অরিন্দম দেবনাথ সব লেখা একত্রে
হাজার হাজার পাইথনের হাত থেকে বাঁচতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা প্রদেশে ভারতের ইরুলা উপজাতির দুই সাপুড়েকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জানিয়েছেন অরিন্দম দেবনাথ।
ফ্লোরিডার এভারগ্লেডস ন্যাশনাল পার্কে ধরা পড়েছে আঠারো ফুট লম্বা বার্মিজ পাইথন।
অ্যাঁ সাপ ধরতে যেতে হবে তাও আবার মার্কিন মুল্লুকে ?
তামিলনাডুর ইরুলা উপজাতির গোপাল আর সাদিয়ানের কাছে যখন প্রস্তাবটা এল তখন ওরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না ওরা কি শুনছে।
প্রস্তাবটা এসেছে মার্কিন মুল্লুকের ফ্লোরিডা প্রদেশের সরকারি দফতর “ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশান কমিশন” থেকে!
মার্কিন মুল্লুকের ফ্লোরিডা প্রদেশের মার্কিন দেশে যাওয়া সেখানে দু’মাসের থাকা খাওয়া সহ যাবতীয় খরচা দেবে। সাথে দু’জনের জন্যে আলাদা আলাদা আনুবাদক থাকবে যাতে করে ভাষা কোন সমস্যা না হয়। ভাল টাকাও নাকি মিলবে।
পরিবর্তে ওদের দুজনকে ওই দেশে গিয়ে সাপ ধরে দিতে হবে – বার্মিজ পাইথন । সঙ্গে আরও লোক দেবে ওরা, আর দেবে দুটো ল্যাবরেডর প্রজাতির কুকুর, যারা আবার গন্ধ শুঁকে সাপ খুঁজে বের করতে ওস্তাদ।
দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত ইরুলা উপজাতির লোক গোপাল আর সাদিয়ানের কাছে সাপ ধরাটা কোন ব্যাপার না। গোপাল আর সাদিয়ান হল দুই ওস্তাদ সাপুড়ে। ইরুলা উপজাতির লোকেরা সাপ আর ইঁদুর ধরার জন্যে পৃথিবী বিখ্যাত। অনেক তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে এদের নিয়ে। দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি অঞ্চলে এদের বাস। ময়াল , শঙ্খচূড় , কোবরা , দাঁড়াশ, তুতুর, চন্দ্রবোড়া, কত রকম সাপের আখড়া যে নীলগিরি পর্বতমালা ও তার জঙ্গল তার ইয়ত্তা নেই। বেশ কয়েকবছর আগে ইরুলার থাকত গভীর জঙ্গলে। নিজেদের জাতের লোক ছাড়া অন্য মানুষদের এরা এড়িয়ে চলত। জঙ্গলের সাপ, গোসাপ, ইঁদুর, খরগোশ, শুয়োর ইত্যাদি প্রাণী ধরে ও খেয়ে এদের দিন চলত। জানোয়ারের ও সরীসৃপের চামড়া বিক্রি করে দিত ব্যবসায়ীদের কাছে। চাষ বাস নিয়ে এঁরা খুব একটা মাথা ঘামাত না। ইঁদুরের গর্ত থেকে এরা অনেক শস্য পেয়ে যেত।
একটা সময় ছিল যখন সাপের চামড়া দিয়ে সৌখিন জুতো, জ্যাকেট, বেল্ট, ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি হত, তখন ইরুলা উপজাতির লোকেরা একচেটিয়া ভাবে সাপ , বিশেষত পাইথন মেরে তাদের চামড়া যোগান দিত পৃথিবী জুড়ে। গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত পৃথিবীর সাপের চামড়া ও সাপের চামড়ায় তৈরি সামগ্রীর একটা বড় অংশের যোগান যেত ভারত থেকে। ইরুলাদের হাত যশ ছিল এর পেছনে। সত্তরের দশকে যখন পৃথিবী জুড়ে সাপ , কুমীর সহ অনেক সরীসৃপের চামড়া নিষিদ্ধ হয়ে পড়ল, সাপ সহ অনেক প্রাণী মারা ভারতবর্ষে দণ্ডনীয় বলে ঘোষিত হল , তখন ইরুলারা পড়ল মুস্কিলে। কারন শিকার করা, বিশেষত সাপ ও ইঁদুর ধরা ছাড়া এরা সে রকম কিছু জানত না।
এই পরিস্থিতিতে ইরুলা উপজাতিও মানুষদের রক্ষা করতে এগিয়ে এল বেশ কিছু সংস্থা। এদের ঘিরে তৈরি হতে লাগল অনেক পরিকল্পনা। চাষ বাস করতে উদ্বুদ্ধ করা হল এদেরকে ।
