এক ছিল চাষী আর চাষীবউ, আর ছিল তাদের এক ছেলে কুজমা। কুজমা লোকটা ভাল। দেখতেও রাজপুত্রের মতন। কিন্তু হলে কী হয়, বড্ড মাথামোটা আর অকর্মার ধাড়ি। শেষমেষ একদিন বিরক্ত হয়ে চাষীবউ চাষীকে ডেকে বলে, এ ছেলে তো এমন করে কোনদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না, হ্যাঁগো। তার চেয়ে একে সময় থাকতে আলাদা করে দাও। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক।
চাষী তখন ছেলেকে একটা বেতো ঘোড়া, জঙ্গলের ভেতরে এক ভাঙা কুঁড়ে, পাঁচটা মুরগি আর একটা কুঁকড়ো দিয়ে বলল, “এইবারে থেকে নিজের খাবার নিজে জোগাড় করে খাবি তুই।
খন কুজমা বেচারা সেই জঙ্গলের কুঁড়েঘরে গিয়ে বাস করল। সে জঙ্গলে থাকত এক খ্যাঁকশেয়ালনী। সে ঠিক কুজমার মুরগিদের গন্ধ পেয়েছে। একদিন যেই কুজমা গেছে শিকার করতে, সেই ফাঁকে সে তার কুঁড়েয় এসে একখানা মুরগিকে মেরে, তার রোস্ট বানিয়ে আরাম করে খেয়ে ফের জঙ্গলে ফিরে গেছে।
দিনের শেষে কুঁড়েয় ফিরে কুজমা দেখে মুরগি একখানা কম। কে নিল তার মুরগি? ভেবে ভেবেও সে তার হিসেব পায় না।
পরদিন সে যখন ফের শিকারে বের হয়েছে তখন দেখে পথের ওপর এক ছোট্টো খ্যাঁকশিয়ালি তড়বড়িয়ে উল্টোমুখ যাচ্ছে। কুজমাকে দেখে সে মিষ্টি হেসে বলল, “চাষার পো চললে কোথা?”
“এই যাই একটু শিকার করে আসি গে,” জবাব দিল কুজমা।
“তা বেশ বেশ। যাও—” এই বলে খ্যাঁকশিয়ালনী চলে গেল কুজমার ঘরের দিকে।
সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে কুজমা দেখে আরো একটা মুরগি কমে গেছে তার। এইবার তার সন্দেহ হল, খ্যাঁকশিয়ালনীটাই তার মুরগি চুরি করে খাচ্ছে না তো? পরদিন সকালে যখন সে বের হল শিকারে তখন ঘরের সব দরজা জানালা ভালো করে পেরেক ঠুকে বন্ধ করে দিয়ে বের হল সে। খানিক দূর গিয়ে ফের খ্যাঁকশিয়ালনীর সাথে দেখা। কুজমাকে দেখে একগাল হেসে সে ফের এগোল নিজের পথে। খানিক বাদে কুজমাও গুটিগুটি নিজের বাড়ির দিকে ফিরল কী হয় এবারে তা দেখতে।
ফিরে এসে সে দেখে ঘরের চারদিক ঘুরেও ঢোকবার পথ না পেয়ে খ্যাঁকশিয়ালনী গিয়ে উঠেছে ছাদে। সেখান থেকে চিমনি বেয়ে ভেতরে ঢুকে আরো একটা মুরগি ধরবার তাল করেছে সে,ঠিক তক্ষুণি দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে কুজমা। চোর একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে।
ধরা পড়ে খ্যাঁকশিয়ালনীর সে কী আকুলিবিকুলি— “ও কুজমা আমায় মারিস না রে। আমি রাজকন্যার সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। আর কোনদিন কাজ করে খেতে হবে না তোকে। পায়ের ওপর পা তুলে আরামে থাকবি তুই।”
“কী যে বলিস! আমি হলাম গিয়ে গরিব মানুষ। আমায় রাজা তার মেয়ে দেবে কেন?”
“থাম দেখি তুই। সে ভাবনা আমার। এই জঙ্গলের পেছনে এক রাজ্য আছে। তার রাজার নাম ওগন আর রানির নাম মলনিয়া। তাদের একটা পরমাসুন্দরী মেয়ে আছে। আমায় আর একখানা মুরগি খেতে দিলে আমি তার সঙ্গে তোর বিয়ের বন্দোবস্ত করে দেব।”
কুজমা তখন আরো একখানা মুরগি ধরে দিল খ্যাঁকশিয়ালনীকে। সেই খেয়েদেয়ে মুখটা মুছে সে বলল, “যাই। গিয়ে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করে আসি।”
এই বলে সে এক ছুটে জঙ্গল পেরিয়ে সটান রাজার সভায় গিয়ে হাজির। প্রণাম করে বলে, “মহারাজের জয় হোক। মহারানির জয় হোক।”
রাজা শুনে বলে, “কী হে খ্যাঁকশিয়ালনী? আমাদের জন্য কোন খবর আছে নাকি?”
