আগের পর্বগুলো যাদবের অসাধ্য সাধন, মহিলা দিবস , পাংসাও পাস
দিল্লী-৪৮, মুম্বাই-৩৯, চেন্নাই-৪০, হায়দ্রাবাদ-৪২, দেরাদুন-৩৮, কোলকাতা-৪০, আমেদাবাদ-৪৪ – এইটুকু জেনেই টিভি বন্ধ করে দিলাম – উফ্ – যেন ছ্যাঁকা লাগছে! কারণ এই প্রত্যেকটা শহরেই স্বজনবন্ধুরা আছেন ও তাদের কষ্টের কথা ভেবেই আকুল হচ্ছি! সপ্তাহান্তে শুধু একটা ফোন করে দুটো ভাল কথা বলা ছাড়া যে আর কিছুই করতে পারছি না তাদের জন্য… তাই ভাবলাম যে ওদের কষ্টটা কম করতে একটা ‘ঠান্ডা ঠান্ডা, কুল কুল’ জায়গায় “মানস ভ্রমণ” করালে কেমন হয়!
এই গরমের মাঝেই টুপি-সোয়েটার পরে ঠান্ডার আমেজ গায়ে মেখে, খাসি-উপজাতি আয়োজিত একটি উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলাম শিলং ছাড়িয়ে ‘মফ্লং’ প্রান্তে – পাহাড়ি উপত্যকায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নীল আকাশ ও সবুজ জঙ্গলে মাখামাখি হয়ে এক মনভোলানো পরিবেশে কিছু সময় কাটাব বলে।
মেঘালয় রাজ্যে মূলত তিনটি প্রজাতির প্রাধান্য- গারো, খাসি ও জয়ন্তিয়া। এরা এক বৃহৎ বংশোদ্ভূত ও এদের ভাষা, জীবনযাত্রা ও জীবিকার মধ্যেও যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ওদের পূর্বপুরুষেরা নাকি পশ্চিম কাম্পুচিয়া বা বর্মা থেকে ভারতে এসেছিল ও Kupli নদী তীরে Nowgong, Lumding, Haflong (যা এখন আসামে) এসে বসবাস শুরু করে। ওরা শুধু নিজেরাই আসেনি, সাথে এনেছে – Mon-Khmer ভাষা, যার মিল Thailand, Cambodia র প্রজাতির ভাষার সাথে আছে।
খাসিদের এই সব খাস তথ্য আমি পেয়েছিলাম এক মহিলা কর্মাধ্যক্ষের কাছ থেকে, যার সাথে উৎসবে পৌঁছে আলাপ হয়েছিল। কর্মসুত্রে তিনি স্থানীয় এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খাসি’ ভাষায় অধ্যাপনা করেন। ওঁর সাহচর্যে ধন্য হলাম কারণ খাসিদের সম্পর্কে কিছু জ্ঞান প্রাপ্তি হল। উনি জানালেন যে ওদের প্রধান জীবিকা agriculture ও horticulture। ওরা মূলত বিভিন্ন ধরনের চাল, ভুট্টা, মিষ্টি আলু, তেজপাতা, হলুদ, আদা, এছাড়া নানারকমের ফল, ফুল, মধু এবং পান ও সুপারীর চাষ করে থাকে। পশুপালনও এদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে বরাহ ও গরু প্রধান সারিতে। কারণটা পরে জানাব।
সুন্দরী খাসি অধ্যাপিকা মজা করে এও বললেন যে খাসিরা নাকি ‘ব্যাবসা’ খুব ভাল বোঝে, তাই যেকোনো খাসি অধ্যুসিত এলাকাতেই চোখে পড়বে ছোট ছোট পসরা সাজানো ‘হাট’, যার শতভাগে মহিলারা, কারণ এখানকার সমাজব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। একটি প্রজাতিকে বুঝতে একটা ‘হাট’ই যথেষ্ট, তা আমিও স্থানীয় উৎসবে যোগ দিয়ে টের পেলাম।
মেলাপ্রাঙ্গনে পৌঁছতে কচি কচি ‘স্বেচ্ছাসেবক’ ছেলেমেয়েরা আমাদের জানাল যে গাড়ি রাখতে হবে অনেক দূরে, ‘পার্কিং লটে’ ও বাকিটা পায়ে হেঁটে ঘুরতে হবে। ওদের স্বচ্ছতা সম্পর্কে সাবধানী বার্তা বুঝিয়ে দিল যে ওই ব্যপারটা ওদের জন্য কতটাই মুল্যবান। ওদের দৃপ্তভঙ্গি, কর্মনিষ্ঠা, ও উদ্যোগ দেখে বেশ লাগল– মনে হল সত্যিই ওরাও যে কোনো বড় শহরের ছেলেমেয়েদের সাথে হাতে হাত ধরে চলার যোগ্য! ঢুকতেই চোখে পড়ল বেত ও বাঁশের তৈরি নানান ধরনের ঝুড়ি, টুপি, মাদুর, আসন, বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য মাথার সাজ – আরো কত কী! ভাবতে পার – প্রায় ৪০ রকমের বাঁশ দেখলাম! এই বাঁশের তৈরী Conical Basket (ka-Khoh) ও head strap (U-star) পেলাম যা ওরা পিঠে নিয়ে স্ট্র্যাপ মাথায় ঝুলিয়ে ঝুঁকে পড়ে পাহাড়ী রাস্তায় সামগ্রী নিয়ে আনাগোনা করে। ঐ ঠাণ্ডায় গরম চা-এ চুমুক দিতে দিতে পাশে সিল্কের বস্ত্রের উপর চোখ আটকে গেল। সেখানেও কত বৈচিত্র্য – এই এরি সিল্ক জয়ন্তিয়া পাহাড়ের Khyrwang-Nongtung গ্রামে বেশি প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ। বিভিন্ন উপজাতি ও অঞ্চলের ভিত্তিতে কিভাবে রং ও কারুকার্যের পরিবর্তন হচ্ছে, তা অবাক হয়ে দেখলাম। কী গুণী যে ঐ মানুষগুলি ভাবা যায় না! অথচ কত সরল ও গরীব। ওদের সারল্য ও ‘না-জানার’ হাসিটা সত্যিই মনমুগ্ধকর। ভাষা বুঝতে না পেরে ঐ গ্রামেরই এক মহিলা যখন আমার দিকে খিলিকরা একটি পান এগিয়ে দিল, তখন ভাষার কথা মাথায়ই আসেনি – নাই বা বুঝলাম ভাষা – প্রাণের ভাষাটাই বড় হয়ে উঠল – আমিও উৎসাহভরে পানটি মুখে পুরে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না কি তৃপ্তি হল – ওটা চরম অনুভবের!