ক্রমে ক্রমে এই সাপ ধরিয়ে ইরুলার হয়ে উঠল অনেকের কাছে অপরিহার্য। দক্ষিণ ভারতে সাপের উপদ্রব খুব। প্রতি বছর অনেক লোক মারা যায় সাপের কামড়ে। ইরুলা উপজাতি ও তাদের সাপ ও ইঁদুর ধরার দক্ষতার কথা যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, তখন চাষের ক্ষেত থেকে সাপ ও ইঁদুর ধরতে চাষিরা এদের সাহায্য নিতে শুরু করল। বিশিষ্ট সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ ডক্টর রম হোয়াইটাকার ও তার ম্যাডরাস ক্রোকোডাইল ব্যাংক সহ এগিয়ে এল আরও কয়েকটি সংস্থা।
ইরুলারা সাপ ধরে জ্যান্ত সরাবরাহ করতে লাগল বিভিন্ন সর্প কেন্দ্রে। তৈরি হল ইরুলা স্নেক ক্যাচারস কো অপারেটিভ সোসাইটি। এদের কাজ হল সাপের বিয সংগ্রহ করে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানী ও গবেষণা কেন্দ্রে যোগান দেওয়া। ইরুলারা সাপ ধরে নিয়ে এসে মাটির হাঁড়ির ভেতর রেখে পুষতে লাগল । তারপর একটা নির্দিষ্ট সময় পড়ে সাপগুলোর মুখ থেকে বিষ সংগ্রহ করে আবার জ্যান্ত ছেড়ে দিয়ে আস্তে লাগল জঙ্গলে, সাপের নিজের পরিবেশে। সাপ হত্যাকারী ইরুলারা হয়ে উঠল সাপদের রক্ষক।
ভারতে আরও অনেক সাপ ধরিয়ে উপজাতি আছে কিন্তু ইরুলাদের সমকক্ষ কেউ নয়। সাপদের নিয়ে ইরুলাদের জ্ঞান দুনিয়ার বাঘা বাঘা সর্প বিশারদদের চুপ করিয়ে দিয়েছে। ইরুলারা মাটি বা বালির ওপরে দাগ দেখে বলে দিতে পারে যে সেখানে সাপ আছে নাকি। থাকলে কোথায় আছে। সেই সাপ কত বড়।
এ ছাড়াও ইরুলারা বিশেষজ্ঞ মউলি। পূর্ণিমার শেষ রাতে এঁরা মধু সংগ্রহে বেরোয়। হাতে পাকানো লতার মইতে পাহাড়ের ঢালে ঝুলে বা গাছের মাথায় উঠে মৌচাক ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ করে এঁরা। আশ্চর্যের ব্যাপার মৌচাক ভাঙ্গার সময় মৌমাছিরা নাকি এদের কামরায় না। ইরুলারা বলে ওদের গায়ের গন্ধে নাকি মৌমাছিরা পালিয়ে যায়।
এহেন দুই ইরুলা উপজাতির সাপুড়েকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে উড়িয়ে নিয়ে যাবার কারণন, সে দেশে অজগরের অস্বাভাবিক সংখ্যা বৃদ্ধি। এত পরিমাণে অজগর সাপের সংখ্যা বেড়েছে যে সে দেশের জন্তু জানোয়ার পাখি সব বিলুপ্ত হতে বসেছে। অজগরের প্রজাতিটাকেও চিহ্নিত করা গেছে। বার্মিজ পাইথন! ওই দেশের নিজস্ব কোন সাপ নয়। এই সাপ ভারতীয় উপমহাদেশের।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির সংখ্যা কমে আসছিল ফ্লোরিডার কিছু অংশ জুড়ে, বিশেষত ক্যে লাড়গো দ্বীপের আশপাশ থেকে । রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যাচ্ছিল জলার মাছ ও কুমীর। উদ্বেকজনক ভাবে হ্রাস পাচ্ছিল “কি ডিয়ার” ও “কি র্যাট” যা শুধু মাত্র এই ফ্লোরিডা অঞ্চলেই পাওয়া যায়।
জন্তু জানোয়ার, অজস্র পাখি, জলের তলার প্রবাল প্রাচীর, আন্ডার ওয়াটার হোটেল, ডলফিন আর প্রাকিতিক সৌন্দর্যের টানে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক হাজির হন ক্যে লারগো তে। আর সেই আকর্ষণের অন্যতম জন্তু জানোয়ারের দল উধাও হয়ে যেতে বসেছে। খরগোশ, রেকুন যা নাকি অহরহ দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো পর্যন্ত নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে বিপুল সংখ্যায়।
এর পেছনে যে পাইথন বা আজগর সাপ সেটা শনাক্ত করা গেলেও এই পাইথনদের মারতে সেভাবে কিছু করে উঠতে পারছিল না সরকার।
