অংকের বিচিত্র জগত-আগের পর্বগুলো
ব্রহ্মগুপ্তের গল্প তো শুনলে। ভাস্করেরও কিছু কীর্তিকলাপের কথা বলা গেল। এইবারে চল বরাহমিহিরের কথা শোনা যাক।
জন্ম ৫০৫ খৃষ্টাব্দে অবন্তিতে। কর্মক্ষেত্র উজ্জ্বয়িনী। বরাহ বা মিহির নামেও পরিচিত। বাবা আদিত্যদাস নিজেও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। পড়াশোনা কপিত্থক নামের শহরে।
৫৭৫ খৃষ্টাব্দে লেখা “পঞ্চসিদ্ধান্তিকা” নামের পুঁথি বরাহমিহিরের অন্যতম সেরা কাজ। গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার এই পুঁথিতে জ্যোতির্বিদ্যার পাঁচ মূল পুঁথির সারমর্ম একত্র রয়েছে। সে সারমর্ম থেকে এই পাঁচ পুঁথির বিষয়ে কী কী জানা যায় তা দেখা যাকঃ
(ক) সূর্য সিদ্ধান্তঃ
সম্ভবত ষষ্ঠ শতকের একেবারে শুরুর দিকে লেখা এ পুঁথিতে গ্রহদের গড় গতি, অবস্থান, চাঁদ-সূর্য ও তাদের গ্রহণ, গ্রহসমাগম (প্ল্যানেটারি কনজাংকশান—যখন আকাশে একাধিক গ্রহ এক লাইনে (এক মহাজাগতিক দ্রাঘিমাতে) দেখা যায়) বিভিন্ন নক্ষত্রের উদয়াস্ত এইসবের গাণিতিক হিসেবনিকেশ আছে। তাছাড়া সূর্যঘড়ির হাত (যাকে নোমন বলে) যে ছায়া ফেলবে তার চলাচলের নিখুঁত হিসেবও রয়েছে। এই পুঁথিতে।
এছাড়া রয়েছে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস ভিত্তিক সময় হিসেবের পদ্ধতি। সেটা এইরকমঃ
ছয় শ্বাসে এক বিনাদী
ষাট বিনাদিতে এক নাদী
ষাট নাদিতে এক দিবস
ত্রিশ দিবসে এক মাস
বারো মাসে এক বৎসর বা এক ঈশ্বরদিবস।
তিনশ ষাট ঈশ্বরদিবসে এক ঈশ্বরবর্ষ
বারো হাজার ঈশ্বরবর্ষে এক চতুর্যুগ
একশ সত্তর চতুর্যুগে এক মনু
চোদ্দ মনুতে এক কল্প
প্রতি কল্পান্তে সম্পূর্ণ সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে ব্রহ্মার এক দিবাভাগ শেষ হয়ে শুরু হয় সমান দৈর্ঘ্যের রাত। সেই রাত শেষ হলে নতুন কল্পের (মানে ব্রহ্মার নতুন একটি দিনের) শুরুতে ফের সময় চলতে শুরু করে আগের হিসেবে। এইভাবে চলতে থাকে কল্প থেকে কল্পান্তে জীবজগতের ধারা। সব মিলিয়ে এক কল্প হল প্রায় সাড়ে দশ বিলিয়ন বছর। (হিসেব করে দেখ)
প্রাচীন ভারতের অঙ্কওয়ালা এইভাবেই বিশ্বসৃজন ও তার ধ্বংসের বৃত্তকে অংকের হিসেবে বাঁধবার চেষ্টা করেছিলেন। যন্ত্রপাতি নেই বিশেষ। নেই হাবলের টেলিস্কোপটাও। শুধু দুটো চোখ আর মস্তিষ্ককে ভর করে তাঁরা তৈরি করেছিলেন যে সৃষ্টিতত্ত্ব তাতে ব্রহ্মাণ্ডটা বারংবার আলো নিয়ে জেগে ওঠে ব্রহ্মার নিদ্রাভঙ্গে, আর তারপর সাড়ে দশ বিলিয়ন বছর অস্তিত্ব রাখবার পর ফের তলিয়ে যায় ব্রহ্মার ঘুমের অস্তিত্বহীন আঁধারে। থেমে যায় সময়, হারিয়ে যায় স্থান, আলো। তারপর ফের জেগে