“আছে মহারাজ। তাই তো দৌড়ে এলাম। রাজকন্যার জন্য খাসা পাত্রের খোঁজ এনেছি আমি। তার নাম কুজমা স্ক্রোবোগাতি।”
“খাসা পাত্র? তা সে নিজে না এসে তোমায় পাঠালো যে বড়ো? নিজেকেই আসতে বলো না!”
“সে ভয়ানক ব্যস্ত মানুষ রাজামশাই। গোটা জঙ্গলের সব জীবজন্তুদের রাজা সে। সেই নিয়ে সর্বদাই ব্যস্ত থকে বেচারা।”
“অ। রাজকন্যাকে বিয়ে করবার শখ চেপেছে বুঝি তার? ঠিক আছে। গিয়ে তাকে বল, জঙ্গলের রাজা যখন, তখন দেড় হাজার নেকড়ে পাঠিয়ে দিক কাল আমার কাছ। তবে বুঝি তার কেরামতি।”
“তাই হবে মহারাজ,” এই বলে রাজাকে সেলাম করে খ্যাঁকশিয়ালনী ছুটতে ছুটতে এল কুজমার কাছে।
“শিগগির একটা মুরগি দাও দেখি! খিদে পেয়েছে জোর,” এই বলে কুজমার থেকে ফের একটা মুরগি নিয়ে পেট ভরে খেয়ে সে হাজির হল বনের মাঝের বিরাট মাঠটাতে। সেখানে এসে সে শুধু মাঠের মাঝে গড়ায় আর গড়ায়। দেখে খানিক বাদে, মাঠে হাওয়া খেতে আসা এক নেকড়ে বলে, “হ্যাঁরে, কোথাও বুঝি বেজায় ভালো ভোজ খেয়েছিস?”
“খেয়েছি মানে?” খ্যাঁকশিয়ালনী জবাব দিল, “উফ্ফ্! রাজার বাড়ি নেমন্তন্ন বলে কথা!”
“রাজার বাড়ি নেমন্তন্ন? ব্যাপারখানা কী ?”
“অ্যাঁ! তোমাদের নেমন্তন্ন করেনি?”
“কই? না তো!”
“হতেই পারে না! গোটা জঙ্গল আজ সেখানে হাজির। বাঘ, সিংহ, খরগোশ–সব। আমি যখন উঠে আসছি ভালুকরা তো তখনো খেয়ে চলেছে গবগবিয়ে-”
এই শুনে নেকড়ে তো খ্যাঁকশিয়ালনীর হাতপায়ে ধরছে, “আমাদের একটিবার নিয়ে চল না রে!”
“আচ্ছা বাবা আচ্ছা। নেব। কাল ভোরভোর দেড় হাজার নেকড়ে মিলে এই মাঠে হাজির হবি। আমি তোদের পথ দেখিয়ে রাজার ভোজে নিয়ে যাব।”
তাই হল। পরদিন দুপুরে দেড় হাজার নেকড়ের দল নিয়ে রাজবাড়িতে হাজির হল খ্যাঁকশিয়ালনী। রাজার উঠোনে তাদের সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রাজাকে গিয়ে খবর দিল, “চলুন রাজামশাই। যেমন চেয়ছিলেন ঠিক তেমন ভেট পাঠিয়েছে হবু জামাই আপনাকে।”
বাইরে এসে সব দেখে রাজার তো চক্ষুস্থির। এত নেকড়ে একত্রে তিনি কখনো দেখেননি। তাদের নিজের চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দিয়ে রাজা এবারে চাইলেন দেড় হাজার ভালুক, তারপর দেড় হাজার নেউল। একে একে সেইসব জুটিয় এনে দিল খ্যাঁকশিয়ালনী। প্রত্যেকবার শুধু সে কুজমার কাছ থেকে একটা করে মুরগি নিয়ে খেয়ে পেট মোটা করে আর রাজাকে বনের জন্তু ধরে এনে দেয়। নেউল এনে দেবার পর সে বলল, “মহারাজ, রাজপুত্র কুজমার আসবার সময় হয়েছে এবার। আপনার জন্য বেজায় সব উপহার সাজাচ্ছেন তিনি। একটা গম মাপবার গামলা দেবেন?”
