আগের পর্বগুলো
ছাগল আর ভেড়া
পিয়ালী চক্রবর্তী
ভগবানের নামে শিশুবলি
পরে অনুতাপের গরল,
শেষে আমার রক্তে পাপ ধুলো সব
আমিই ছিলাম সরল।
সকল পাপীর পাপের বোঝা
আমার তো নেই হায়,
তবুও আমিই স্বর্গে গেলাম
একলা অসহায়।
আমিই ভগবানের ভেট
মানুষের দায় কমে,
আমার জন্য খাঁড়ার ঘা
ঈশ্বরের পীঠস্থানে।
“এমন কোনও বাড়ি নেই, যেখানে একটি ছাগলকে বিদায় জানানোর ইচ্ছা না রেখেই প্রতিপালন করা হচ্ছে, অথবা তিনটি ছাগলকে পালন করা হচ্ছে যেখানে রোজ রাতে দেবদূতরা তাদের জন্য প্রার্থনা করে না।” মহম্মদ বলেছিলেন একথা।
ভারতের পশুপাখিদের যদি মানুষের মতো একটা করে ধর্ম থাকত, তাহলে ছাগলরা ইসলাম ধর্মের হত। কারণ, বেশিরভাগ হিন্দুরা ঘরে ছাগল পোষে তার মাংস খাবার জন্য, আর মুসলমানরা পোষে তাদের বড়ো করে ব্যবসা করার জন্য। এদের বাইরের চেহারার বিশেষত্বটাও তেমনই। ব্রাহ্মণী ষাঁড়কে দেখলেই প্রতি ইঞ্চিতে হিন্দু মনে হবে, কিন্তু ছাগলের চিরাচরিত চোখের চাউনি, একেবারে মুসলিমদের মতো।
প্রচুর পরিমাণে পুরুষ ছাগলকে প্রতিবছর কালীপুজোতে বলি দেওয়া হয়। কালী হলেন দেবী দুর্গার এক রূপ। আর একটা ধারালো খাঁড়ার মতো ছুরি দিয়ে তাদের মাথা কেটে নেওয়া হয়। এইভাবে কাটা প্রাণীই বোধহয় হিন্দুদের খাবার জন্য উপযুক্ত। একসময় তৎকালীন রাজপুতানার রাজধানী জয়পুরের আমের কেল্লা সংলগ্ন মন্দিরে ছাগল বলি দেওয়া হত। আবার অন্য জায়গায় নিয়মিত মানুষের আত্মত্যাগের বদলে ছাগল বলি দেবার প্রথা চলত। ভারতের কিছু অংশে হিন্দুদের মধ্যে একটা প্রচলিত কথা হল ‘’ছাগল নিজের ল্যাজ নিয়েই আসে’। এই কথাটার সাথেও বলি দেওয়ার যোগ আছে। ছাগলের শরীরের প্রত্যেকটা অংশ ভগবানকে অর্পণ করা হয়। লেজের দিকটা নাকি বিষ্ণুর আর সেই একমাত্র প্রাণীটিকে বাঁচাতে পারে। তাই লেজটা আগে কেটে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তাতে কিনা ছাগলটা উদ্ধার হয় আর তাকে মারার দোষ কেটে যায়। মুসলমানরাও যখন হালাল করে, তখন ছাগলটাকে মারার পাপক্ষয় করতে তারা প্রার্থনা করে। কিছু মুসলিম একটি শিশু জন্মানোর পরে ছাগল কাটে। আবার কোনও শিশু অসুস্থ হলেও ছাগলের গলা কেটে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়।
বলিদান
আমরা উপহাস করে বলি ‘যখন শয়তান অসুস্থ ছিল’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ভারতে বলা হয় ‘সবকিছু নিরাপদে মিটে গেলে পাঁঠা বলি দেব’। গল্পটা এরকম যে, মিও, এক বিশেষ উপজাতির মানুষ যারা গঙ্গার সেই অংশের পাড়ে থাকে যেখানে খুব কুমির। তাই সে যখন প্রবল বন্যায় গঙ্গা পার হচ্ছে, সে ভগবানের কাছে আর্জি জানায় যে ঠিকভাবে পার হলে পাঁঠা বলি দেবে। কিছুদূর যাবার পর সে যখন বোঝে, যে এইখানে বিপদ কম, তখন সে বলে কুমির নয় সে একটা মুরগি দেবে। যখন সে প্রায় পার হয়ে এসেছে, কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই, সেইসময় তার জামায় একটা পোকা বইতে দেখে সে সেই পোকাটাকে ধরে মেরে ফেলে আর বলে ‘জীবনের জন্য জীবনের বলিদান’।
পাঞ্জাবের পার্বত্য জেলাগুলি এখনও সেই পুরনো মতবাদে বিশ্বাসী যে এই বলিদান সার্থক হয় না, যতক্ষণ না পশুটি থরথর করে কাঁপবে। সেখানকারই কোনও এক মোড়লের বিয়েতে, সেটার ওপর, বিপদসঙ্কুল বাঁকের মুখে ছাগল বলি দেওয়া চলছিল। এমনকি ট্রেন অবধি অপেক্ষা করেছিল কতক্ষণে পশুটি কাঁপবে। ব্রাহ্মণরা ব্যাপারটা আরও তাড়াতাড়ি করতে ছাগলের কান দিয়ে ঠান্ডা জল ঢেলে দেয়। ব্যস, সে ভীষণ কাঁপতে থাকে। একবার কুলুতে, তিব্বতের সীমানায় একটা পাহাড়ি প্রদেশ, সেখানে দু’জন মানুষের মধ্যে প্রচন্ড মতান্তর হয় এবং তারা একে অন্যের নামে মামলা করে। তারপর তারা ওখানকার বড়ো শহর নুগগুরে গিয়ে ছাগল বলির ব্যবস্থা করে। দুটো পশুকেই একসাথে বলি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। যে আগে কাঁপবে, তার মালিক মামলা জিতবে। আর তারপর এই মামলা জেতার সুবাদে তাকে আইনজীবীকেও কোনও দক্ষিণা দিতে হবে না। তবে এক্ষেত্রে তারা ওই ঠান্ডা কিছু বাইরে থেকে ঢালেনি।
