উমা ভট্টাচার্য -র সব লেখা একত্রে
নাকুরু

উমা ভট্টাচার্য
এটা, জিম্বাবুয়ের পথ। সেখানে প্রধান দ্রষ্টব্য বিশ্বের সর্বপ্রধান জলপ্রপাত দ্য গ্রেট ভিক্টোরিয়া ফলস। এর আগে ঘুরে এসেছি মাসাইমারা গেম রিজার্ভ, আর নাকুরু লেক নাকুরু অভয়ারণ্য। পথে গাড়ি থেকে দেখা এই নগ-বাহাদুরের নাম অজানা ছিল তখনও।
প্রকৃতি এখানে ধূসর নয়, সবুজের কার্পণ্য নেই, পৃথিবীতে একমাত্র আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ তৃণদল বা দুর্বাঘাস এখানে সবুজ, মাসাইমারার অরণ্যভূমির মত শুকনো, হরিতাভ নয়। মাসাইমারার অরণ্যভুমি সাভানা জাতীয়। বড় গাছ মানে বৃক্ষ নেই সেখানে, কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড়, আছে অ্যাকাশিয়া জাতীয় গাছের প্রাচুর্য। সাভানা ঘাসে আবৃত বিশাল প্রান্তর। তবে সে ঘাসও সেখানে খানিকটা খড়ের মত রঙের। সেই ঘাসই সারাদিন ধরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে চিবিয়ে চলেছে হাতি, হরিণ সব তৃণভোজিই।
তবে সেখানে যাবার আগে ঘুরে নিয়েছিলাম নাকুরু অভয়ারণ্য- এক রাত ছিলাম নাকুরুর একটি রিসর্টে। সাউথ আফ্রিকার কেনিয়ার সেই নাকুরু ন্যাশনাল রিজার্ভ দেখার কথাই লিখছি আজ।
যেদিন নাকুরু পৌছেছিলাম সেদিন সকালের প্লেনে নাইরোবি পৌঁছেছি। স্থানীয় সময় সকাল ৮ টা নাগাদ এয়ারপোর্টএ পৌঁছে আমরা বেরোলাম লাগেজ নিয়ে। হোটেলে যাব না আমরা, আমাদের বেড়াবার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা নাকুরু আর মাসাইমারা মিলিয়ে কাটাব চারদিন। চতুর্থ দিন আমরা আবার ফিরব নাইরোবিতে। একরাত সেখানে কাটিয়ে প্লেন ধরব জিম্বাবুয়ের উদ্দেশ্যে, যে ছবি দিয়ে শুরু করেছি এই লেখা।
আসি প্রথম দিনের ভ্রমণ দিয়ে। সেদিন মুম্বাই থেকে ভোরের ফ্লাইট ধরে নাইরোবি পৌছেলাম। বিশাল বোয়িং-এর পেট থেকে বেরিয়ে আসা যে কত সময়সাপেক্ষ আর বিরক্তিকর সেটা অন্যান্য বারের মত এবারও টের পেলাম। একে তো আগের দিন বিকেলে কোলকাতা থেকে প্লেন ধরেছি, আড়াই ঘন্টার মধ্যে মুম্বাই পৌঁছে, লাগেজ নিয়ে বেরোতেই কেটে গেল ঘন্টা। রাত তখন ১১টা বেজে গেছে। বেরিয়ে দেখি ও বাবা, এখন নাকি আবার ডোমেস্টিক থেকে ভিতর দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে যাওয়া যাচ্ছে না। মে মাসে ইজিপ্ট টার্কি যাবার সময় এই নিয়মটা ছিল না। শুনলাম ডোমেস্টিক থেকে বেরিয়ে বাইরে প্রিপেড ট্যাক্সি নিয়ে ‘ ঘুরিয়ে নাক ধরা’র মত যেতে হবে পাশের বাড়ি – ইন্টারন্যাশনাল বিল্ডিংএ। ট্যাক্সিচালক ছেড়ে দিল গন্তব্যে,এত গাড়ির ভিড়ে সে আর বেশি এগোতে পারল না।
