পতঙ্গ শিকারের উদ্দেশ্যে এতদস্থানে ওড়াউড়ি করে। এছাড়াও বাঁশের খুঁটি কিংবা গাছের ডালে বসে শিকারের প্রতীক্ষায় সময় কাটায়। স্বভাবে হিংসুটে। স্বজাতির কেউ নিজ সীমানার কাছাকাছি এলে সহ্য করতে পারে না, চেঁচিয়ে বিদায় করে। আমার প্রথম দেখা এই পাখি জলদাপাড়া অভয়ারণ্য ভ্রমণের সময়। সেও এক ব্যাপার। জলদাপাড়া টুরিস্ট লজে অপরাহ্ণে ভোজনালয় বসে আহার সারছি, এমন সময় কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখি দূরে এক গাছে একজোড়া ইন্ডিয়ান বে-ব্যাকড শ্রাইক সমানে উড়ে উড়ে কিছু একটা শিকার ধরার চেষ্ঠা করে যাচ্ছে। ক্যামেরা চোখে দিয়ে দেখি এক নিরীহ কাঠবিড়ালিকে তাড়া করে খুঁচিয়ে চলেছে। পরে দেখতে পেলাম, জীবটি কোনও প্রকারে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছে। তবে সেই পাখি কিন্তু ইতিমধ্যে আমার লেন্সবন্দি হয়ে গিয়েছিল, অবশ্য তাদের অসফল শিকার প্রচেষ্টার পর।
লং টেইল শ্রাইক অথবা মেটে লাটোরা একমাত্র এই অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা। প্রায় গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই চোখে পড়ে। তবে এরা কেবল শীতকালেই দেখা যায়। এদের বিচরণক্ষেত্র মূলত কৃষিক্ষেত, চারণভূমি, ঘাসজমি, ঝোপঝাড়, হালকা বাগান আর জলার গাছগাছালি। যেহেতু এরাও কসাই পাখির পর্যায় পড়ে তাই বেশ সাহসী, একা একা কিংবা জোড়ায় থাকে। অন্যান্য কসাই পাখিদের মতন এরাও হিংস্র প্রকৃতির হয়। নিজের বিচরণক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতনভাবে ঘোরাফেরা করে। এর মাথায় কালো হুড। পিঠের ওপরভাগে ও কোমর গেরুয়া-কমলাটে। গলা ও বুক ধবধবে সাদা। ডানা ও লেজ কালো। কপাল থেকে চোখ বরাবর কালো চওড়া পটি। মাথার চাঁদি থেকে ঘাড় ছাই-ধূসরাভ, ক্রমশ পিঠের দিকে ফিকে গেরুয়া-কমলা। ভাবতেও অবাক লাগে যে এত সুন্দর এই পাখিটি এতটা হিংস্র হতে পারে।
জিম করবেট টাইগার রিজার্ভে আমার গাইড ছিল রশিদ নামের এক যুবক। অত্যন্ত চৌকশ ও তৎপর। শুধু তাই নয়, জঙ্গল সম্পর্কে ওর জ্ঞান অনেকটাই। এমন কোনও পাখি নেই যার নাম ওর অজানা নয়। কেবল তাই নয়, ও ওদের সকলের বিচরণক্ষেত্র, খাওয়ার অভ্যাস, প্রজননের সময় সব জানে। যখন যেই পাখি দেখতে চেয়েছি ও ঠিক সঠিক জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাকে পাখি দেখাতে সক্ষম হয়েছে। বিজরানিতে আমি দেখতে পাই লং টেইল শ্রাইক। তখন ও কাছেই ছিল, আর আমাকে পাখির নাম বলে দিল। আমাকে পরে ও সাথে করে রেস্ট হাউসের আরেক দিকে নিয়ে গিয়ে দেখাল ইন্ডিয়ান গ্রে শ্রাইক / সাউদার্ন গ্রে শ্রাইক।
আজব এই জীবজন্তুদের দুনিয়া। ঠিক যেন মানুষেরই মতন। অথচ আমরা শিক্ষিত, সমাজে বসবাস করি, কিন্তু মাঝে মধ্যে এই শ্রাইকদের মতন কেমন যেন হিংসুটে ও হিংস্র হয়ে উঠি। নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য কারুর ক্ষতি করে দেওয়ার চিন্তাও করি। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম মেনে পশুপাখিরা কেবলমাত্র ক্ষুধা মেটানোর তাগিদেই অন্য জীবের ক্ষতি করে। মাঝে মাঝে কচিকাঁচারা হাতে গুলতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পাখি শিকার করতে। একটা পাখি নিশানায় লেগে গেলে এতেই ওদের আনন্দ। আর আমরা, অর্থাৎ বড়োরা আনন্দ পেয়ে থাকি এদের আবাসস্থল কেড়ে নিয়ে। আমার বাড়ির খুব কাছেই একটা ঘাসভূমি আছে। সেখানে প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখির বসবাস, যার মধ্যে লং টেইল শ্রাইক ও শীতের সময় অন্যান্য শ্রাইকও দেখা যায়। তাছাড়া আরও অনেক পাখি রয়েছে এখানে। শোনা গেছে এই ঘাসভূমি হস্তান্তর হতে চলেছে। পরবর্তীকালে এখানে হয়তো বড়ো কোনও ইমারত খাড়া হয়ে যাবে আর ধ্বংস হয়ে যাবে বহু পাখিদের আবাসস্থল। সাথে সাথে আমরা হারাব বহু পরিযায়ী পাখির আনাগোনা, যেরকম শ্রাইক। এরকম জলাভূমি, ঘাসভূমির জন্য এখানে বেঁচে আছে প্রকৃতি। এরা নষ্ট হলে শেষ হবে জীবজন্তুদের প্রাকৃতিক পরিবেশ। আর এরকম হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রকৃতির এই অপূর্ব উপহার দেখতে না পেয়ে বঞ্চিত হবে। সে জন্যই পরিযায়ী পাখিদের আসা যাওয়া যাতে বন্ধ না হয় আমাদেরকেই সচেষ্ট হতে হবে বনভূমি, ঘাসভূমি ও জলাভূমি রক্ষা করার জন্য। এ এক নেশার মতন, যত ঘুরে ঘুরে পাখি দেখব ততই এই নেশা চেপে বসবে। আর যত বেশি মানুষ প্রকৃতির নেশাগ্রস্ত হবে ততই আমাদের পৃথিবীর জন্য মঙ্গল।
ছবিঃ লেখক