মুখে ‘পান’ নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি – আমি একা – সাথীরা ব্যস্ত হয়ে গেছে ‘Archery’ খেলায়, যা খাসিদের জাতিগত ঐতিহ্যশালী ও গর্বের খেলা তবে এখন প্রায় লুপ্ত – জুয়ার সাথে যুক্ত হয়ে এর এখনকার নাম “টীর বা Thoh Kyntip” – যা ছোট্ট ঘুপচি দোকান থেকে খেলা হয় এবং মেঘালয়ের রাস্তায় অবশ্যই চোখে পড়বে। এদিকে আমাকে ‘পান’ খেতে দেখে দলের অন্যরা দেখি বেশ বড়সড় এক বাঁশের মগে কি যেন তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে। কাছে যেতে জানলাম যে ওরা খাসিদের প্রাণের পানীয় ‘Rice Beer’ সেবন করছে – যা জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ সব ধর্মীয় তথা সামাজিক অনুষ্ঠানের এক বিশাল অঙ্গ। শুধু এই নয়, আনারস, পিচ, চেরি ও আরো অনেক ফল থেকে এরা ‘Local Wine’ তৈরি করে, যার বিক্রিও চোখে পড়ল।
ইতিমধ্যে, ক্ষিদে তো পেয়েছে সকলেরই – তাই ফুড কোর্টে পা রাখতেই এক অদ্ভুত সরস দৃশ্য চোখে পড়ল। আবারও মহিলারাই নানানরকম ‘রাইস কেক’, চালের ব্যঞ্জন, সুপ, মাংস (শুয়োর, গরুই প্রধান – এবার বুঝতে পারছেন সুত্রটা…), ডিম, শুকনো মাছের পদ সাজিয়ে হাসিমুখে বিক্রীর জন্য প্রস্তুত!! সাথে ঘরে তৈরী আচার (নিরামিষ ও আমিষ), জ্যাম, তেজপাতা, হলুদ ও রংবাহারি ফলের পসরা। কী রঙিন সব! খাব কী, সকলে দেখতে ও চিনতেই মশগুল যে! ওহো – বাঁশের বিভিন্ন অংশের পদ ও বাঁশকে বাসন হিসেবে রান্নায় ব্যবহার – সত্যিই অভিনব!
হঠাৎই মেয়ে বায়না ধরল যে ‘মাটির পাত্র’ কিনবে বন্ধুদের জন্য। অবাক হলাম। এখানে মাটির পাত্র? সে টানতে টানতে নিয়ে গেল দেখাতে যেখানে মহিলারা ‘Potter’s Wheel’ ছাড়াই হাত দিয়ে নানান রকম মাটির জিনিস তৈরি করছেন। জয়ন্তীয়া পাহাড়ে ‘Larnai’ বলে একটি জায়গা আছে, সেখানকার বৈশিষ্ট এই যে মহিলারা হাত দিয়ে মাটির জিনিস তৈরি করেন। আমার পঞ্চদশী কন্যা আমায় মনে মনে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার সময় ইতিহাসের পাতায়। সত্যিই তো! রোমাঞ্চ হল এই ভেবে যে সেইযুগের হারিয়ে যাওয়া শিল্প এইযুগে প্রত্যক্ষ করছি! বুঝলাম যে খাসিরা এখনো কতটাই প্রকৃতির কাছে থাকে ও যথার্থই প্রকৃতিকে ভালবাসে। তাই প্রকৃতিও উজাড় করে ওদের ‘ধনী’ করেছে – বাঁশ, বেত, মধু, এরি, মুগা, মৃৎপাত্র, তীর ধনুক, rice beer, fruit wine… এই সব দিয়ে। তুলনায় আমরা শহরের লোকেরা যেভাবে প্রকৃতি-মাকে দূরে ঠেলে দিয়েছি – তার “ফল” নিয়ে আর বাক্যব্যয় না করাই সমীচীন!
ওদের সুখের হদিশ পেলাম মনে, প্রাণে ও গানে। বেরিয়ে আসতে আসতে সমবেত নৃত্য-গীতের আবহে মোহিত হয়ে গেলাম! প্রায় ৫০টির অধিক গ্রামের শিল্পীদের নৃত্য, গীত ও বাদ্যের মেলবন্ধন আমাদের পাগল করে দিল। কি অপূর্ব Teamwork ও Rhythm – ঐ সুরের রেশটুকু কানে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম…।