ওঠে তা। শুরু হয় আরো একটা অস্তিত্বের বৃত্ত। আজকের বিজ্ঞানিরাও এখনো হাতড়ে বেড়াচ্ছেন আমাদের ১৪ বিলিয়ন বছর বয়েসি ব্রহ্মাণ্ডের জীবনচক্রের সঠিক সন্ধান খুঁজে। আমাদের সূর্যসিদ্ধান্তে এই যে তত্ত্বের ইঙ্গিত দেয়া হল, তার এক সুবিশাল গাণিতিক রূপও এই মুহূর্তে ব্রহ্মাণ্ডের জীবনচক্রের একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসেবে স্বীকৃত। তাতে বিগ ব্যাং-এ জগত সৃষ্টি হয়। জন্ম নেয় আলো, দেশ, কাল। তারপর দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে অন্তিম বিগ ক্রাঞ্চে ফের ঘুমিয়ে পড়ে জগত, উধাও হয় স্থান হারিয়ে যায় কাল। তারপর কালব্রহ্মার ঘুম ভাঙে ফের এক নতুন বিগ ব্যাং-এ।
এখনো নিশ্চিত নয়, তবে হয়ত একদিন প্রমাণিত হবে, সূর্যসিদ্ধান্তের ব্রহ্মার নিদ্রাজাগরণের রূপকে যে সৃষ্টিতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে সেই হয়ত আসল তত্ত্ব। চলো অপেক্ষায় থাকি।
(খ) রোমক সিদ্ধান্তঃ
বাইজান্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের জ্যোতির্বিদ্যাজ্ঞানের সংগ্রহ। শ্রীসেনের লেখা। এ পুঁথিতে চান্দ্র মাসের হিসেবনিকেশ আছে। তাছাড়া এর একটা পুরো অধ্যায় খরচ করা হয়েছে গ্রহণের ব্যাখ্যা দিতে। পুঁথির নাম থেকেই বোঝা যায় এর উৎস বিদেশি জ্যোতির্বিজ্ঞান। এ পুঁথির মধ্যেও তার প্রমাণ রয়ে গেছে। যেমন ধরো, রোমান জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যবহৃত কিছু বিষয় (সূর্যাস্তবিন্দু থেকে দিনগণনা, ক্রান্তীয় বর্ষগণনা ইত্যাদি)
ক্রান্তীয় বর্ষগণনা বিষয়ে একটু বলে নেয়া যাক এই ফাঁকে। সেইটে ভারী মজার। জানুয়ারি মাসে হ্যাপি নিউ ইয়ার হয়ে যায় আমাদের সে নয় হল। বাস্তবে তার কোন গুরুত্বই নেই। ইশকুলের শিক্ষাবর্ষই বল আর বাবা-মায়ের অফিসের অর্থবর্ষ—সেই সবই কিন্তু শুরু হয় এপ্রিলে। বসন্তকালে। কাজকর্মের জন্য তাই বছরের শুরু বসন্তকালের শেষদিকে। ভারতীয় ক্যালেন্ডারও সেই একই সময়ে বছরের শুরু করে চৈত্রশেষে বৈশাখ এলে। এর উৎস রয়েছে ইতিহাসের গভীরে।
বছরের শুরু বা শেষ কখন ধরব? যেকোন দিনই তো তা ধরা যায়। তবে? এ নিয়ে পুরোনদিনের জ্যোতির্বিদদের নানান চিন্তা ছিল মাথায়। তাঁরা দেখেছিলেন, বছরের চারটে দিনকে মোটামুটি নিখুঁতভাবে মাপা যায়- তা হল, যে দিনটা দিন সবচেয়ে বড়ো, যে দিনটা রাত সবচেয়ে বড়ো, আর বছরের যে দিনদুটোয় দিন আর রাত একেবারে সমান। তাহলে এর যেকোন একটা দিনকে বছরের শুরু ধরলে খুব সহজেই বর্ষগণনা সম্ভব।
