আগের পর্বগুলো
ওদের দৈনন্দিন জীবনটাও একটা দেখার মত ব্যাপার। ওদেরও বেশ একটা পিতৃশাসিত সংগঠন থাকে,কিছুটা সেনাদের আদবকায়দায়। আসলে ওরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে যায়, আর প্রত্যেকটা দলের যে সেনাধ্যক্ষ থাকে, সে দেখতে বেশ বড় আকারের, চওড়া কাঁধ, কুকুরের মত দাঁত গজায়, আর এই কারণেই কিছু হিন্দু চিত্রকার এদেরকে হনুমান বলে থাকে। এরা দলের অল্পবয়স্ক পুরুষদের সাথে নিষ্ঠুরভাবে লড়াই করে দলে নিজেদের জায়গা পাকা করার জন্য, আর অবাধ্য মেয়ে বাঁদরদের নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্য। এইরকম নেতাদের আমরা ‘দানব’বলে জানি। এরা সবসময় রেগে থাকে, আর কিছু হলেই এদের রাগবর্ষণ শুরু হয়ে যায়, আর এরা জঘন্য ভাষা ব্যবহার করে। এরা দলের মধ্যে যেকোন কিছুর সিংহভাগটাই নেয় যাতে উঠতি তরুণ সদস্যরা বেশি করে বিরক্ত হয়। মা আর বাচ্চাদের একটুখানি ভাগ দেয়, আর সবসময় মারপিট করে অন্যদের সাথে যারা ওর প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠতে পারে। পাহাড়ি জায়গায় প্রায়ই এরকম মারপিট দেখা যায়। মানুষেরা তাই এদেরকে ‘মহারাজা’ বলে ডাকে। কারণ এইরকম অসভ্য, স্বৈরতান্ত্রিক, লালমুখো হনুমানদের দেখলে অনেকটা সেই পুরাকালের নিষ্ঠুর রাজাদের কথা মনে পড়ে।
আর এইসব মহারাজাদের মত, এদেরও খুব দুঃখের কাহিনীও থাকে কিছুটা প্রেম,ভালবাসা সম্পর্কিত। এই যেমন এক সকালে এক হনুমান এসে হাজির হল, দেখেই বোঝা যায় খুব আহত হয়েছে। খোঁড়াচ্ছে, একটা হাত একপাশে ঝুলে রয়েছে, নাড়ানোর শক্তি নেই, চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে ভীষণ মারামারি করে আহত হয়েছে। এমনকি সে নিজেও হাঁটাচলা করতে পারছে না। একটি মেয়ে বাঁদর, ওর স্ত্রী, তার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছে। এই অবস্থা দেখে আমরা ওদের কিছু পাঁউরুটি আর খাবার ছুঁড়ে দিলাম। অমনি হনুমানটা তার বড় ভাগটা নিয়ে, যে হাতে জোর পাচ্ছে সেটা দিয়ে মুখে পুরতে যাচ্ছিল।
কিন্তু জান তো, সক্কলের দিন আসে। তা মেয়ে বাঁদরটা করল কি, হনুমানটার হাত শক্ত করে চেপে ধরে, খাবারের টুকরোটা কেড়ে নিয়ে একটা নিরাপদ দূরত্বে চলে গেল। আর তারপর হনুমানটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেতে লাগল। বেচারা হনুমান, তার এমন অবস্থা যে বৌয়ের সাহায্য না পেলে সে বাড়িও যেতে পারবে না। তাই সে ধৈর্য ধরে বসে রইল যতক্ষণ না তার বৌয়ের খাওয়া শেষ হয়। আমি দেখলাম মেয়ে বাঁদরটা এই ব্যাপারটায় দারুণ মজা পেল,হয়ত তার জীবনে প্রথমবার এমন সুযোগ পেল, আর প্রতিশোধও নেওয়া হল। তারপর আবার সে হনুমানটাকে ছেড়েও চলে গেল। হয়ত তাকে শেখাতে চাইল, যে সে যাতে একটু নম্র স্বভাবের হতে পারে।
মা বাঁদরেরা বাচ্চাদের ব্যাপারে খুব নরম হয়, খুব যত্নশীল,যতটা একজন মা, বাচ্চাদের জন্য হতে পারে। আসলে ওদের বাচ্চাগুলো জন্মায় খুব ছোট, বাদামী লোমে ঢাকা, ওদের মুখগুলো ছোট,ভাঁজ খাওয়া চামড়া, আর ভয়ার্ত অসহায় দুটো চোখ, আর তারা যখন কাঁদে, মনে হয় হারিয়ে গিয়ে আর্তনাদ করছে। এমনকি বনেও তারা বাচ্চাদের চোখে চোখে রাখে। একবার আমি দেখেছিলাম একটা মা বাঁদর মাটিতে খেলছিল,আর তার বাচ্চাটা পাশের গাছটাতে অর্ধেকটা বেয়ে উঠে, বাকিটা আর পারছিল না, সমানে ঘ্যান ঘ্যান করছিল। শেষ অব্দি মাটা বিরক্ত হয়ে, গাছে চড়ে, বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে একদম গাছের মাথায় চড়ল, তারপর বাচ্চাটাকে রেখে, একটু বকে দিয়ে, আবার নিচে নেমে খেলতে লাগল।
