এই লেখার আগের সমস্ত এপিসোড এই লিংকে একত্রে
ফিবোনাচি সংখ্যা
কাব্য থেকে অঙ্ক
আনুমানিক খৃস্টপূর্ব চারের শতক পিঙ্গলমুণি একটা পুঁথি লিখেছিলেন। তার নাম চন্দ্রশাস্ত্র। সংস্কৃতভাষায় সেই হল প্রথম ছন্দশাত্র বা প্রসডি।
ছন্দ চলে অঙ্কের তালে।তাই নানাজাতের ছন্দের কথা বলতে গিয়ে তাঁকে অঙ্কের প্রসঙ্গ আনতেই হয়েছিল সেখানে।
ওই কেতাবেই প্রথম ছোট এবং বড়ো সিলেবল এ তৈরি নির্দিষ্ট ধাঁচের বিভিন্ন মিটার বা কবিতার ছন্দচাল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির উল্লেখ করেন তিনি। (বাইনারি মানে হল আমরা এখন যাকে ০,১ এ তৈরি কমপিউটারের ভাষার মূল হিসেবে জানি। পিঙ্গল তাদের নাম দিয়েছিলেন লঘু আর গুরু।) ওর শুরু হয় ‘১’ দিয়ে যাকে তিনি বললেন “চারটে হ্রস্ব সিলেবল-(লঘু-লঘু-লঘু-লঘু বা ০-০-০-০)”, এইরকম করে। অবশ্য লঘুর বদলে শূন্যর ব্যবহার হয় এর এগারোশ বছর পরে ব্রহ্মগুপ্তের আমলে।
এই করতে গিয়ে পিঙ্গলমুণি একজায়গায় একটা রহস্যময় চালের কথা বলে গিয়েছিলেন ধাঁধার ভাষায়। সেইটে হল মাত্রামেরু। তার রূপের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, এ হল, “মিশ্রছন্দৌ চ” বাংলায় যার অর্থ হবে দুটো ছন্দের মিশেল। পরবর্তী সময়ে ওর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পণ্ডিতরা বলেন, ও হল গিয়ে এমন একখানা চাল যাতে তুমি যদি দশ নম্বর বিটে মাত্রাসংখ্যার হিসেব চাও, তাহলে তা হবে ন নম্বর বিটের লম্বা সিলেবল এর মাত্রা সংখ্যা আর আট নম্বর বিট এর ছোটো সিলেবল্ এর মাত্রাসংখ্যার যোগফল।
এবার চলে আসা যাক টাইম মেশিনে চেপে ১২০২ সালের ইউরোপে। সেখানে ফিবোনাচি নামে এক গণিতবিদ খরগোশের সংখ্যা নিয়ে বেজায় মাথা ঘামাচ্ছিলেন। তাদের সংখ্যা বাড়ে কোন চালে? বেচারা নোয়া যে তার জাহাজে একজোড়া খরগোশ তুলে অন্য প্রাণীদের আনতে গিয়ে কিছুদিন বাদে ফিরে এসে দেখে জাহাজভর্তি খরগোশ হয়ে গেছে সে সংখ্যাবৃদ্ধি ঠিক কোন পথে ঘটল সেইটেই বোঝা ছিল তাঁর ফন্দি। ধরো নোয়া একজোড়া সদ্যোজাত খরগোশকে জাহাজে তুলল। একমাস বাদে তারা বড়ো হল। দুমাসের মাথায় খরগোশ দম্পতির একজোড়া ছেলেমেয়ে হল। তারপরে মাসে তাদের আরেক জোড়া ছেলেমেয়ে হল। তার পরের মাসে তাদের প্রথম প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এক জোড়া ছেলেমেয়ে জন্মাল। ফিবোনাচি জিজ্ঞাসা করলেন, যদি একটাও খরগোশ না মরে তাহলে এক বছরের শেষে মোট কটা খরগোশ হবে?
নিচের ছবিটা দেখঃ
খেয়াল করলে দেখবে যেকোন মাসে যে ক’টা খরগোশ থাকছে তার সংখ্যা আগের দুটো মাসের খরগোশের মোট সংখ্যার সমান।
সহস্রাব্দির আগে পরে, কবিতার মাত্রামেরু ছন্দ আর খরগোশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অঙ্কে দেখা গেল একই ধরণের নিয়ম মেনে আগের দুটোর যোগফল হলে পরেরটা পাওয়া যায় এমন সংখ্যা মিলছে।
এই যে অদ্ভুত একটা সংখ্যার ধারা –
০,১,১,২,৩,৫,৮,১৩,২১—- যাতে প্রত্যেকটা সংখ্যা তার আগের দুটো সংখ্যার যোগফলের সমান তাকে বলে ফিবোনাচি সিরিজ।
এই ফিবোনাচি সিরিজকে ছবিতে দেখালে এইরকম লাগে।
এখানে কতগুলো বর্গক্ষেত্র তৈরি করা আছে যাদের বলে ফিবোনাচি টাইল। এদের আয়তন ফিবোনাচি সংখ্যা মেনে তৈরি। সবচেয়ে ছোট্টোটার আয়তন, ১, তারপর,১, তারপরেরটার আয়তন ২ এইভাবে। এবার যদি তুমি তাদের কর্ণগুলোকে পরপর জুড়ে দাও তাহলে এই প্যাঁচালো ছবিটা তৈরি হয়ে যাবে নিজে নিজেই।
বেশ শামুকের খোলের মত লাগছে না? ঠিক। শামুকের খোলে যে প্যাঁচালো ছবিটা সেইটেকে যদি তুমি কাগজে ধর, তাহলে তা ঠিক এই ভাবে সাজানো বর্গক্ষেত্রদের সঙ্গে হিসেবে মিলে যাবে। অংকের ভাষায় একে বলে গোল্ডেন স্পাইরাল। তবে ওর অংকটা এইখানে দেয়া যাবে না। বেজায় কঠিন। তার চেয়ে ছবিটা দেখে অঙ্কের আন্দাজ বোঝা সহজ। কী বেজায় মজার ব্যাপার! একটা বেচারা শামুক, কিচ্ছু না জেনেই এমন একখানা অঙ্ককে তার খোলায় বয়ে নিয়ে বেড়ায়! কী করে হয়? ম্যাজিক! আসলে সবচেয়ে বড়ো ম্যাজিশিয়ান তো প্রকৃতি নিজে, তাই না?