যাক লাগেজ রাস্তায় রেখে খানিক দূরে ট্রলির জন্য যেতে হবে। লাগেজ হাপিশ হলেই বিপদ। লাঠি, আর দুটো ব্যাগ নিয়ে এগোচ্ছি বেশ কষ্ট করে, ব্যাগ টেনে ফুটপাথে উঠতে একটু কসরত করতে হচ্ছিল। এমন সময় দেখি একটি বছর পনেরোর মেয়ে,এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে ছোট ব্যাগটা টেনে নিল। তার মা-ও এগিয়ে এলেন, বড় লাগেজটা তিনি প্রায় জোর করেই নিয়ে এগোতে লাগলেন ট্রলি রাখার জায়গায়। আমি বললাম থ্যাংক ইউ, বলে ব্যাগ তুলতে গেলাম ট্রলিতে, এমন সময় এগিয়ে এলেন মেয়েটির বাবা, আমার ছেলেরই বয়সী। তিনি আমাকে থামিয়ে নিজেই তুলে দিলেন ব্যাগগুলি, জিজ্ঞেস করলেন ট্রলি নিয়ে যাবেন কি না। একা বেড়াতে বেরিয়েছি, সেখানে নিজের লাগেজটুকুও অন্যকে দিয়ে টানাব! বিবেকে বাধল। ধন্যবাদ দিয়ে তাদের যেতে দিলাম। তিনটি মানবিক মুখের সন্ধান পেয়েই বুঝলাম পৃথিবীতে এখনও দরদী মানুষ আছেন। সেই মেয়েটিকে দেখেছি আমাদের প্লেনে, হয়তো কোনও এক্সকারশনে যাচ্ছে দলবেধে।
এবার লাগেজ নিয়ে খানিক এগোতেই গেট কিপার এগিয়ে এসে পাসপোর্ট ও টিকিট দেখে ভিতরে কোনদিকে যাব দেখিয়ে দিল। গেলাম ভিতরে, তখন রাত ১২ টা, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা সহযাত্রীরা একে একে এসে জড়ো হচ্ছেন নির্দিষ্ট জায়গায়। সাড়ে চারটের ফ্লাইট, চারঘন্টা আগে চেক ইনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। আমাদের দলও বেশ ভারী। আমার যেহেতু হুইল চেয়ার ছিল তাই তাড়াতাড়ি সব কাজ হয়ে গিয়ে ফ্লাইটের নির্দিষ্ট গেটের সামনে গিয়ে বসলাম। এরপর দীর্ঘ বিরক্তিকর, নির্ঘুম রাত বসে কাটানো। যাক শেষে ফ্লাইট ছাড়ল নির্দিষ্ট সময়ে।
নাইরোবি পৌঁছুলাম স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটা হবে। মহাযজ্ঞের সামিল প্লেন থেকে বেরোনো লাগেজ উদ্ধারপর্ব। সেটাও সারা হল। এবার সকলে একসাথে বাইরে বেরোনো। একের পর এক বোঝাই ট্রলি টেনে চলছি প্রায় সবাই ষাটোর্ধ সিনিয়র সিটিজেন। কে কার আগে যাবে সেই তৎপরতা দেখে কে বলবে যে সব সিনিয়র সিটিজেন ট্যুরিস্ট! ট্যুর ম্যানেজারের নির্দেশমত এক জায়গায় জড়ো হলাম, মোটা তাঁবুর ছাউনির নীচে, কারণ মেঘমুক্ত আকাশে ছিল চড়চড়ে রোদ্দুর।
সেখানে আমাদের বড় লাগেজ তুলে দিলাম স্থানীয় এজেন্টের হাতে, যাঁর দায়িত্বে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বাসটি। সে-সব সে পৌঁছে দেবে নাইরোবির হোটেলে। সেখানের ক্লোকরুমে জমা থাকবে তিনদিন।
