অভীক দত্ত
রাশিয়ান এয়ারলাইন অক্ষরে অক্ষরে দস্তয়েভস্কি আর গোর্কিকে অনুসরণ করে। রাত নেমে আসা মস্কোর নর্দমার পাশের গলির ঘুপচি ঘরে, সন্তদের মূর্তি রাখা কুলুঙ্গির পাশে রান্না হওয়া খাবারের স্ট্যান্ডার্ড এরোফ্লোট এয়ারলাইনে দস্তুরমতো চিনে নেওয়া গেলো। পুশকিন-তুর্গেনেভের জমিদারি চাল সেখানে অমিল। দিল্লি থেকে মস্কো পৌঁছে দেখতে পেলুম টারম্যাকের অদূরে পাইন বনের জঙ্গল। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল গত দ্বিতীয় যুদ্ধের গল্প।
আরো ভয়ানক ব্যাপার দেখি মস্কো টু তেল আভিভের উড়োজাহাজটি-র নাম নিকোলাই গোগোল। ফ্লাইটে তা জানিয়েও দিলেন পাইলট। রাশিয়ান সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক -আমার পিতাশ্রী -যখন বড়ছেলের ডাকনাম গোগোল (ছোটোছেলের ডাকনাম গোর্কি) রেখেছিলেন-তখনও তিনি এমন মাহেন্দ্রযোগ কল্পনা করেছিলেন বলে মনে হয় না। আলেক্সান্ডার রোগঝকিনের সিনেমা দ্য কুকু-র মতোই এখানে তিনরকম ভাষাভাষীর উপস্থিতি। হিব্রু, হিন্দি আর রাশিয়ান। দুর্ভাগ্য অথবা সৌভাগ্যের ব্যাপার, কেউ কারো কথা বিন্দুমাত্র বোঝে না। এদিকে সব্বাই ইংরেজিতে সমান দড়। স্বর্ণকেশী বিমানবালিকাটিকে জিজ্ঞেস করলুম – হ্যাঁগো বাছা, আমার মালপত্তর তেল আভিভে পৌঁছে যাবে তো সরাসরি? সে মেয়ে মোহিনী হাসি হেসে বললে- ইউ নো ওয়ারি। আই ডোন্ট নো লাগেজ। কোক অর ওয়াতার? আমি মুখে বললুম কোক, মনে মনে বললুম দূর হতচ্ছাড়ি।
ইন্ডিয়ান টাইম দুপুর দেড়টায় শেষমেশ প্রতিশ্রুত ভূমি বা প্রমিসড ল্যান্ড ইজরায়েলে পৌঁছানো গেল। মালপত্তর গুছিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে যাব-এক ব্যাটা ট্যাক্সিওয়ালা হাজির। আমি দোনামোনা করাতে সে দেখি একগাল হেসে বলে- আই ক্যাব ড্রাইভার। আই দোনত কিদন্যাপ ইউ। শুনে বেজায় রাগ হলো। তার থেকেও বেশি পেলো হাসি। আরে ব্যাটা তুই পাঁচ ফুটিয়া হিব্রু, আমার এই বপুকে কিডন্যাপ করতে তোর আরও গোটা দুত্তিনবার জন্ম নিয়ে আসতে হবে।
ট্যাক্সি বুথ থেকে শেষে গাড়ি নিয়ে রুক্ষ পাহাড়িয়া জমির মধ্যে দিয়ে কাটা ঝাঁ চকচকে রাস্তা ধরে ইউনিভার্সিটি এলাম। রাস্তার দুপাশে কেবলি ধুধু করছে মাঠ। মাঝে মাঝে তাতে সবুজের ছিটে দিয়েছে ছোটছোট ঝোপ আর মাঝারি উচ্চতার কিছু গাছ। দেখে মনে হয় ইজরায়েলের প্রকৃতি তিন হাজার বছর ধরে রুক্ষ প্রসাধনটিকে শরীরে একভাবে ধরে রেখেছে।
ড্রাইভারের নাম ইলান। তাকে পুছলাম আই হোপ দেয়ার ইজ নো পলিটিকাল আনরেস্ট ইন দিজ পার্টস নাওয়েদেজ। সে বলে – নো নো, ইউ রিচ উনিভার্সিটি দেন ইউ রেস্ট। ইন্ডিয়ান পিপল গুড পিপল। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে বসলুম। নামার সময় টাকাপয়সা মিটিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে দেওয়া বিলটির দিকে তাকিয়ে (যাতে ড্রাইভারের নাম ধাম গাড়ি নাম্বার হিব্রুতে লেখা আছে) বললুম গুডবাই মিস্টার শাবতোন। সে ভারী অবাক হয়ে বললো ইউ নো হিব্রু? আমি বাঙালিসুলভ সবজান্তা হাসিটি দিলুম। ট্যাক্সির ভিতরে রোমান আর হিব্রু হরফে পাশাপাশি লেখা ছিল ইলান শাবতোন।