যতদূর আমি জানি, এই ছাগলদের কেঁপে ওঠার বিশ্বাসটা শুধুমাত্র পাহাড়ি অঞ্চলের বিশ্বাস। তিব্বতে বিশেষ করে এটাকে খুব বেশি মানা হয়। সাম্প্রতিক সিকিম যুদ্ধে এই ব্যাপারটা নাকি ভয়ংকর প্রভাব ফেলেছিল, যখন সিকিমের রাস্তার চাম্বি পাশের ওপর তিব্বত থেকে আমাদের দলের ওপর হামলা চালানো হয়।
ছাগলের মাংস মুসলমানদের একটা প্রধান খাদ্য। এমনকি ভারতের উত্তর অংশের হিন্দুদের কাছেও তাই। এমন ভাবা হয় যে, যখন পাশ্চাত্য সভ্যতায় নিরামিষাশী হবার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল তখনই ভারতে ছাগল, ভেড়া খাবার প্রচলন শুরু হয়। এমনকি নিরামিষাশী খাবার ছেড়ে আমিষ খাবারের চল শুরু হয় যা ব্রাহ্মণরাও শুরু করেছিলেন। যে অঞ্চলকে হিন্দুস্তান বলা হত, পাঞ্জাব লাগোয়া সেইসব অঞ্চল যেখানে মুসলিম প্রাধান্য বেশি ছিল, সেখানে এই মাংস খাবার প্রবণতা বেড়ে যায়। যদিও হিন্দু পুরুষেরাই মূলত খেত, হিন্দু মহিলারা প্রায় খেতেন না বললেই চলে। মাংস এবং আরও কিছু খাবার মহিলাদের ক্ষেত্রে খুব বেশি শক্তিশালী এবং বেশি ভালো বলে তাদের খেতে দেওয়া হত না। আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়তো এই প্রবণতার একটা অন্যতম কারণ ছিল। আবার কিছু বিশেষ কারণও ছিল। যেমন এক ভারতীয় আমায় বলেছিল, ‘তোমরা ইংরেজরা বেশি জ্বরে ভোগো না, কারণ তোমরা মাংস খাও’ আর ‘তোমাদের চোখের দৃষ্টি খুব ভালো, কারণ তোমরা প্রচুর মাংস খাও’। এই শেষেরটা হয়তো বা মাংসাশী পাখিদের দেখে মনে হয়েছে। এছাড়াও একটা প্রবাদ আছে যে, একজন কসাইয়ের কন্যা একটি পুত্রধারণ করেছিল দশ বছর বয়সে। সেই উড়নচন্ডী ছেলের এক দাদা আবার অভিযোগ করেছিল যে নাকি তার বাবা কোনওদিন তাদের হাতে একটা বাচ্চা ভেড়াও দেয়নি যা নিয়ে তাদের বন্ধুদের সাথে মজা করতে পারে। এইসব আমাদের মতো শহুরে পাশ্চাত্য মানুষদের কাছে এইসব একটু আজব লাগতে পারে, কিন্তু এদের কাছে এসব রোজের গল্প। যেসব চাকররা একপাল ছাগল নিয়ে বেড়াতে যায় তাদের খুশি করবার জন্য, তারাই আবার রমজানের সময় সেই ছাগল কেটে রক্তে লাল করে ফেলে সবকিছু। ভারতে থাকা ইংরেজরা বিশেষ ছাগল বা ভেড়া খায় না। কারণ, খুব প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে তারা যে কাটলেট খেতে পেত তা আসলে ছাগলের মাংসের। কিন্তু তারা ছাগলের থেকে ভেড়া পছন্দ করে বেশি। কারণ, ছাগল শুধু ঘাসপাতা খায়, অন্যদিকে একটা ক্ষুধার্ত ভেড়া যা পায় তা খেয়ে নেয়।
একটা ছাগলের প্রতি নিষ্ঠুর হওয়াটা বেশ কঠিন মনে হয়। তবুও ভারতের শহরগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে চরে বেড়ানো দুগ্ধবতী ছাগলরা সারাদিন ধরে প্রচুর যন্ত্রণা সহ্য করে। ওদের স্তনবৃন্তগুলো বেঁধে দেওয়া থাকে। আর সবচেয়ে কষ্টকর হল, জীবন্ত অবস্থায় ওদের গা থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া এই বিশ্বাসে যে আবার ভালো মানের চামড়া তৈরি হবে। কলকাতার পশু নির্যাতন সুরক্ষা সংঘ প্রায় বাইশজনকে এর জন্য গ্রেপ্তার করেছিল ১৮৯০তে। আশা করে যাচ্ছে বাংলার রাজধানীতে অন্তত এই যন্ত্রণার উপশম হবে।
অলংকরণঃ জন লকউড কিপলিং
বনের ডায়েরি সব পর্ব একত্রে