ছোট হ্যান্ডব্যাগে চার দিনের মত অত্যাবশ্যক সামগ্রী, ওষুধপত্র নিয়ে ছোট ছোট আটটি গাড়িতে আমরা ৪০ জন যাত্রী, ট্যুর লিডার, স্থানীয় এজেন্ট ও দুজন গাইড যাত্রা শুরু করেছিলাম মাসাইমারার উদ্দেশ্যে। পথে সেই রাতটা আমাদের কাটানোর কথা ছিল লেক নাকুরুর পাশের জঙ্গল রিসর্টে। পরদিন সকালে মাসাইমারার উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা নির্দিষ্ট ছিল।
মাসাইমারা আর সেরিঙ্গেটি দুই যমজ বনাঞ্চল, আজ রাজনৈতিক কারণে দুই বনাঞ্চল দুই দেশের ভাগে পড়েছে। টাঙ্গানিকার বৃহৎ অরণ্য সেরিঙ্গেটির একটা দীর্ঘ বাহু কেনিয়াতে বিস্তৃত, নাম তার মাসাইমারা অভয়ারণ্য। কাঁটাতারের বেড়া দেশের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু অরণ্যবাসী পশুদের, পাখিদের যাতায়াত তো বন্ধ করা যায়নি! সে বৃত্তান্ত পরের সংখ্যায় লিখব।

এইসব দেখতে দেখতে দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম নাকুরু এলাকায়। সেখানে এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে অরণ্যভ্রমণ শুরু হল।
প্রথমে বুঝতেই পারিনি, ভাবছি বনভ্রমনের জিপ কোথায়, জীবজন্তু দেখব, ছবি তুলব কি গাড়ির ভিতরে বসে? আমাদের গাড়ির চালক কে. জনসন, ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান, মানুষটি বেশ মজাদার। একাধারে সে গাইডও।
‘হোয়ার ইজ আওয়ার জিপ?’ জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির মাথাটা উঁচুতে তুলে দিল। দেখি আরে এই তো সেই হুড -তোলা গাড়ি যেটাকে ট্যাক্সি ভেবে এতক্ষণ বসে এসেছি। অরণ্যে প্রবেশ পথের দুপাশে দুটি আফ্রিকান ব্যাফেলোর শিংসমেত মাথার খুলি সাজিয়ে রাখা।
নাকুরু লেকের ধার ধরে অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে চলল আমাদের গাড়িগুলি। প্রত্যেকটির মাথার উপরের ছাদ খুলে উপরে তুলে রাখা হয়েছে। আরোহীরা সকলে দাঁড়িয়ে পড়েছি, হাতে সকলেরই ক্যামেরা,বা দামি মোবাইল, মূহুর্তে মূহুর্তে ঝলকে উঠছে । প্রথমেই দেখা পেলাম মানবের পূর্বপুরুষের বংশধরদের। গাড়ি চলার পথের দুধারেই দলে দলে ঘুরছে বেবুনের দল। তারাই প্রথম ধরা পড়ল আমাদের ক্যামেরায়। উচুনীচু পথে ধুলো উড়িয়ে চলল জিপ,রীতিমতো নাচতে নাচতে। আমরাও। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় পড়া পালকির গান ছড়ার লাইনগুলো। ‘পালকি দোলে ঢেউয়ের নাড়ায়/ ঢেউয়ের দোলে অঙ্গ দোলে’ আমাদের বাহন জিপটিও কখনও ‘উঠছে আলে নামছে গাড়ায়’ এর মতই ঝটাং করে নীচু জমিতে নেমে যাচ্ছিল আবার পরমূহুর্তেই উচু জমিতে উঠছিল। সঙ্গে আমরাও হেলছিলাম, দুলছিলাম, আর রীতিমতো নাচতে নাচতে চলছিলাম। হাতের ক্যামেরা