এই নিয়ে গবেষণা করছিলেন গ্রিক জ্যোতির্বিদ হিপারকাস। সেটা খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দি। তিনিও এই চারটে দিনের কোনটা থেকে বছরের শুরু হিসেব করা যায় তাই ভাবছিলেন। তখন দেখা গেল তিনি দিনরাত্রি কবে সমান হয় সেই হিসেবটাই বেশি নিখুঁতভাবে কষতে পারছেন। বড়ো বা ছোটোদিনের হিসেবটা নয়। ব্যস! বসন্তকালের যে দিনটা দিনরাত্রি সমান সে দিনটাকেই তিনি বলে দিলেন বছরের শুরু। এইভাবে শুরু হয়ে গেল বসন্তের যে দিনটা দুনিয়ায় দিনরাত্রের দৈর্ঘ সমান হয় (ওর ভালো নাম হল গিয়ে মহাবিষুব বা ভার্নাল ইকুইনক্স)সেই দিন থেকে নববর্ষগণনার পালা। (গল্পকথা নয়। Meeus & Savoie নামে দুই গবেষক ১৯৯২ সালের একটা গবেষণাপত্রে এইটে বলেছেন।)
(গ) পৌলিশ সিদ্ধান্তঃ
অলবিরুনির মতে গ্রিক জ্যোতির্বিদ পুলিস রচিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুঁথি এটি। ব্যাবিলনীয় ও গ্রিক জ্যোতির্বিদ্যার পদ্ধতিতে ভিত্তি করে লেখা হলেও এ পুঁথিতে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চাপদ্ধতির কিছু চিরায়ত ধারণারও প্রতিফলন দেখা যায়। এ দেশের কোন কোন এলাকায় পঞ্জিকাস্রষ্টাদের ওপরে এর প্রভাব বেশি ছিল। যেমন ধর, এ পুঁথিতে চাঁদের দ্রাঘিমা অবস্থান নির্ণয়ের যেসব নিয়ম আছে তা পরবর্তীকালে তৈরি তামিল জ্যোতির্বিদ্যার বাক্যম পদ্ধতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সে ছাড়া এ পুঁথিতে দিক, স্থান ও সময় নির্ণয়ের গাণিতিক কায়দা রয়েছে, রয়েছে ত্রিকোণমিতির সাইন টেবিল আর সূর্যচন্দ্রের গ্রহণ-এর সরল হিসেবনিকেশ।
(ঘ) বশিষ্ঠ সিদ্ধান্তঃ
অলবিরুনির মতে বিষ্ণুচন্দ্রের লেখা জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুঁথি। লেখার সঠিক সময় নিশ্চিত নয়। মূল বই পাওয়া যায় না। বরাহর পঞ্চসিদ্ধান্তিকা থেকে এর সম্বন্ধে জানা গেছে এতে প্রথম ডিগ্রি মিনিটের হিসেবে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান বর্ণিত হয়। লগ্ন (পূর্বদিগন্তে কোন নক্ষত্রের ডুবে যাবার মুহূর্ত)নির্ণয়ের মোটাদাগের নিয়মকানুনের বিবরণ রয়েছে এতে। তাছাড়াও রয়েছে দুপুরের ছায়া থেকে কোন জায়গার দ্রাঘিমা নির্ণয়ের অঙ্ক কষবার কায়দাকানুন। পৈতামহ সিদ্ধান্তের পরবর্তীকালের হলেও, সম্ভবত এ পুঁথির লেখার সময়েও জ্ঞানের অভাব থাকবার জন্য এর অনেক তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের অমিল পাওয়া গিয়েছে।
(ঙ) পৈতামহ সিদ্ধান্তঃ
সম্ভবত প্রাচীনতম। মূল পুঁথি মেলেনি। ওর সম্বন্ধে যেটুকু জানা গেছে তা এই পঞ্চসিদ্ধান্তিকা থেকে।
সব মিলিয়ে, বেদাঙ্গ জ্যোতিষ ভারতীয় ও হেলেনিক জ্যোতির্বিদ্যা(গ্রিক, মিশরীয় ও রোমান উপাদানসমৃদ্ধ)এই দুয়ের মেলবন্ধন ঘটেছে বরাহমিহিরের এই কালজয়ী পুঁথিতে।