লোকেরা বলে যে, যখন নাকি বাঁদরের বাচ্চা মারা যায়, ওদের মায়েরা একপ্রকার পাগল হয়ে যায়, আর ওই মৃত বাচ্চাটাকে বুকে আটকে রাখে। এমনও হয় যে ওরা কয়েক সপ্তাহ অব্দি ওই মৃতদেহ নিয়েই ঘোরে, আর দেহটাকে শুকিয়ে নেয়। ওরা মৃত বাচ্চাটারও এমন যত্ন করে যেন সে বেঁচে আছে। এরা নিজেদের বাচ্চাকে রক্ষা করতে সাঙ্ঘাতিক লড়াই করতে পারে। আমার একটা টেরিয়র কুকুর ছিল, যাদের স্বপ্নই হয় বাঁদরকে ধরা। একবার আমি বাড়ির ভিতরে ছিলাম, পরে একজন লোক যে দেখেছিল ঘটনাটা, তার মুখে শুনেছিলাম, যে কুকুরটা আধ মিনিটের জন্য একটা বাচ্চা বাঁদরকে ধরেছিল। এরপর কুকুরটা বাড়িতে পালিয়ে আসে, আর চেয়ারের তলায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। ওর চুপ করে থাকা দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ওর সাথে কিছু হয়েছে, আসলে মা বাঁদরটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনবার এমন কামড়ে দেয়, যে ছুরি দিয়ে কাটার মত ধারালো ক্ষত হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস সেলাই করার সরঞ্জাম ছিল বলে, বব সে যাত্রা বেঁচে গেল আর বাকি জীবন বাঁদরদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকত।
আর একবার এই বাঁদরদেরকে কাছ থেকে দেখেছিলাম, যখন কিছু পোষা বাঁদর আর একটা ছাগল নিয়ে এক বাঁদরওয়ালা এসেছিল নাচ দেখাতে। ছাগলটা এই বাঁদরগুলোকে নাচতে উতসাহিত করত। এদের দেখে প্রথমে বন্য বাঁদরগুলো খুব সন্দেহজনক ভাব দেখিয়ে দূর থেকে দেখতে লাগল, তারপর যেই বাঁদরওয়ালা একটা ডুগডুগি বাজিয়ে অদ্ভুত ভাবভঙ্গী করতে শুরু করল ছাগলটাকে সামনে রেখে, আর অমনি পোষা বাঁদরগুলো নাচতে শুরু করল। আর এই বন্য বাঁদরগুলোর তখন কি কৌতূহল। তারা একটু একটু করে এগিয়ে দেখতে লাগল। অবশ্য এই পোষা বাঁদরগুলোও ওদের নাচের শেষে, ওদের মালিকটাকে আর পাত্তাও দিল না। যদিও নাচের সময় ওদের মালিকও ওদের দিকে তাকায় না, আর ওরা এমন হিংস্র আর রাগী চোখে দেখতে থাকে, যেন ধর্মঘটের সময় যে শ্রমিক কাজ করে, তাকে বাকিরা যেমন করে দেখে, ঠিক তেমন।
শীতের সময় একটা বাঁদরদের আচরণে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ওরা মুদি দোকানে চুরি করার বদলে, সকলে মিলে একসাথে এসে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাত পেতে ভিক্ষা করে। এটা সিমলাতে দেখেছিলাম। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, আর ওরা বাধ্য হয় এমনটা করতে। কারণ এরকম বন্য আর দুষ্টু প্রাণীর কাছ থেকে এমন ব্যবহার কল্পনা করা যায়না। কিছু দোকানদার অবশ্য অভ্যাসবশত ওদের খেতে দেয়, তবুও ওরা দল বেঁধে ঘুরতে থাকে ভিক্ষা পাবার আশায়। একটা শান্ত, করুণ, সতৃষ্ণ ভাব দেখা যায় এই বড়, পরিণত বাঁদরগুলোর মধ্যে। যদিও হঠাত করে নতুন কিছু ঘটলে এরা বেশ চেগে যায়, আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। অনেক প্রাণীকে দেখা যায়,অনেকক্ষণ বসে এদের দিকে তাকিয়ে থাকতে, কিন্তু একমাত্র পাখিই উঁচু থেকে এদের অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করতে পারে। মানুষের মধ্যে মাঝি-মাল্লা বা কিছু পুরোন মানুষের মধ্যে এইরকম শান্ত একটা চেহারা দেখা যায়। কিন্তু বাঁদরদেরতো খুব কঠিন জীবন, ক্ষুধার্তের জীবন,ওরা অসহায়ভাবে বৃষ্টিতে ভেজে, গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে, ওরা ঝড়ের হাত থেকে বাঁচে। ওদেরও ঠান্ডা লাগে, কষ্ট হয়। বৃষ্টিভেজা রাতে,ঘন বনের অন্ধকার থেকে ওদের কাশির আওয়াজ আসে। আবার যখন সূর্য ওঠে,বাচ্চাগুলো খুব খেলে অনেকটা স্কুলের বাচ্চাদের মত। ওদের খেলাগুলো সেই ইংরেজ বাচ্চাদের মুরগি ধরা, বা প্রাসাদের রাজার খেলার মত। তবে এখানে একজনকে পাহাড়ের টিলা, বা নোংরার স্তূপের ওপর থেকে ফেলা নয়, একটা ফলভরা ডাল, যেটা দুলছে,তার ওপর বসে ঠেলাঠেলি করে একে অন্যকে। যে পড়ে যায়, সে আবার উঠে তরতরিয়ে গাছে চড়ে। এই দারুণ মজার খেলা প্রায় একঘন্টা ধরে চলে, আর সবচেয়ে দ্রুত যে কাজটা করে, সে সবচেয়ে আনন্দ পায়।
ক্রমশ