কিন্তু ফোকর পথে লেন্স বাড়িয়ে, যথাসম্ভব স্টেবল রাখার চেষ্টা চলছে ভালো শট নেবার জন্য। খানিক এগোতেই দুপাশের ঝোপজঙ্গলে দেখা দিল জেব্রা আর বনমহিষের দল। একসঙ্গেই তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে,আর চিবোচ্ছে জঙ্গলের ঝোপের নীচের হরিতবরণ তৃণদল, কাঁটাগাছ ঝোপঝাড়ের পাতালতা। বেশির ভাগই মুখ ডুবিয়ে ঘাস খেয়ে চলেছে। গাড়ির পর গাড়ি চলছে শব্দ করে, এদের তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ওরা তো জানে এ জঙ্গলে তারাই রাজা। এ তাদেরই রাজত্ব।
সামনেই দেখা দিল কিছু ভারবেট মাংকি, আর অলিভ বেবুন, এরা সংখ্যায় প্রচুর। এ-গাছ সে-গাছ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সদলে। কিন্তু এখানে নাকি অ্যাকাশিয়া গাছে গাছে দেখা যায় সাদাকালো কোলোবাস( Colobus) মাংকি, কিন্তু আমরা সেদিন তাদের দেখা পাইনি।
পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসের বাইরে আর প্রাকৃতিক জগতের খোঁজ বোধ হয় কেউই বিশেষ রাখে না। তাই নাকুরু নামটা অচেনাই ছিল। আইটিনারি দেখে সেটির অনুসন্ধান করি গুগল বাবুর ডিকশনারিতে।
খুঁজতে খুঁজতে পেলাম আফ্রিকার নানা তথ্য। যা বলা হয়নি এতক্ষণ। তা হল আফ্রিকার বিখ্যাত গ্রেট রিফট ভ্যালির কথা। নাকুরু যাওয়ার পথে থেমেছিলাম গ্রেট রিফট ভ্যালির পাশে রাস্তার উপরে। একদিকে গ্রেট রিফট ভ্যালি, বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আর একদিকে উঁচু পাহাড়ের ঢাল। পাহাড়ের গায়ে বৃক্ষরাজি সূর্যকে আড়াল করেছে। প্রান্তরের ধার ঘেঁষে প্রাচীর, রাস্তা ভেঙে না পড়ে সেজন্য। রাস্তার আর প্রাচীরের মাঝে খানিক জায়গা, সেখানেই আদিবাসী আফ্রিকান মানুষের বাস। কয়েকটি পরিবার মিলে থাকে। বাইরে থেকে ঘরগুলো দেখে বোঝা যাবে না যে ভিতরে কী বিপুল শিল্পসম্ভার সাজানো রয়েছে ক্রেতাদের অপেক্ষায়। অসাধারন সব হ্যান্ডিক্র্যাফট, কাঠের তৈরি নানা জীবজন্তুর মূর্তি, গৃহসজ্জার নানা সামগ্রী।

‘ট্রাইবাল মনুষ্য নয় অতি বড় জন্তু ‘ বলে সভ্য জগতের মানুষের যে ধারনা সেটা ভেঙে যাবে এদের শিল্পীদের দক্ষতা দেখলে। বাইরে সাজানো হরিণ, হায়না, ভালুক সহ নানা বন্যপ্রাণীর স-লোম চামড়া, বিক্রির জন্য সাজানো। সেসব কেনে বিদেশি সৌখিন মানুষজন, ইউরোপিয়ান। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাঝে মাঝে এইসব জনাবাসে থাকে ওয়াশরুমের ব্যবস্থা। আর সেই কারণে ট্যুরিস্টরা এখানে থামে, কিছু শিল্পসম্ভার বিক্রিও হয় এই অবকাশে।
