ভারতের বনাঞ্চল-আগের পর্বগুলো
পূর্ব হিমালয়ের বায়োডায়ভার্সিটি হটস্পটে পশ্চিমবঙ্গ
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের কিছু বনাঞ্চল পূর্ব হিমালয়ের বায়োডায়ভার্সিটি হটস্পটের আওতায় পড়ে। তার মধ্যে অন্যতম সংরক্ষিত এলাকা হলো নেওরা ভ্যালি জাতীয় উদ্যান। তাছাড়াও অন্যান্য এলাকার মধ্যে রয়েছে জোড়পোখরি অভয়ারণ্য, সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান এবং মহানন্দা অভয়ারণ্য।
এই সমস্ত সংরক্ষিত এলাকার একে অপরের থেকে ভৌগোলিক দূরত্ব অনেক নয়। কিন্তু সমুদ্রতল থেকে এদের উচ্চতার তারতম্য অনেক। সেই কারণে আবহাওয়ার তারতম্যও প্রচুর। ফলে মাটির ধরণ এবং জঙ্গলের ধরণও অনেক আলাদা। ফলে জীববৈচিত্র্য প্রচুর কিন্তু তা সংকীর্ণ ভৌগোলিক এলাকায় সীমাবদ্ধ।
যেমন ধরা যাক জোড়োপোখরি অভয়ারণ্যের কথা। এখানে মূলতঃ আর্দ্র পর্ণমোচী বৃক্ষ দেখা যায়। তার মধ্যে সদ্য জেগে ওঠা নদী চরে যেমন দেখা যায় খয়ের গাছ, তেমনই গভীর মৃত্তিকাস্তরের বুকে দেখা যায় শাল গাছের বন। শালের সাথে পাওয়া যায় হলদু আর গামারও। জল বেশি যেখানে সেখানে দেখা যায় সিধা, জারুলও। আর দেখা যায় ভীষণ মোটা থেকে ভীষণ সরু নানা জাতের বাঁশ ঝাড়। এখানে বনে হাতির সংখ্যা প্রচুর। এই বনের হাতিরা মেচি নদী পেরিয়ে প্রায়শয়ই নেপাল থেকে ভারতে আসে বা ভারত থেকে নেপালে যায়। যখন যেখানে খাবার পাবে বলে আশা করে, তখনই সেখানে যায়। যাওয়ার পথে পড়ে চা বাগান। ফলে চা বাগানের মানুষজনের সাথে হাতির বিরোধ এখানে নিত্য অশান্তি। তাছাড়া এখানে নানান প্রজাতির প্রজাপতি, তাহ্র, চিতল এসবও দেখা যায়।
আবার সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান হলো রডোডেনড্রনের অভয়ারণ্য। নানান প্রজাতির রডোডেনড্রন ফোটে এখানে মার্চ, এপ্রিল মাসে। মূলতঃ লাল রডোডেনড্রেন বেশি চোখে পড়লেও, সাদা বা বেগুনীর দেখা পাওয়া দুষ্কর নয়। অর্থাৎ এই জাতীয় উদ্যান ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বৃক্ষের আবহাওয়ার উপযুক্ত। তার কারণ সমুদ্রসমতল থেকে এর উচ্চতা। রডোডেনড্রন ছাড়াও এখানে মাঝে মাঝেই দেখা যায় ঘাসে ঢাকা উপত্যকা। অন্যান্য গাছেদের মধ্যে ওক, চাঁপা আর ম্যাগনোলিয়া দেখা যায় অনেক পরিমাণে। ঘনবনের মধ্যে প্রচুর রঙীন লাইকেনের দেখাও পাওয়া যায়। তাছাড়া এখানেই বাস ছিল রেড পান্ডাদের। কিন্তু চিতার আক্রমণে সিঙ্গালীলার বুক থেকে হারিয়ে গেছে এই প্রজাতির শেষ প্রাণীটিও। এখন দেশে, বিদেশের চিড়িয়াখানায় রেড পান্ডা থাকলেও, তাদের আদত বাসস্থল সিঙ্গালীলার বনে আর তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সুতরাং উদ্ভিদ কিংবা প্রাণী বৈচিত্র্যে জোড়পোখরির থেকে সিঙ্গালীলা একদমই আলাদা।
তবে মহানন্দা অভয়ারণ্যের সাথে জোড়পোখরির বেশ মিল আছে। মহানন্দাতে প্রাণী বৈচিত্র্য জোড়পোখরির প্রাণী বৈচিত্র্যের তুলনায় অনেক বেশি। এখানে হাতি ছাড়াও প্রচুর, ভালুক, চিতা, গাউর, চিতল, মুন্টজ্যাক, সম্বর, আর বাঁদর দেখ যায়। দেখা যায় ভাম জাতীয় বনবিড়ালও।
নেওরা ভ্যালি জাতীয় উদ্যান আবার উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে অন্য তিনটি সংরক্ষিত এলাকার সংকলনের মতো। এই উদ্যান্যের সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা নানান অংশে এত আলাদা যে এখানে যেমন ক্রান্তীয় রডোডেনড্রেন দেখা যায়, তেমনই দেখা যায় পর্ণমোচী শাল। বাঁশ ঝাড়, ফার্ণ আবার ওক গাছও। জীবজন্তুর মধ্যেও যেমন আছে রেড পান্ডা, তেমনই আছে গাউর, চিতল, মুন্টজ্যাক, সম্বর, তাহ্র, ভাম জাতীয় বনবিড়াল। আবার নানান প্রজাতির ভালুক, উড়ন্ত কাঠবেড়ালী, বুনো শুয়োর এসবই নেওরা ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের নিজস্ব বৈচিত্র। এখানে পাখির বৈচিত্র্যও প্রবল। নানান প্রজাতির কাঠঠোকরা, প্যাঁচা, কোকিল, পায়রা বাজ, ছাতারে, বাঁশপাতি, বুলবুল, ফিন্চ ছাড়াও আরও অনেক রকম পাখি দেখা যায়।
এই সব বায়োডায়ভার্সিটি হটস্পটের বাইরেও আরও বিচিত্র বন আছে ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের ম্যানগ্রোভ বন হলো পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন যেখানে বাঘ থাকে। জানা যায় না যে অন্যত্র ম্যানগ্রোভ বনে বাঘ ছিল কিন্তু লুপ্ত হয়ে গেছে কিনা। প্রকৃতির আরও অনেক খবর জানতে এখনও অনেক বাকি। এক প্রজাতির লোপ যেমন হয়েছে তেমনই এক বছরে পনের হাজার নতুন প্রজাতির সন্ধানও পাওয়া গেছে এই সহস্রাব্দেই। প্রকৃতি সদা পরিবর্তনশীল। সেখানে পরিবর্তনের সাথে খাপ না খাওয়াতে পারলে অবলুপ্তি অনিবার্য। সেই অনিবার্যকে স্বীকৃতি না দিতে পারলে প্রকৃতি পাঠ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।