ইজরায়েলি সেটলমেন্ট ওয়েস্টব্যাঙ্কের একপাশে উনিভার্সিটি আর শহরখানি। ময়দানবের মন্ত্রবলেই যেন আদিগন্ত রিক্ততার মাঝে হঠাৎই ঝাঁ চকচকে সমস্ত বিল্ডিং আর রিসার্চ ফেসিলিটি গড়ে উঠেছে। ইজরায়েলিদের টেকনোলজির অগ্রগতির কথা এদ্দিন শুনেইছিলুম খালি। এখন স্বচক্ষে দেখা গেল। এখানে স্বাগত জানালো জয়দীপ। বজবজের ছেলে। এখানে এক বচ্ছর কাটানোর সুবাদে ইজরায়েলে ভারতীয় জীবনযাপন বিষয়ে তাক লাগানোর মতো দক্ষতা অর্জন করেছে। রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েষ্টার্ন ফ্রন্ট’ এর কাটসিনস্কি-র কথা মনে আছে? যিনি নানা অসম্ভব রকম জায়গা থেকেও জিনিসপত্র ঠিক জোগাড় করে নিতেন- জয়দীপ তারই মতো দড়।
প্রথমদিন ওর ফ্ল্যাটেই লাঞ্চ সারা গেল। জয়দীপের অর্ধাঙ্গিনী অনিমা যত্ন করে খেতে দিল ভাত-তরকারি-মুরগির ঝোল মায় কাঁচা আমের চাটনি পর্যন্ত। ফ্লাইটের রাশিয়ান স্যালাড আর শুকনো বিফরোল এর পর এমন খাবার দেখে আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলি আর কি। চক্ষুলজ্জার বালাই না রেখে ঢালাও খাওয়া গেল। বাংলা থেকে অনেক দূরে, এই সদালাপী সুভদ্র যুগলটি যে ছোট্ট নীড়টি এখানে গড়ে নিয়েছে- তার শান্তশ্রী মন ছুঁয়ে যায়।
শহরটি পাহাড়ের ধাপে ধাপে তৈরি করেছে আব্রাহামের ছেলেপুলের দল। আমার্ এপার্টমেন্ট এমনি একটি ঢালের উপর। সিগারেট খাওয়ায় এখানকার লোকজনের কোনো কমতি নেই- কিন্তু ঘরে খাওয়া মানা। স্মোক ডিটেক্টর সদা তৎপর। জয়দীপের গিন্নির কাছে শুনলুম লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে রান্না করলে প্রায়ই সিকিউরিটি দৌড়ে আসে-তখন তাকে দিস ইজ ইন্ডিয়ান কুকিং-ব্যাটা গাম্বাট-নো ডেঞ্জার- আকাট মুখ্যু কোথাকার-ইউ গো ব্যাক- এইসব বলে ভাগাতে হয়।
অগত্যা সিগারেট খাওয়ার বন্দোবস্ত ব্যালকনিতে। ব্যালকনিতে এসে চমকে গেলুম। দূরের পাহাড়ের গায়ে গায়ে সাজানো রয়েছে প্যালেস্টাইনের বসতি। মানবসভ্যতার এই নাভিমূল ফিলিস্তিনি-ইজরায়েলি-আসিরীয় দের দ্বন্দ্ব-সখ্যতার ইতিহাস শুকনো মাটির ধাপে ধাপে আজো লালন করে চলেছে। সালোমের ঈর্ষা – বাথশেবার পরিণতি-স্যামসন-ডেলাইলার ব্যর্থ প্রেম সে পাহাড়িয়া আখরে পড়ে নেওয়া যায় ঠিক।
সঙ্গে ছবি ব্যালকনি থেকে তোলা প্যালেস্টাইনের। দিনের ও রাতের দুটি ক্যাপচার।
পুনশ্চ- বলতে ভুলে গেছি- আমার নেক্সটডোর পড়শিটি অন্ধ্রপ্রদেশের ছেলে। তার নাম লেনিন কুমার ভার্দি। এই না হলে রাশিয়ান কানেকশন!!
(চলবে)
শীর্ষচিত্রঃ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের একটি সেটলমেন্ট। ফটোঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
প্যালেস্টাইনের দিন ও রাতের ছবিঃ লেখক