রাস্তার ধারের প্রাচীরে বসে দেখছিলাম পূবদিকে দিগন্তবিস্তৃত খোলা প্রান্তর, বৃক্ষগুল্মহীন ন্যাড়া প্রান্তর। এই সেই বিখ্যাত গ্রেট রিফট ভ্যালি, যেখানে বসে আছি সে জায়গাটা সমুদ্রসমতল থেকে ১৩০০ ফুট উচতায় অবস্থিত গ্রেট রিফট ভ্যালি রিজিয়নের অন্তর্গত। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল এই ভেবে যে আমরা রয়েছি আফ্রিকার সেই বিখ্যাত চ্যূতির উপর, প্রকৃতির খেয়ালে যে কোনও সময় সেই চ্যূতি বিস্তৃত হয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে নিতে পারে উপরের জনপদ, রাস্তাঘাট। মানুষের সব চিহ্ন মুছে যেতে পারে এক লহমায়।
টেকটনিক বা মহাদেশীয় প্লেটের সরণের অভিঘাতে সৃষ্ট অগ্ন্যুৎপাত এই অঞ্চলকে সৃষ্টি করেছিল অনাদি অতীতে। কিছু সময়ের জন্য আমি ভুলে গেলাম এই জগত, ফিরে গিয়েছিলাম রবিগুরুর বর্ণনায় পাওয়া তমসাচ্ছন্ন আফ্রিকা মহাদেশের সৃষ্টিলগ্নের সময়ে। মনে হচ্ছিল যেন থিরিথিরি কম্পন দ্রুত হচ্ছে ক্রমশ, দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল, অনেকটা জায়গা জুড়ে মাটি ফুঁড়ে উঠতে লাগল আগুনরঙা লাভা, ছাইভস্মের স্রোত, চাপা পড়ে যাচ্ছে দিগবিদিক, হঠাৎ বোমার আওয়াজের মত গম্ভীর অথচ চড়চড় আওয়াজ উঠল, ফাঁক হয়ে গেল ধরণীবক্ষ, সৃষ্টি হল দীর্ঘ গভীর খাদ,- গ্রেট রিফট।

গ্রেট রিফট ভ্যালির কথা ভাবতে ভাবতে গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে নির্দিষ্ট আসনে বসে অনেকেই সঙ্গে থাকা স্ন্যাক্সের কিছু কিছু মুখে চালান করতে লাগল। দীর্ঘ পথযাত্রায় ট্যুর কোম্পানির দেওয়া এইসব কিলোতিনেকের স্ন্যাক্স, চকলেট, তেঁতুলের লজেন্স, আমলা, একঘেয়েমি কাটাতে বেশ সাহায্য করে। আমার অবশ্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে মুখ চলার ব্যাপারটা নেই। তাই বাসের ওয়াইফাই লাগিয়ে চালু করলাম মোবাইলে গুগুল। জানতে চাইছিলাম আগামী গন্তব্যের আগাম খবর। কিন্তু চোখ আটকে ছিল রিফট ভ্যালির মানচিত্রেই।
গ্রেট রিফট ভ্যালির অবস্থান আফ্রিকার পূর্বাংশের এক বিরাট অংশ জুড়ে। গ্রেট রিফট ভ্যালির শুনতে মনে একটা বিরাট উপত্যকা। আদপে তা নয়। প্রাকৃতিক কারণে, “ভূপৃষ্ঠের সেই ঘন ঘন মাথা নাড়ার দিনে, রুদ্র সমুদ্রের বাহু ছিনিয়ে গিয়েছিল….” আফ্রিকাকে, আলাদা করে নিয়ে গিয়েছিল প্যানাজিয়া ভুখণ্ড থেকে। সেই সব গড়াপেটার দিনেই সৃষ্টি এই সুদীর্ঘ চ্যূতি উপত্যকার। হ্যাঁ, সুদীর্ঘ না বলে আর কি বলা যায়, কারণ যে ফাটলের শুরু হয়েছে সেই উত্তরের মধ্যপ্রাচ্য থেকে আর শেষ হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের বহু দক্ষিণে, বিষুবরেখা ছাড়িয়ে