“গামলা কেন হে? কী হবে তাতে?”
“আজ্ঞে, তেনার দুশোখানা গামলার সবকটাই তো উপহারের সোনায় ঠাসা। এখন তিনি উপহারের জন্য রুপো মাপবেন কী দিয়ে? তাই চাইছিলাম আর কি!”
“আচ্ছা বেশ। নিয়ে যাও।” এই বলে তাকে গামলা দিয়ে বিদেয় করে রাজা রানিকে বললেন, “মনে হচ্ছে একখানা জামাইয়ের মত জামাই পাব, বুঝলে?”
পরদিন সকাল হতে না হতে খ্যাঁকশিয়ালনী গামলা ফেরৎ দিতে রাজসভায় হাজির। সবাই দেখল, সে গামলার ভেতর এখানেওখানে লেগে আছে ঝলমলে সব রুপোর টুকরো। গামলা ফেরৎ দিয়ে সে বলল, “আজ দুপুরের পর রাজপুত্র কুজমা আসছেন মহারাজ। আমি যাই , তাকে নিয়ে আসি।”
এই বলে এক দৌড়ে বনের ভেতর কুজমার কুঁড়েয় গিয়ে সে হাঁকডাক লাগিয়েছে, “ওঠো ওঠো। রাজকন্যা বিয়ে করতে যাবে না?”
কুজমা তখন বারান্দায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। ডাক শুনে উঠে বলে, “বল কী? ছেঁড়া পোশাকে বেতো ঘোড়ায় চেপে রাজকন্যা বিয়ে করতে যাব?”
“সে সব আমার ভাবনা। এখন তুমি চল তো!”
কাজেই তখন ছেঁড়া কাঁথা গায়ে জড়িয়ে বেতো ঘোড়ার পিঠে চেপে হ্যাট হ্যাট করতে করতে কুজমা চলল রাজকন্যাকে বিয়ে করতে।
জঙ্গল ছাড়িয়ে রাজার রাজত্বে ঢুকেই একটা নদী। তার ওপরের কাঠের সেতু। সেইখানে এসে কুজমাকে থামাল খ্যাঁকশিয়ালনী, “ঘোড়া থেকে নাম দেখি। তারপর সেতুর খুঁটিগুলোর গোড়া কেটে ফেল চটপট।”
“সে কী? কেন?”
রাজকন্যা বিয়ে করবার ওই কায়দা রে বোকা। নে, এখন কাট চটপট।”
কুজমা আর কী করে! ঘোড়া থেকে নেমে কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে কেটে ফেলল সেতুর খুঁটিগুলো। হুড়মুড় করে সেতু ভেঙে পড়ল নদীর জলে।
“যা। এবার ঘোড়াটাকে তাড়িয়ে দিয়ে, তোর ছেঁড়া জামাকাপড়, কাঁথা সব নদীর জলে ফেলে দে। তারপর নদীর ধারের বালিতে গিয়ে শুয়ে থাক চুপটি করে—” এই বলে তাকে কায়দাটা বুঝিয়ে, কখন কী করতে হবে সব বলেটলে দিয়ে খ্যাঁকশিয়ালনী ফের ছুটল রাজার বাড়ির দিকে।
রাজবাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেই খ্যাঁকশিয়ালনী আকাশ ফাটানো চিৎকার জুড়েছে, “বাঁচাও—বাঁচাও—রাজপুত্তুরের প্রাণ যায়—কে কোথায় আছ–”
শুনে রাজারানি দৌড়ে বেরোতে খ্যাঁকশিয়ালনী চোখের জলে ভেসে বলে, “সব দোষ আপনার রাজত্বের ওই নড়বড়ে সেতুটার। আপনার জন্যে যত উপহার নিয়ে কুজমা আসছিল, তার ভারে সেতু ভেঙে সবশুদ্ধ নদীর জলে ডুবে গেছে। শুধু রাজপুত্র নিজে কোনক্রমে—”
রাজার তখন আর কোনদিকে খেয়াল নেই। গোটা রাজ্যের লোকের সঙ্গে তিনিও ছুট মেরেছেন নদীর দিকে। সেখানে সোনালী বালির বুকে সত্যিই কে যেন শুয়ে ছিল। গিয়ে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল সে-ই রাজপুত্র কুজমা।
তারপর আর কী! কুজমার সাথে রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেল আর খ্যাঁকশিয়ালনী পেল সে দেশের মন্ত্রীর চাকরিটা।