আগের পর্ব এই লিংকে-ইজরায়েল-১, ইজরায়েল-২
পর্ব – ৩
অভীক দত্ত
বুড়ো রাস্তার সাথে কথা বলি। পাঁচহাজার বছরের ধুলো মেখে চাদর তার ময়লা। বয়েস হয়েছে। থুথ্থুরে। ঠাহর করতে পারে না আজকাল কিছু। রুখাশুখা মাটি, টিলা পাহাড়, কাঁটাতার ঠেলে এদিক ওদিক চলে যায়।
রীতিমতো লালরঙা বোর্ডে গোটা গোটা লেখা-ওদিকের মাটি প্যালেস্টাইনের। ইজরায়েলের বাসিন্দাদের জন্য বিপজ্জনক। বুড়ো বুঝে উঠতে পারে না। বাঁধানো কংক্রিটের সুপারওয়ে ছেড়ে অলিভ আর এলমের ছায়া ধরে ধরে সে ওদিকেই যেতে চায়।
গোটা ইজরায়েলের মাটি জুড়ে কংক্রিট ফলছে। লালচে ধুলো সরিয়ে ঠান্ডা কাচের বাড়ির রমরমা। কাজের দিনে ঠিকেদারের গাড়ি বোঝাই হয়ে ফিলিস্তিনি মজুর ঢোকে এদিকে। চোখে তাদের শূন্যতা পড়ে নেওয়া যায়। এমনিতে তাদের ঢোকার হুকুম নেই। ঠিকাদার ঝানু লোক। সে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। অনেক সস্তায় , অনেক অনেক সস্তায় কাজ হাসিল।
বুড়ো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে থাকে। তেল আভিভের কার্মেল মার্কেটের সবথেকে খিটখিটে যে দোকানদারটি ভারতীয় দেখলেই মুখ বেঁকিয়ে খিঁচিয়ে ওঠে-ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিনের যে ছোকরাটি কসৌল যেতে চায় গাঁজার মৌতাতে হিমালয়ে কয়েকদিন কাটাবে বলে-রাশিয়ান দোকানে যে বুড়ো ভাঙা হিব্রু রাশিয়ান ইংরেজি মিশিয়ে গজগজ করে, নাতি তার মদ খেয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছে বলে- তাদের কাছে গিয়ে বুড়ো ঘুরে ঘুরে মরে। কোন মাটি কার , কিছু বোঝা যায় না।
অবশেষে বুড়ো গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। হাইফা যাওয়ার রাস্তা ধরে চলে যায় আবু আলি সুপারমার্কেটে। তার একদিকে ইজরায়েল, অন্যদিকে প্যালেস্টাইন। মাঝখানে সরু গলিপথ এক। তাকে পাশে রেখে বুড়ো সামারিয়া হয়ে ডেভিডের পায়ের ছাপ খুঁজে খুঁজে এসে দাঁড়ায় বড়ো রাস্তার চেকপোস্টে। ইজরায়েল শেষ। ওয়েস্টব্যাঙ্ক শুরু। এখানে ইহুদি বাড়ির ছাদের ট্যাঙ্কের রং সাদা। মুসলিম বাড়ির-কালো। বুড়োর সব গুলিয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে দেখে-চেকপোস্টের এদিকে কচি দুই পাহারাদার। কোমরে মেশিনগান আর চোখে কাঠিন্য ঝুলিয়ে তারা তাকিয়ে আছে ওপারে- যেখানে দিনশেষে হাঘরে মজুরেরা নিজেদের টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের হাঘরে দেশের মাটিতে।
বুড়ো চলতে চলতে একদিন সমুদ্র খুঁজে পায়। জল সেখানে হেলেনের চোখের রং মেখে নিয়েছে। পৃথিবী নিশ্চিন্তে এসে থেমেছে সেই সাগরতীরে। বুড়ো ছিপ নিয়ে বসে পড়ে। একলা নিঃস্ব চরাচরে বুড়ো সাগরে ছিপ ফেলে বসে থাকে। দূরে তখন দিগন্তের বুকে দুটি সফেদ নৌকা দেখা দিয়েছে। বুড়ো বুঝতে পারেনা তারা কাছে আসছে না দূরে সরে যাচ্ছে -একে অন্যের থেকে।
(চলবে)