গিয়ে সেই মোজাম্বিকে। মাঝখানে পেরিয়েছ সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন ভ্যালি, ডেড সি, আরব গাল্ফ, লোহিত সাগর আর আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ। তবে হ্যাঁ এই গ্রেট রিফট দুইভাগে বিভক্ত, দীর্ঘ রিফটটি আফ্রিকার পূর্বদিকে আর একটা ফাটল ভ্যালির পশ্চিম দিকে। ভাবছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম যে ফাটলের পাশ ধরেই গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা, বনানী। গ্রেট রিফটের প্রধান অংশটির শুরু রেড সি, সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর চলেছে দক্ষিণের দিকে, ইথিওপিয়া হয়ে চলেছে দক্ষিণে কেনিয়া, টানজানিয়া, হয়ে মালোয়ারি থেকে নিম্ন জাম্বেজি উপত্যকার শেষদিকে ভারতসাগরতীরে মোজাম্বিকে যাত্রা শেষ করেছে গ্রেট রিফটের একদিকটা। আরেকটি অংশ চলেছ পুবদিক দিয়ে।
পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ায় এই দুই রিফটের মাঝে সৃষ্ট ভ্যালি আর রিফটের ধার ধরে অবস্থান করছে অসংখ্য লেক- ছোটবড় মিলিয়ে ৬৪ টা লেকের মধ্যে ৮টি বড় লেক। এদের মধ্যে ৩ টি মাত্র মিষ্টি জলের। বাকি ৬টিই অ্যালকালাইন বা সোডা ওয়াটার লেক। এদের মধ্যে নাকুরু লেকও একটি অগভীর সোডা ওয়াটার লেক। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১৭৫৪ মিটার উচতায় ১৮৮০০ একর জুড়ে অবস্থান নাকুরুর। এই লেকের কোন ইনলেটও নেই, আউটলেটও নেই। নাকুরু অভয়ারণ্য দিয়ে ঘেরা। উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি হচ্ছে লেসার আর গ্রেটার ফ্লেমিংগোদের। এককথায় বন্যপ্রাণের স্বর্গ বলা চলে নাকুরু বনাঞ্চলকে। খাবার ও জল দুটোই প্রাণীরা প্রায় অপর্যাপ্ত। আর জল খেতে গিয়ে সচরাচর কুমীরের পেটে যেতে হয় না, তবে হিপ্পো আছে জলে। চিতা, লেপার্ড,সিংহ হায়না এখানে নেই, আসলে এগুলো সচরাচর দেখা যায় না এই বনে তাই গাইড জানাল যে এরা বাইরে থেকে হয়তো মাঝে মধ্যে ঢুকে আসে তখন বনপ্রহরীর নজরে পড়ে যায়। হ্যাঁ হাতী এই অরণ্যে একেবারেই নেই।
আমাদের গাইডের মুখে শুনেছিলাম তাদের মাসাই ভাষায় নাকুরু শব্দের অর্থ হল ডাস্ট বা ডাস্টি প্লেস। একথার সত্যতা প্রমাণিত হল আমাদের জিপের চলা শুরু হতেই।
