অরিন্দম দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
মই ছাড়া বলদ-দৌড়
গ্রামের নিজস্ব খেলার অভাব নেই এ-দেশে। অধিকাংশই হারিয়ে যেতে বসেছে চর্চা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। এরকমই একটি খেলা বলদ-দৌড়। আষাঢ় মাসে ধান রোয়ার আগে, চাষের ক্ষেতে বলদের কাঁধে ফেলা জোয়ালের সঙ্গে মই জুড়ে, সেই মইএর ওপর দাঁড়িয়ে, বলদকে ছুটিয়ে জলভরা চাষের জমিকে সুফলা করে তোলার রেওয়াজ থেকে এই খেলার জন্ম। দক্ষিণ ২৪-পরগনার ক্যানিং শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে হেরোভাঙ্গার মেরীগঞ্জ টাটপাড়া গ্রামে ১৫-১৬ আষাঢ় ১৪২৫, তরুণ-সঙ্ঘ আয়োজিত বলদ দৌড় দেখে এসেছেন – অরিন্দম দেবনাথ
“লেজের ডগায় হাতের মোচড়টাই আসল, বোঝলেন? ওই মোচড়েই বলদ ছোটে, তবে ছোট কাঠের টুকরোর ওপর জলভরা কাদা জমিতে পাগলের মত ছুটতে থাকা বলদের ভেজা লেজ আঁইকড়ে দাঁইড়ে থাকাটাই কঠিন। একবার লেজ হাত থেকে ছুটি গেলি আপনিও পড়বেন আর বলদও ছোটা বন্ধ করি দিবে। এই খেলায় জিততি হলি ওই লেজটি ছাড়া চলবি না।” বলল সদ্য মাঠে একপাক বলদ নিয়ে দৌড়ে আসা প্রতিযোগী আরাবাত শেখ।
হলুদ হাফপ্যান্ট আর বেগুনী গেঞ্জি পরা কাদামাখা জলেভেজা শরীর নিয়ে আরাবাত, গুপ্তকথা শোনানোর মত প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, “এই অবোলা জীবগুলোর সঙ্গে প্রাণের যোগ তৈরি করতি না পারলি কিছু হবে না। জীবগুলোরে নিজে হাতে পরিচর্যা করতি হবে, খাওয়াইতে হবে তবে না ওরা আপনার কথা শুইনবে।”
“আর হইল গিয়ে প্যরাকটিস, দৌড়ের অন্তত মাস খানিক আগে থিকে রোজ কাঁড়ার কাঁধে জোয়ালের সঙ্গে দড়ি বেইন্ধে তাতে ছোট কাঠের পাটাতন লটকে চাষের মাঠে দউড়তি হবে, তবে না বশে আসবে আপনার বলদ।” দুই বলদ নিয়ে একটা দল। এই দলকে বলে কাঁড়া।
“দুই কাঁড়া যখন একসঙ্গে দৌড়িবে, তখন তো দুই কাঁড়াই একই দড়িতে বাঁধা। দুই কাঁড়াই তো একসঙ্গে ছুইটবে। আমরা দুই ময়েল, মানে যারা জমিতে মই দি, তারাও তো দাঁইরে থাকব ওই একটাই বাঁশের ওপর। ধান বোনার আগে জমি ময়েল মানে নরম করতি কাদা মাটির ওপর দিয়ে মইয়ের ওপর দাঁইরি কাঁড়াকে ছোটাতি হয়। এইখানে বলদ দৌড় লড়াইয়ে কাঁড়ার পিছনে মই থাকে না। তাই এই দৌড়ের নাম ‘মইছাড়া’।”
“তা আমরা দুই ময়েলই তো চেইষ্টা করব কে আগে কাঁড়া নিয়ে ওই বাঁশের মাথায় বাঁধা গামছার কাছে আগে পঁউছতি পারে। এইবার একই দড়িতে বাঁধা দুই কাঁড়া আর ময়েলের মধ্যি টানটানি চলে। যে আগে আলের বাইরে চইলে যাবে সে আউট। ডানদিকের কাঁড়া আগে বাইরে চইলে গেলে সে আউট। আবার বাঁ দিকের কাঁড়া আগে চইলে গেলে সে আউট।”
কিন্তু খেলার আসল মোচড় রয়ে গেছে শুরুর জায়গায়। জনা তিরিশ লোক মিলে দুই কাঁড়াকে একসঙ্গে দড়িতে বেঁধে দৌড়তে ছাড়ে। এদেরকে বলে ‘ধরালোক’। এদের মুন্সিয়ানার ওপরেও নির্ভর করে ময়েলের ভাগ্য। এরাই বলদগুলোকে উত্তেজিত করে। অনেক সময় দৌড় শুরুর আগেই কাঁড়াগুলো ক্ষেপে গিয়ে ঘুরে যায় উল্টোদিকে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ক্রমাগত জন্তুগুলোর গায়ে জল ছিটিয়ে শান্ত করে দৌড় শুরু করাতে হয়। দৌড় শুরু হয়ে গেলে এই ধরালোকেরাও ছুটতে থাকে দৌড়বাজ কাঁড়া আর ময়েলদের পেছন পেছন। কোন কারনে জন্তুগুলো মুখ থুবড়ে পড়লে এই ধরালোক’ই মুহূর্তে ফাঁস খুলে দাঁড় করায় বলদগুলোকে। আরেকটা ঘটনাও নজরে এল, বলদদের উত্তেজিত করতে দৌড়ের সময় ময়েলরা বলদের লেজ দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকেন। ব্যাথায় প্রাণপণে ছুটতে থাকে অবোলা জীব!
বলদের আকার অনুযায়ী বিভাগ নির্বাচিত হয়। ছোট আকৃতির বলদ নিয়ে ‘খ’ বিভাগ আর বড় আকৃতির বলদ নিয়ে ‘ক’ বিভাগ।
১৯৯১ সাল থেকে হয়ে চলা এই দৌড় প্রতিযোগিতায় মোট ৪৬ কাঁড়া এবার এসেছে দৌড়ের জন্য। একদম ফুটবলের মত নিয়মে দৌড় চলে। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে দৌড়োয় আটজোড়া কাঁড়া। সেখান থেকে সেমিফাইনালে ওঠে চার জোড়া। তারপর প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার লড়াই।
প্রতিযোগিতায় যোগদানকারীরা মুলত উত্তর ও দক্ষিণ পরগণার চাষি সম্প্রদায়। বয়সের কোন সীমা নেই। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে কোন অর্থ লাগে না। শুধু বলদ সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়। জোয়াল ও দড়ির জোগানদার আয়োজকরা। কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলেই পুরস্কার মেলে। স্টিলের আলমারি, শোকেস, সাইকেল, টেবিল ফ্যান।
ছবি – অরিন্দম দেবনাথ
বিচিত্র দুনিয়া সমস্ত লেখা একত্রে