বরাহমিহিরের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তাঁর বৃহৎ সিদ্ধান্ত। ১০৬ অধ্যায়ে ভাগ করা আধুনিক এনসাইক্লোপিডিয়ার সঙ্গে তুলনীয় এই পুঁথিতে জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষ, বৃষ্টি, মেঘ, স্থাপত্য, শস্যের বৃদ্ধি, সুগন্ধী তৈরি করা, বিয়ের নিয়মকানুন, পারিবারিক সম্পর্ক, মূল্যবান রত্ন, মুক্তো এই সমস্ত বিষয়ে সে সময়ের সঞ্চিত জ্ঞানকে একত্র করা হয়েছে।
জ্যোতিষচর্চার ওপরেও বহু উল্লেখনীয় কাজ ছিল বরাহের। তাঁর আরো একটা গাণিতিক কাজের সামান্য কিছু টুকরো উদ্ধার করা গেছে। তার নাম সংখ্যা সিদ্ধান্ত। যেটুকু মিলেছে তাতে প্রত্নবিদরা আন্দাজ করেন যে অত্যন্ত উন্নতমানের পাটিগণিত, ত্রিকোণমিতির সূত্রাদি নিয়ে কাজ হয়েছিল এ পুঁথিতে।
গণিতশাস্ত্রে বরাহমিহিরের অনেক অবদান রয়েছে। ব্রহ্মগুপ্ত ঋণসংখ্যা আবিষ্কারের পর, শূন্য ও ঋণাত্মক সংখ্যার বীজগাণিতিক ধর্মগুলো নির্ধারণ করেছিলেন বরাহমিহির।
কম্বিনেটরিক্স্ নামের যে মহাগুরুত্বপূর্ণ অঙ্কের ধারা আছে (ক্লাশ ইলেভেন টুয়েলভে যারা পড়ছ তারা যে পারমুটেশান কম্বিনেশানের অঙ্ক কষছ, ওই হল কম্বিনেটরিক্স্ এর আধারশিলা) তাতে একটা বিশেষ সংখ্যা খুব গুরুত্বের। সেইটে হিসেব করতে পারলে ও শাস্ত্রের অঙ্ক ভারী চটপট হয়ে যায়। সেটা সংক্ষেপে এই—
“ক” খানা জিনিস থেকে “খ” খানা জিনিসের ক’টা দল বানানো যায়? (মানে ধরো তোমাদের ক্লাশের পঞ্চাশজন ছাত্র থেকে এগারোজনের একটা ফুটবল দল কতভাবে বানানো যায়? বা একটা রাসায়নিক গবেষণায় দশটা ধাতুর থেকে তিনটে করে নিয়ে কতরকমের ধাতুসংকর বানানো সম্ভব?)
এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বরাহমিহির যে বস্তুটা তৈরি করেছিলেন তাকে বলে পাস্কালের ত্রিভূজ। (তাঁর বহুকাল পরে ইউরোপে জিনিসটা ফের একবার আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানি পাস্কাল। যেহেতু এখনকার বিজ্ঞানের বইপত্র সব সাহেবদের বানানো তাই তারা ও জিনিসকে পাস্কালের নামেই নাম দিয়েছে।)
সে এক আজব বস্তু। তার যে কত খেলা আছে তার লেখাজোখা নেই। এক পাস্কাল ত্রিভূজ নিয়ে গোটা একটা ম্যাজিক শো করা যেতে পারে। তবে তার জন্যে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সেইটে আমরা দেখব পরের সংখ্যায়।
ওহো একটু ভুল হল যে! বলেছিলাম এই সংখ্যা থেকে কলনবিদ্যার জন্মের গল্প শোনাব। মনে হচ্ছে বরাহমিহির আর পাস্কালের গুঁতোয় তা একটু পিছিয়ে যাবে। সে যাক। পরের সংখ্যায় তবে পাস্কালের জাদুত্রিভূজের কথা।
ক্রমশ