ছুটছি জিপের দোলায় দুলতে দুলতে, হঠাৎ পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখি অস্তাচলের পথে সূর্য অনেকটাই হেলে পড়েছে, হাল্কা মেঘের আস্তরণের জন্য রৌদ্রের তেজ প্রখর নয়, গাছপালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তির্যক রশ্মি এসে পড়েছে জলে, সেই আলোয় দেখা গেল ফ্লেমিংগোদের মেলা বসেছে। গোলাপী ডানায় এলাকাটা গোলাপি চাদরে ঢাকা মনে হল। লেকের দীর্ঘ ধার ধরে হাজারে হাজারে ফ্লেমিংগো মনের আনন্দে আহার সারছে। হঠাৎ নজরে এল চার চারটি কালো গন্ডার, দিনান্তে আস্তানায় ফেরার আগে বোধ হয় শরীরের তাকৎ পরীক্ষা করার জন্য একটি বড় আকারের গণ্ডার বাকিগুলোকে তাড়া করল। দুজন পালাল, একটি রুখে দাঁড়াল, বোধ হয় বয়সে নবীন, জোশও খুব। পালাতে ইগোতে বাধল। ফলে লাগল লড়াই, একবার এ পিছোয় তো অন্যজন এগোয়, পাল্টাপাল্টি চলল মিনিট দশেক, এবার রণে ভঙ্গ দিল আক্রমণকারী বুড়ো গন্ডার।

কেনিয়ার অসংখ্য আগ্নেয়পর্বতের মধ্যে একটি জীবন্ত হচ্ছে Menengai। এর ঠিক বিপরীত দিকেই, অর্থাত দক্ষিণ দিকেই অবস্থান নাকুরুর। জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আর শীতল জলের হ্রদ- বহু প্রাণীর আশ্রয়দাতা নাকুরু লেক দুজনেই মুখোমুখি। ভাবছিলাম হয়ত আবার কোনদিন এই অগ্নিগিরি ঘুম ভেঙে উঠেই ভেস্তে দিতে পারে এই বিশাল জলাধার আর তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা অভয়ারণ্যের জীবকুলকে।
ভেবেছিলাম এতসব বিখ্যাত লেক থাকতে নাকুরু কেন আমাদের একমাত্র ও প্রথম গন্তব্য। আমাদের সঙ্গে থাকা প্রফেশনাল গাইড ওয়াতুবু মশায় জানালেন এটাই সবচেয়ে বিশাল এলাকা নিয়ে অবস্থিত আর এখানেই বহু সংখ্যায় দেখা মিলবে দুই প্রজাতিরই সুন্দর পাখি গ্রেটার ও লেসার ফ্লেমিংগোর। আসলে লেকের পান্নাসবুজ জলে বাস করে ব্লু-গ্রিন আলগি, যা এদের প্রধান খাদ্য। প্রকৃতির আদিম এই লীলাভূমিতে কী অপূর্ব খাদ্যশৃঙখল, এই অ্যালগি আবার বেঁচে থেকে কীটপতঙ্গের লার্ভা খেয়ে, এই বনভূমির জলাধারে যার কোনও অভাব নেই। মাছও প্রচুর, অনেক পাখি তো মাছ খেয়েই বাঁচে, যেমন Black necked grebe, African spoonbill,Pied avocet, little grebe,yellow billed stork,black winged silt, grey headed gull,gull billed tern আরও কত পাখি। এত পাখির সবাই মাছ খেয়ে বাঁচে কি না জানতে পারিনি। তবে হ্যাঁ মাছেদের জন্যও জলে প্রচুর খাদ্য আছে।, প্রধানত ক্রাসটাশিয়ান বলে যাদের সেইসব কাঁকড়া,শ্রিম্প, লবস্টার, ক্রাইফিশ, ক্রিল(krill) উডলিস,(woodlice) ব্রানাসেলস(barnacels) আরও কতশত আর্থ্রোপোডার দল বাস করে লেকের জলে। সবই মাছেদের খাদ্য, আবার পাখিদেরও। এসব অবশ্য আমাকে গুগুল ঘেটে জানতে হয়নি, চালক কাম গাইড ওয়াতুবুই জানিয়েছে সব।
গাড়ি চলতে চলতে ড্রাইভার অনেক কিছু দেখাচ্ছিল, তবে তার দুর্বোধ্য ইংরাজি উচ্চারণে বলা তথ্য মোবাইলে রেকর্ড করে রাখলাম পরে ধীরেসুস্থে শুনে মর্মার্থ উদ্ধার করব বলে।
হঠাৎ দেখি সামনে একদল হরিণ, মাথায় ছোট শিং, পিছন দিকে পায়ের বাইরের দিকে দুপাশে কালো দুটি দাগ। আবার কিছু হরিণের বেশ বড় বাঁকা শিং। জেব্রা, হরিণ, বুনো মোষ সবাই একসঙ্গে বিচরণ করছে ঘাস চিবিয়ে চিবিয়ে, সকাল থেকে সন্ধে এরা খেয়েই চলে খেয়েই চলে।
গাড়ি বাঁক নিয়ে চলল বাঁদিকে, লেক পড়ে রইল পিছনে। হঠাৎ দেখি থমসন গ্যাজেলা – হরিণ জাতীয় প্রাণী, উঁচু ঝোপের দিকে মুখ বাড়িয়ে পাতা খাচ্ছে, গাড়ির শব্দে খানিক থেমে পড়ল, কিন্তু পালায়নি। কাঁটাগাছ আছে বেশ ঝোপালো আর উঁচু।




এবার চললাম জঙ্গলের কাছেই রিসর্টে। পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে তৈরি হয়েছে রিসর্টের ঘরগুলি। উঁচু জায়গায় ট্যুরিস্টদের থাকার জায়গা। আমরা ভিতরে ঢুকতেই অভ্যর্থনা করল মেয়েরা, ছোটো ছোটো গ্লাসে স্থানীয় ফলের মিষ্টি রস। লাগেজের জন্য স্লিপ দিল আর ঘরের চাবি ও টোকেন দিল। স্লিপে রুম নম্বর লিখে ব্যাগের গায়ে লাগিয়ে রেখে রুমে গিয়ে রিফ্রেশ কর, বেল বয়েরাই লাগেজ পৌঁছে দেবে ঘরে ঘরে।
চাবি নিয়ে ঘর খুঁজতে খুঁজতে উঠতে লাগলাম, চতুর্থ ধাপের একেবারে শেষপ্রান্তে আমার ঘর, চারিদিক কাছের দেওয়াল,তবে ভারী পর্দা ফেলা। জোরালো আলো নেই, চলার পথে মাঝে মাঝে ফুটল্যাম্প জ্বলছে। ঘরে ঢুকে দেখি বিছানা পরিপাটি করে গোছানো। ডবল বেডের রুম, তাই দুটি বেড ঘিরেই সাদা লেসের পর্দা মশারির মত টাঙানো, উপরে চ্যানেলের হুকের সঙ্গে আটকানো, মশা ঢোকার কোন উপায় নেই। দুহাতে মাঝখানের চেরা জায়গাটা ফাঁক করে সুরুত করে ভিতরে ঢুকে পড়তে হবে, না হলে জঙ্গুলে ইয়েলো ফিভারের জনক মশারা ঢুকে পড়তেই পারে। যদিও এখানে যাবার জন্য ইয়েলো ফিভারের ইনজেকশন নিতে আর পোলিও খেতে হয়েছিল কোলকাতা হেস্টিংস হাউসে গিয়ে। ফলে একটা সুবিধা হল যে এরপর আমাজন, ব্রাজিল গেলে আর ইয়েলো ফিভারের ইনজেকশনটা নিতে হবে না।
রিসর্টে সেদিন অতিথিদের জন্য আফ্রিকান ড্রামের সঙ্গে তুমুল নাচের আয়োজন ছিল, দুদিনের ক্লান্তু শরীর সেই অনাবিল আনন্দের নাচগানবাদ্য গ্রহণ করতে পারেনি। আমরা রাতের খাবার খেয়ে শুতে গেলাম। আলো-আঁধারিতে বনের ধারের রিসর্টে ঘুমোতে গিয়ে যে ভয় ভয় করছিল না সেটা হলফ করে বলতে পারব না। তবে চারদিক ছিল বিদ্যুতের তার দিয়ে ফেন্সিং করা যাতে রাতবিরেতে বন্য পশু আকস্মিকভাবে ঢুকে না পড়ে। যাক রাতে ভালই ঘুম হল দুধসাদা বিছানায়, লেসের মশারির আবরণে শুয়ে। পরদিন সকাল ৭ টায় বেরোতে হল। এবার গন্তব্য মাসাইমারা।
ফটোগ্রাফিঃ লেখক
ক্রমশ