অরিন্দম দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
পোষ্যের অন্তিমযাত্রা
অরিন্দম দেবনাথ
একটা নয়, দুটো নয়, সার দিয়ে মঠ-প্রাঙ্গনে শুয়ে ১১৪টি মৃতদেহ। বৌদ্ধ পুরোহিতরা পুজোর পোশাকে নীরবে প্রস্তুত হচ্ছেন মৃত আত্মার শান্তি-কামনায়। গুরুগম্ভীর মন্ত্র অনুরণিত হচ্ছে মন্দিরের আনাচে-কানাচে। স্নিগ্ধগন্ধ ছড়িয়ে ধূপের ধোঁয়া কাঁপতে কাঁপতে উঠে চলেছে আকাশপানে। হে পরমাত্মা, পার্থিবআত্মাকে স্থান দাও তোমার চরণে!
একটা কথা বলা হয়নি। শুয়ে থাকা ১১৪টি মৃতদেহ হল ১১৪টি কুকুরের। সাধারণত কেউ পালিত কুকুরের মৃতদেহ নিয়ে কোন মঠ, মন্দির, গির্জা বা মসজিদে যায় না। মাটি খোঁড়ার জন্য একটি শাবল আর একখণ্ড জমিই যথেষ্ট। কেউ কেউ আবার একটুকরো পাথরে পোষ্য সম্পর্কে কিছু কথা লিখে কবরের ওপরে পাথরটা রেখে দেয়। মঠ প্রাঙ্গণে শায়িত প্রতিকটা কুকুরের গলায় তার নাম, গোত্র, জন্মতারিখ, মালিকের নাম, মৃত্যুদিন, ইত্যাদি লেখা একটা করে ট্যাগ আটকানো।
কিন্তু ১১৪টা পোষা কুকুরের শেষকৃত্যের জন্য এত আয়োজন কেন? আর এত কুকুরের শব এল’ই বা কোথা থেকে? ওহো আবার একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। এই ১১৪টা কুকুর আবার যে সে কুকুর নয়। একটা বিশেষ গোত্রের কুকুর। গোত্রটির নাম ইবো (Aibo)। ইয়ে… মানে… এরা কুকুর হলেও ঠিক রক্তমাংসের কুকুর নয়। এরা হল সোনি কোম্পানির তৈরি প্রথম রোবট কুকুর।
১৯৯৯ সালে মাত্র ৩০০০ টি রোবটিক কুকুর তৈরি করে বাজারে ছেড়েছিল সোনি। দাম ছিল রোবট প্রতি দু’হাজার মার্কিন ডলার! মাত্র ২০ মিনিটে বিনোদনের জন্য তৈরি রোবটগুলো সব বিক্রি হয়েগেছিল। এরপর সোনি আরও দেড়লক্ষ রোবট কুকুর তৈরি করার পর, ২০০৬ সালে রোবটিক কুকুরের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। সংস্থার বেহাল আর্থিক দশার জন্য ২০১৪ সাল থেকে এই কুকুর মেরামতির কাজও বন্ধ হয়ে যায়। কুকুরের মালিকরা দিশেহারা হয়ে পরে। বিকল পোষ্য নিয়ে তারা কী করবে! যান্ত্রিক হলে হবে কি, মালিকের যে খুব আত্মিক হয়ে পরেছিল এরা!
টোকিওর কাছের একটা শহর সুমির (Isumi) সাড়ে চারশো বছরের প্রাচীন এক মন্দির ‘কফুকুজি’ ইতিমধ্যে আটশো ‘ইবো’র শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে।
জানুয়ারি ২০১৮তে সোনি আবার ফিরিয়ে নিয়ে এ’ল ইবোকে। এবার নতুন রূপে। নাম দিল ইবো-১। এতে জুড়ে দিল ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা। যাতে করে কুকুরের স্বত্বাধিকারী তার সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখতে পারে। কিন্তু প্রথম ইবোর মালিকরা, সোনির উপর চাপ দিল তাদের বিকল হয়ে যাওয়া ইবোকে সারিয়ে দিতে। কিন্তু সোনি জানাল এই পুরোন রোবটদের সারাতে তারা অক্ষম। পরিবর্তে তাঁরা পুরোন ইলেক্ট্রনিকস দ্রব্য মেরামত করে এরকম একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল। ওই প্রতিষ্ঠান কফুকুজির মন্দির থেকে শেষকৃত্য হয়ে যাওয়া মৃত রোবটদের দেহ সংগ্রহ করে নিয়ে এসে তাদের দেহাংশ খুলে অনেক ইবোর প্রান প্রতিস্থাপন করেছে।
মন্দিরে শেষকৃত্যের জন্য পাঠানো এক ইবোর মালিকই জনান্তিকে জানিয়েছেন, “ইবোকে বিদায় দেবার সময় চোখের জল বাধা মানেনি, একটাই সান্তনা মঠ ওকে যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেয়নি। ওর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে মঠাধ্যক্ষ। আমার ইবোর শরীরের অংশ দিয়ে যদি আর একটা ইবো সচল হয়, তারথেকে আর আনন্দদায়ক আর কিছু হবে না।”
কফুকুজির মন্দিরের পুরোহিতরা যন্ত্রের শেষকৃত্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না। ওই মঠের এক পুরোহিত বাঙ্গেন ওই-এর কথায়, “প্রাণহীন কোন বস্তু হয় না। সবকিছুরই আত্মা আছে!”
তথ্যসূত্র – দি গার্ডিয়ান।
বেশ লাগলো…এই কুকুর কে নিয়ে অনুপ্রাণিত নেটফ্লিক্স এর ব্ল্যাক মিরর সিজন এ একটা হাড় হিম করা এপিসোড আছে
LikeLike