অরিন্দম দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
তিমির গান
অরিন্দম দেবনাথ
সে অনেকদিন আগের কথা। দুই বন্ধুর সাথে হাঁটছিলাম সমুদ্রের বেলাভূমি ধরে পারাদ্বীপ থেকে পুরী। চলার পথে যে কত জলা আর নদী পার হতে হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। রাত কাটত সমুদ্রের ধারের জেলে-বস্তিতে অথবা পিঠে বয়ে নিয়ে চলা তাঁবুতে।
চলতে চলতে পৌঁছেছিলাম দেবী নদীর মোহনায় ভর সন্ধেতে। নদীর ধারের জেলেদের সাথে রাত কাটানোর আমন্ত্রণ জুটেছিল। ওরাই ভালোবেসে আমাদের রাতের খাবারের ভার নিয়েছিল। পূর্ণিমার রাত ছিল সেটি। রাতে জেলেদের সাথে ডোঙায় চেপে মাছ ধরাতে গেছিলাম সমুদ্র-মোহনায়। জাল আগে থেকেই বিছানো ছিল নদীর বুকে। সেই জাল টেনে তুলতেই উঠে আসছিল ট্যাংরা মাছের ঝাঁক। ডোঙা ভরে উঠছিল মাছে। জলের শব্দ ছাপিয়ে উঠছিল আরেকটি শব্দ—কক কক। অনেকটা ব্যাঙের ডাকের মতো। তবে খুব হালকা ও সুরেলা। যেন কেউ অদ্ভুত স্বরে গান গাইছে। চমকে উঠেছিলাম। মাঝ নদীতে ব্যাঙের ডাক আসবে কোথা থেকে? তবে কি ডোঙায় ব্যাঙ আছে! পায়ের কাছে মাছের সুড়সুড়িতে টের পেলাম ওগুলো আসছে মাছেদের মধ্যে থেকে। ওরাই শব্দ করছিল কিনা জানি না। তবে শব্দটা হচ্ছিল। হতে পারে ডোঙার কাঠে ট্যাংরা মাছের কাঁটার ঘষা লেগে শব্দটা হচ্ছিল। তবে জেলেরা জানিয়েছিল, ট্যাংরা মাছ ধরা পড়লে এরকম শব্দ শোনা যায়।
তবে কি মাছ গান করতে পারে? আর কেউ পারুক বা না পারুক, জলের রাজা তিমি মাছ কিন্তু গান করতে পারে। শুধু তাই নয়, এই গান শোনা যায় বহু মাইল দূর থেকে এবং এই গান শোনার জন্য কোনও যন্ত্রপাতিরও দরকার নেই। নেই জলের তলায় যাওয়ার প্রয়োজনও। তিমি মাছ অধ্যুষিত সমুদ্র-কিনারায় কিম্বা জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট শোনা যায় তিমি-সঙ্গীত।
তিমি হল না ডলফিন, না শুশুক। যদিও তিমিকে তিমি মাছ বলা হয়, কিন্তু এরা মোটেও মাছ নয়, বরং মানুষের মতোই স্তন্যপায়ী প্রাণী। অনুমান, স্তন্যপায়ী তিমিরা আগে ডাঙার জীব ছিল। প্রায় ৭ কোটি বছর আগেও তাদের পূর্বপুরুষেরা ছিল মাংসাশী স্তন্যপায়ী। তারপর ধীরে ধীরে তারা জলে আশ্রয় নেয়। বিবর্তনের ফলে তাদের আকৃতির পরিবর্তন ঘটে। ক্রমে ক্রমে তার জলের জীবে রূপান্তরিত হয়। তিমির অসংখ্য প্রজাতি আছে। যেমন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো প্রাণী হল নীল তিমি। এছাড়াও আছে খুনে তিমি, পাইলট তিমি… তিমির খাদ্য তালিকায় আণুবীক্ষণিক প্ল্যাঙ্কটন থেকে শুরু করে বড়সড় মাছ সবই আছে। স্তন্যপায়ী তিমির মাঝে মধ্যে বাতাসের অক্সিজেনের দরকার পড়ে, তখন সে ভেসে ওঠে জলের ওপর। আর তখনই শুরু করে জলক্রীড়া ও শব্দ সৃষ্টি। পরষ্পরের সাথে সুরেলা শব্দ করে যোগাযোগ করে, যা তিমির গান নামে পরিচিত। তিমির বিশালতা ও শক্তিমত্ততার মতোই এদের গানেরও ভেদ আছে। আকৃতিতে তুলনায় ছোটো স্পার্ম তিমির গান মৃদু গুঞ্জনের মতো শোনায়, আবার বিশাল বপু হাম্পব্যাক তিমির শব্দ বহু মাইল দূর থেকেও শুনতে পাওয়া যায়।
মা তিমিরা তাদের বাচ্চাদের স্তন্য পান করায়। লালনপালন করে। বাচ্চাদের সাথে খেলা করে। এদের আছে দীর্ঘ শৈশবকাল। শৈশবকালে পূর্ণবয়স্ক তিমিরা তরুণদের শিক্ষা দেয়। এগুলো স্তন্যপায়ীদের স্বাভাবিক ধর্ম। বুদ্ধিমান প্রাণীদের বিকাশের জন্যে যা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সাগর হল অস্বচ্ছ ও অন্ধকার একটা জায়গা। স্থলের প্রাণীদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি ও ঘ্রাণশক্তি যত ভালোভাবে কাজ করে, মহাসাগরের গভীরে তা ভালোভাবে কাজ করে না। তিমিদের পূর্বপুরুষরা ঘ্রাণ, শ্রবণ ও দৃষ্টির ওপর নির্ভর করে তাদের বাচ্চা, সঙ্গী অথবা শক্রর অবস্থান খুঁজে বের করত। সম্ভবত বিবর্তনের মাধ্যমে অন্য একটি পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছিল তিমিদের মাঝে। এই পদ্ধতিটা হল শব্দ-ইন্দ্রিয়।
একটি তিমির গান সাধারণত ১৫ মিনিট ধরে চলে, আর দীর্ঘ হলে প্রায় ১ ঘণ্টার মতো হয়। এই ধরনের গানগুলো বারে বারে চলতে থাকে। প্রতিটি সুর, প্রতিটি তরঙ্গ, প্রতিটা স্বর একেবারে নিখুঁত। যেন বারে বারে অনুশীলন চলছে। তিমিদের আসাধারণ মনে রাখার ক্ষমতা। তিমিদের কোনও দল কখনও ঠাণ্ডা জলের অঞ্চল থেকে থেকে গরম জলের চলে গিয়ে ৬ মাস পরে আগের জায়গায় ফিরে এলে ৬ মাস আগে যেখানে গানটি থেমেছিল ঠিক সেখান থেকে শুরু করে। শুনলে মনে হয় যেন সঙ্গীতানুষ্ঠান। থামেনি, শিল্পী খানিক মঞ্চের পেছনে গিয়েছিলেন বিশ্রাম নিতে। পুরনো চারণক্ষেত্রে ফিরে আসার পর অনেক সময় এদের গানের সুর বদলে যায়। যেন তারা মানুষদের মতোই নতুন গান বাঁধে। দলের প্রায় সব সদস্যরাই একসাথে গান গায়। জানা নেই তিমিরা অথবা তাদের নিকট আত্মীয়রা কী বিষয়ে কথা বলে বা গান গায়।
হাম্পব্যাক কুঁজওয়ালা তিমিরা সমুদ্রের কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে থাকে না, বরং তারা বহুদূরবর্তী অঞ্চলে পাড়ি জমায়। এরা সাঁতরে ঘণ্টায় সাড়ে তিন মাইল পথ পাড়ি জমায়। কিছু কিছু হাম্পব্যাককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঞ্চল থেকে সুদূর পূর্ব রাশিয়ার কামচাটকা পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ হাজার মাইল জলপথ পাড়ি দিতে দেখা গেছে। একটি হাম্পব্যাককে তিরিশ দিনে হাওয়াই থেকে আলাস্কা পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬০০ মাইল পথ পাড়ি দেয়ার ব্যাপারটি স্যাটেলাইট মনিটরে ধরা পড়েছে। গান গাওয়ার সময় এরা এদের পাখনা (ফ্লিপার) দুটো দু’দিকে মেলে ধরে। একটি পূর্ণবয়স্ক ৫০ ফুট লম্বা ৪০ টন ওজনের হাম্পব্যাক তিমির পাখনা লম্বায় প্রায় ১৫ ফুট পর্যন্ত হয়। গান গাওয়া ছাড়াও তারা নানাধরনের ধ্বনি সৃষ্টি করে মনের ভাব প্রকাশ করে ও সঙ্গীদের বিভিন্ন ধরনের বার্তাও পাঠায়। এদের শব্দের তীব্রতার মান ১৭০ ডেসিবল যা জেট বিমানের গর্জনের চেয়েও বেশি। হাম্পব্যাক তিমি পৃথিবীর প্রায় সব সাগরেই দেখা যায়।
পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকেও তিমিরা কিন্তু পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে! তিমিরা সামাজিক জীব। তারা একসাথে শিকার করে, সাঁতার কাটে, খেলা করে, মাছ ধরে, গাছগাছড়া ছিঁড়ে খায়, আনন্দে নাচে, সঙ্গী খোঁজে, শিকারির কাছ থেকে পালায়। হতে পারে তারা এগুলো নিয়ে কথাও বলে, আলোচনা করে। অবাক হবারই কথা। বিশিষ্ট মার্কিন জীববিজ্ঞানী রজার পাইনের মতে, পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থান করেও গভীর সাগরের দুটো তিমি পরস্পরের সাথে ২০ হার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ করতে পারে। এই শব্দাঙ্ক এতই কম যে মানুষের কানে এই শব্দ ধরা পড়ে না। দৈত্যাকৃতি, অতীব বুদ্ধিমান ও দূর-যোগাযোগ ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রাণী যুগ যুগ ধরে এভাবেই নিজেদের মধ্যে তাদের যোগাযোগ করে আসছে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ক্রমাগত সামুদ্রিক জলযানের উন্নতির ফলে সাগরের বুকে নেমে এসেছে ভয়াল শব্দদূষণ। বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজ থেকে সমুদ্রে ২০ হার্জ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ ছড়াতে থাকে। এর ফলে তিমিদের নিজস্ব যোগাযোগের ব্যবস্থা ক্রমাগত ধ্বংস হচ্ছে এবং যোগাযোগের ব্যাপ্তিও একইভাবে কমেছে। অনুমান, দুশো বছর আগে একটি ফিনব্যাক তিমি সম্ভবত ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে আরেক দল তিমির সাথে যোগাযোগ করতে পারত। আর আজ এই যোগাযোগের বিস্তৃতি অল্প কয়েকশত কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কারণ, ওই জলতলের শব্দদূষণ।