এই সমস্যা টাএকদিনে সৃষ্টি হয় নি। ১৯৮০ সালে ফ্লোরিডার জলাভুমিতে বার্মিজ পাইথনের উপস্থিতি টের পাওয়া গেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষত ফ্লোরিডা প্রদেশের অনেক বাসিন্দাই বাড়িতে সাপ পোষে। বিশেষত বার্মিজ পাইথন। তাদেরই কেউ কেউ হয়ত পোষা সাপ জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিল বা কারো হেফাজত থেকে পালিয়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে ছিল এই বার্মিজ পাইথন, তারপর জঙ্গলে এরা বংশবৃদ্ধি করছিল।
কয়েক বছর আগের সরকারি হিসেব অনুযায়ী পাইথনের সংখ্যা ছিল দশ হাজারের কাছাকাছি।
অনেক চেষ্টা হয়েছে পাইথন মারার। ফ্লোরিডা ফিশ অ্যান্ড প্রোজেক্ট ওয়াইল্ডলাইফ কমিশন ইউনিক প্রোজেক্ট নামে একটি প্রকল্প তৈরি করে “পাইথন চ্যালেঞ্জ” নামে শিকার প্রতিযোগিতা করছেন। সব চাইতে বড় পাইথন শিকারের জন্যে ১৫০০ ডলার পর্যন্ত পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন ।পাইথন দ্যাখা মাত্র খবর দেবার জন্যে মোবাইল ফোনের জন্যে বিশেষ অ্যাপলিকেশান তৈরি করা হয়েছে । এত করেও কোন লাভ হয় নি। কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে সামান্য কিছু পাইথন মারা সম্ভব হয়েছে। এদিকে মোবাইলের মাধ্যমে পাইথনের অনেক ধরনের ভিডিও ও ছবি সংক্রমণের মত ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে চার দিকে।
বার্মিজ পাইথন ভাল লুকিয়ে থাকতে পারে প্রকৃতির মাঝে। চট করে এদের উপস্থিতি টের পাওয়া মুস্কিল। অধিকাংশ সময় রাতের অন্ধকারে ক্যে লারগোর জলার ধারের রাস্তায় শিকার গিলে পড়ে থাকতে দ্যাখা গেছে পাইথনকে। রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে অনেকে পাইথনের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছেন, পরে গাড়ি ঘুরিয়ে এসে দেখেছেন পাইথন উধাও হয়ে গেছে। গলা কেটে না ফেললে নাকি পাইথন মরে না।
গত সাত বছর ধরে ফ্লোরিডার ইন্সিটিউট অফ ফ্লোরিডা ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল সাইন্সএর গভেষক বিশেষজ্ঞরা দুটো ল্যাবরেডর কুকুরকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সাহায্য নিয়ে ফ্লোরিডা প্রদেশ, বিশেষত ক্যে লারগো দ্বীপের আশপাশ থেকে পাইথন খুঁজে বের করে তাদের মেরে ফেলে ক্যে লারগোকে পাইথন মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। পাইথন বেড়েই চলেছে ক্যে লারগো তে।
ক্যে লারগো চেম্বার অফ কমার্স এর প্রেসিডেন্ট এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তাঁদের সবরকম প্রচেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ না হওয়ায় দুনিয়ার তাবড় তাবড় সর্প বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ মেনে উড়িয়ে আনা হয়েছে ভারতের ইরুলা উপজাতির দুই অভিজ্ঞ সাপ ধরিয়েকে। ফল মিলতেও শুরু করছে।
দু সপ্তাহে এরা ক্যে লারগোর জলা থেকে তেরোটা পাইথন ধরেছে। তার মধ্যে একটা ষোল ফুট লম্বা। অদ্ভুত এদের সাপ খুঁজে বের করার ক্ষমতা। এরা জলা জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে মাটি, কাদা, গাছপালা দেখে, আশপাশের গন্ধ শুকে বলে দিচ্ছে কোথায় সাপ আছে। বিদেশী বার্মিজ পাইথন বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি নয়, তাই এই সাপ ধরে তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে।
ইরুলা উপজাতির দুই সর্প বিশারদ সেখানকার বনকর্মীদের শেখাচ্ছে কী করে পাইথন খুঁজে বের করে মারতে হবে। আশাকরি কয়েক মাসের মধ্যেই ফ্লোরিডা পাইথন আতঙ্ক মুক্ত হবে।
বিচিত্র দুনিয়া–সব এপিসোড একসঙ্গে