এ সংখ্যাদের অনেক মজার গুণ আছে। যেমন ধর, ৫ থেকে শুরু করে সমস্ত ফিবোনাচি সংখ্যাই হল গিয়ে এমন কোন না কোন সমকোণী ত্রিভূজের অতিভূজের মাপ, যাদের বাহুগুলোর দৈর্ঘ্য পূর্ণসংখ্যায় হয়।
ফিবোনাচি সংখ্যাদের একেবারে প্রকৃতির নিজস্ব গণনাপদ্ধতি বলা যায়। প্রকৃতিতে, গাছের পাতার সজ্জা, ফুলের পাপড়ির সজ্জা, পাইনকোনের মধ্যে ছোটোছোটো বৃন্তগুলোর সজ্জা, আনারসের চোখের সজ্জা-এই সবকিছুই, যা বেঁচে থাকে ও বেড়ে ওঠে তাতে এ সংখ্যার উপস্থিতি। বেচারা গাছেরা তো আর অঙ্ক জানে না, তারা শুধু যেভাবে বাড়বৃদ্ধি হলে সবচেয়ে কম শক্তি খরচে সবচেয়ে বেশি ফল মিলবে সেই রাস্তাটা অনুসরণ করে বেঁচে থাকে। আর প্রকৃতি মা নির্ধারণ করে রেখেছেন যে সেই পথটাই হল ফিবোনাচি সংখ্যার পথ।
গাছের ডালে পাতা বেরোয় যে দূরত্বগুলোতে সেগুলোকে কাগজে আঁকলে দেখা যাবে তারা ওই গোল্ডেন স্পাইরালের বিভিন্ন বর্গক্ষেত্রের কোণগুলো ধরে গজায়। কারণ তারা দেখেছে ওতে করে সব পাতাগুলো সূর্যের আলো সবচেয়ে বেশি করে পায়।
একইভাবে গাছের ডালগুলোও সেই কায়দা অনুসরণ করে ছড়ায়, যাতে তার গায়ে গজানো পাতারা সবচেয়ে বেশি সূর্যের আলো পায়। সঙ্গে তার ছবি দিলাম।
সূর্যমুখীর বীজগুলোও ওই একই নিয়মে সজানো থাকে তার বীজধারক অঞ্চলে, কারণ তাতে করে সবচেয়ে কম জায়গায় সবচেয়ে বেশি বীজ সাজানো যায়। পাইন কোণের বৃন্তগুলোকে দেখলে দেখা গেছে ওতে আবার তারা দুটো
জড়াজড়ি করা গোল্ডেন স্পাইরালে সাজানো। একটা ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে, অন্যটা তার বিপরীতে।
গোলাপফুলের পাপড়িরা তো আবার ভেতর থেকে বাইরে এইসজ্জায় একেবারে হুবহু ফিবোনাচি সজ্জাকে মেনে চলে। সঙ্গে তার ছবি দিলাম।
প্রাণীজগতে, শামুকের খোলায় গোল্ডেন স্পাইরালের উপস্থিতির কথা তো আগেই বলেছি। ওতে করে খোলার ভারসহন ও ঘাতসহতা সবচেয়ে বেশি হয়।
অন্যদিকে ডলফিন তার চোখ, পাখনা আর লেজের মধ্যেকার দূরত্বকে সাজিয়েছে ফিবোনাচি সংখ্যায়। তাই তার দেহগঠন জলচর সব জীবদের মধ্যে অত্যন্ত ভারসাম্যযুক্ত হয়ে ওঠে।
মানুষের ক্ষেত্রেও গোল্ডেন রেশিওর আবির্ভাব ঘটেছে। কানের ভেতরের ককলিয়া গড়ে উঠেছে গোল্ডেন স্পাইরালকে মেনে, বাহু আর হাতের তুলনামূলক দৈর্ঘ্যও ফিবোনাচি সংখ্যাকে মেনে চলে।
তাহলেই বোঝ, প্রকৃতিতে কত গভীর অঙ্কের রহস্য বসে আছে, মানুষের আবির্ভাব, তার হাতে অঙ্কের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকে এমন মজার একটা অঙ্ক দুনিয়ায় আছে, আর অজস্র উদ্ভিদ আর প্রাণী বেঁচে থাকবার সেরা রাস্তাটা খুঁজতে গিয়ে নিজের শরীরের নানান বস্তুকে সাজিয়ে চলেছে ক্রমাগত সেই রহস্যময় সংখ্যাসারি আর তার চিত্ররূপের পথে।
ভালো ম্যাজিক, নয়?
পরের সংখ্যায় নতুন ম্যাজিক—কলনবিদ্যা।
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর