এই লেখার আগের সমস্ত এপিসোড এই লিংকে একত্রে
কলনবিদ্যার (ক্যালকুলাস) জন্ম
একটা মজার অঙ্ক ভাবা যাক। ধরো তুমি ছুটির দিনে ট্রেনে চেপে বেড়াতে চলেছ। এখন এইটা তো মানবে যে ট্রেনটা সবসময় এক গতিতে ছোটে না। প্রতিমুহূর্তেই তার গতি বাড়ছে-কমছে একটু আধটু করে। কখনো বেজায় জোরে, কখনো বেজায় আস্তে। আবার এই বেজায় জোরে থেকে বেজায় আস্তে বা উলটোটা হতে গিয়ে মধ্যের সময়টা প্রতিমুহুর্তেই তার গতি হয় কম থেকে বেশি বা বেশি থেকে কম হিসেবে পালটে যাচ্ছে।
তা ধর, ট্রেনটা ইছাপুর থেকে ছেড়ে ঠিক মাঝামাঝি পলতা ইস্টিশানে না দাঁড়িয়ে একেবারে বারাকপুর স্টেশানে গিয়ে দাঁড়াল। ইছাপুরে রওনা হবার মুখে তার গতি ছিল শূন্য। যখন সে ঠিক মাঝখানে পলতা পেরোচ্ছে তখন তার গতি সবচেয়ে বেশি হয়ে ঘন্টায় সত্তর কিলোমিটার হল আর ফের যখন আরো সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে বারাকপুর স্টেশনে সে পৌঁছেছে তখন তার গতি ফের হয়ে গেল শূন্য।
তাহলে এইটে খুব সহজেই বলে দেয়া যায় যে ইছাপুর থেকে বারাকপুর সাত কিলোমিটার অবধি হিসেব করলে তার গতিবৃদ্ধির হার শূন্য (যেহেতু শুরু আর শেষে গতি একই থাকছে)। কিন্তু আসলে তো আর তা হয়নি। গাড়ির গতি বেড়েছে কমেছে নানান ভাবে।
এই বাড়াকমাটাকে মোটামুটি বুঝতে, এইবারে এস, গোটা পথটাকে দুটো সমান টুকরোয় ভেঙে নেয়া যাক।
ইছাপুর থেকে পলতা এই সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরত্ব পেরোবার সময় তার গতি বেড়ে হয়েছে ঘন্টায় শূন্য থেকে ঘন্টায় ৭০ কিলোমিটার আর পলতা থেকে বারাকপুর এই সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরত্ব পেরোবার সময় তার গতি কমে হয়েছে ঘন্টায় ৭০ কিলোমিটার থেকে ঘন্টায় শূন্য কিলোমিটার। সেক্ষেত্রে যাত্রার প্রথম অর্ধে তার গতিবৃদ্ধির হার প্রতি কিলোমিটারে ঘন্টায় ২০কিলোমিটার(৭০/৩.৫) হারে আর দ্বিতীয়ার্ধ্বে তার গতি হ্রাসের হার প্রতি কিলোমিটারে ঘন্টায় ২০ কিলোমিটার হারে।
কিন্তু এটাও আসল গল্প নয়। ইছাপুর আর পলতার মাঝখানটায় (ধর জায়গাটার নাম শালিগ্রাম) তার গতি হয়ত দাঁড়িয়েছিল ঘন্টায় ৩৫ কিলোমিটার। আবার পলতা আর বারাকপুরের ঠিক মাঝখানটাতেও (ধরো সেখানটার নাম কুশগ্রাম) হয়ত তাই।
তাহলে এবার দেখা যাচ্ছে ইছাপুর থেকে বারাকপুরের মধ্যে শালিগ্রাম, পলতা আর কুশগ্রাম তিনটে বিন্দু পাচ্ছি আর ইছাপুর-শালিগ্রাম, শালিগ্রাম-পলতা, পলতা-কুশগ্রাম আর কুশগ্রাম-বারাকপুর এই চারটে ১.৭৫ কিলোমিটার এলাকার প্রতিটায় তার গতিবৃদ্ধি বা গতিহ্রাসের হার আমরা বের করতে পারলাম।
বাস্তব জীবনে আবার এই দূরত্বগুলো সমান হয় না আর তাদের মধ্যে গতির হ্রাসবৃদ্ধিও সমান হয় না। ফলে ইছাপুর থেকে বারাকপুর এই গোটা রাস্তায় গতিবৃদ্ধির হার শূন্য (সম্পূর্ণ ভূল) এই থেকে শুরু করে তার মধ্যেকার রাস্তাটাকে যত ছোটো ছোটো টুকরোয় আমরা ভাগ করব ততই সুক্ষ্ম আর আরও বেশি সঠিকভাবে বুঝতে পারব ঠিক কী ভাবে ও কী হারে তার গতিটা পালটাচ্ছে।
প্রশ্ন করবে , এমন পাগলামোটা করে লাভ কী?
আমি জবাবে বলব, ধর ইছাপুর আর বারাকপুরের মধ্যে বেশ কটা জায়গায় লেভেল ক্রসিং তৈরি হবে আর সিগন্যাল বসবে। এই প্রত্যেকটা লেভেল ক্রসিং এর মধ্যেকার দূরত্বটা একটা ট্রেন কেমন হারে গতি বাড়াচ্ছেকমাচ্ছে তার হিসেব না করতে পারলে সেই সিগন্যাল আর লেভেল ক্রসিং এর কাজকারবার নিখুঁতভাবে করা যাবে না, ফলে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যাবে।
এইবারে ধর তুমি বললে আমি ইছাপুর থেকে বারাকপুর অবধি প্রত্যেক মিটার দূরত্বে ট্রেনটার গতির হ্রাসবৃদ্ধির হিসেব চাই। আমি জবাবে বলব ধুস। কী হবে সেটা করে? সিগন্যাল তো আর গায়ে গায়ে ঘেঁষে বসবে না! বসবে দু এক কিলোমিটার দূর দূর। ইছাপুর বারাকপুরের মধ্যে ট্রেনের যাতায়াতের জন্য তাই এই মোটাদাগের তিন পয়েন্টের হিসেবটুকুই যথেষ্ট।
কিন্তু এবারে যদি বলি, আকাশে একটা কমিউনিকেশান বা ওয়েদার স্যাটেলাইট ঘুরছে। সেটার অতি সামান্য নড়াচড়াতেও কিন্তু পৃথিবীর ঠিক যে বিন্দুতে তার সিগন্যাল পাঠাবার কথা সেইটে অনেকটা বদলে যেতে পারে। কেন? সঙ্গের ছবিটা দেখ।
এর ফল ভয়ংকর হতে পারে। ভেবে দেখ তো, বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা একটা সাইক্লোনের ছবি ধরে স্যাটেলাইটটা যে রিসিভিং স্টেশনে পাঠাবে সেটা সেখানে না এসে ভুল জায়গায় চলে গেল, আমরা টের পেলাম না আর সাইক্লোনটা সেই ফাঁকে ধেয়ে এসে অনেক মানুষকে মেরে ফেলল, তাহলে কী সাংঘাতিক ব্যাপার হবে?
কাজেই এক্ষেত্রে কিন্তু স্যাটেলাইটের যাতায়াতের প্রত্যেকটা মুহূর্তেই তার গতির কী অদলবদল হচ্ছে সেইটে হিসেব করা দরকার যাতে আমরা ঠিক সেইভাবে তার সিগন্যাল পাঠাবার রাস্তাগুলোকে হিসেব করতে পারি, যাতে সবসময়ে ঠিক জায়গায় সেটা এসে পৌঁছোয়। অমন ইছাপুর বারাকপুর মার্কা মোটা দাগের হিসেব এখানে চলবে না।
অন্য কথায় বললে এক্ষেত্রে আমাদের দরকার হবে অত্যন্ত ছোটোছোটো সময়খণ্ডে বা দূরত্বে তার গতির হার ও অভিমুখ কীভাবে বদলাচ্ছে তার হিসেব কষবার কায়দা পাওয়া।
অনেককাল আগে, যখন আকাশে কৃত্রিম উপগ্রহরা ঘুরে বেড়াত না তখনও এ হিসেবটার দরকার হয়ে পড়েছিল একবার। সে ছিল আর্যভটের যুগ। আকাশে তখন উপগ্রহ বলতে শুধু চাঁদ। চাঁদের কলার হ্রাসবৃদ্ধি, চাঁদের গ্রহণ এইসব তখন ধর্মীয় কারণে আর সেইসঙ্গে বর্ষগণনার পঞ্জিকা তৈরির কাজে খুব জরুরি বিষয় ছিল (দ্বিতীয় কাজটার জন্য এখনও তা বেজায় জরুরি) । খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ শতাব্দি বাদে আর্যভট একবার চন্দ্রগ্রহণের নিখুঁত একটা হিসেব বের করবার কাজ শুরু করলেন।
সেই করতে গিয়ে মহা বিপদে পড়লেন আর্যভট। তিনি খেয়াল করলেন, খুব সামান্য সময়ের এদিকওদিকেই চন্দ্রগ্রহণের এলাকায় অনেকটা করে বদল ঘটে যাচ্ছে। ( তখন তো আর তিনি জানেন না যে চাঁদ সূর্য পৃথিবী এরা লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার দূরে দূরে থাকে, বেজায় জোরে ছোটে, আর তাই এদের আপেক্ষিক অবস্থানে অতি সামান্য বদল ঘটলেই চাঁদের গায়ে পৃথিবীর ছায়া (চন্দ্রগ্রহণের কারণ) বেশ অনেকখানি করে সরে যায়। তিনি শুধু বদলটা খেয়াল করেছিলেন)
তখন তো আর অত হাবল টাবল নেই। আকাশে চাঁদের গতি মাপবে কেমন করে মানুষ? আর্যভট করেছিলেন কী, ওর জন্য একটা অন্য কৌশল নিয়েছিলেন। সঙ্গের ছবিটা দেখঃ
পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে চাঁদের বিভিন্ন অবস্থানের মধ্যে কোণগুলো মেপে নিলে আর সেগুলো তৈরি হতে কত সময় লাগছে সেইটে মাপতে পারলেই ত্রিকোণমিতির ব্যবহার করে সে কতক্ষণে কত রাস্তা পার হচ্ছে তার একটা মোটামুটি হিসেব বের করে ফেলা যায় তাই না? সেই ত্রিকোণমিতির কায়দাও বের করে নিয়েছিলেন আর্যভট।
কিন্তু তাতেও সমস্যা হল। এতে হিসেবে ভুল হয়ে যায় একটা। কেন? তলার ছবিটা দেখঃ চাঁদের A এবং B অবস্থানের কৌণিক দূরত্ব থেকে ত্রিকোণমিতির সূত্র দিয়ে তার পথচলার যে মাপ মিলবে সেটা হল সরলরেখায় ত্রিভূজের নীল বাহুটার মাপে। দুই বিন্দুর মধ্যে চাঁদের আসল (সবুজ) যাত্রাপথের দৈর্ঘ্যের চেয়ে সেটা কম। ওটা অনেকটা বাঁকা তাই অনেকটা বেশি লম্বা।
কিন্তু খেয়াল করে দেখ, যখন B আর C র মধ্যে ওই একই কায়দায় দূরত্ব মাপা হবে তখন কিন্তু বিন্দুদুটো অনেকটা কাছাকাছি হওয়ায় আসল বক্রপথ আর হিসেবের সরলরেখার পথের মধ্যে দৈর্ঘ্যের পার্থক্যটা অনেকটাই কম হয়ে যাবে। C আর D আরো কাছাকাছি। এক্ষেত্রে এই দুই হিসেবের ভুল আরো কম হবে। মাটিতে ছবি পেতে এইটে দেখেই আর্যভটের মাথায় একটা কথা খেলে গেল, তার মানে, যদি আমরা খুউব কাছাকাছি দুটো বিন্দু ধরে তার মধ্যে তার গতি বা দূরত্ব পরিবর্তনটা মাপি তাহলে বিন্দুদুটো যত কাছাকাছি হবে তত কমবে ভুলের পরিমাণ। আর এই খুউব ছোটো ছোটো টুকরোগুলোর ঠিকঠাক হিসেবকে জুড়ে নিলেই গোটা পথটার অনেক বেশি নিখুঁত হিসেব মিলে যাবে।
এই কাছাকাছি বিন্দুগুলোর দূরত্ব যত যত শূন্যর দিকে এগোবে ততই পরিমাপের ভুলটাও শূন্যর দিকে এগিয়ে যাবে।
কী বেজায় বুদ্ধি বলো দেখি?
এই যে একটা পরিবর্তনশীল রাশি (যেমন চাঁদের বিভিন্ন অবস্থান বা সে অবস্থানে তার গতি) মাপজোককে আরো বেশি নিখুঁত করবার জন্য তাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র টুকরোয় ভেঙে নিয়ে হিসেবটা করা, এই হল কলনবিদ্যা নামে অঙ্কটার একেবারে গোড়ার কথা।
আর্যভট অবশ্য কলনবিদ্যা বিজ্ঞানটার প্রতিষ্ঠা করেননি। সে এসেছিল আরও পরে। আরো অন্য অন্য মানুষজনের হাত ধরে। তবে তার গোড়ার বিষয়টাকে এইভাবেই ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁর মেধা।
এর পাশাপাশি কলনবিদ্যার আরও একটা প্রাথমিক বিষয়কে তিনি মেপে দেখেছিলেন। কৌণিক পরিমাপ করতে গিয়ে “জ্যা” নাম দিয়ে ত্রিকোণমিতির ‘সাইন’ নামের পরিমাপটার যে আদিরূপকে তিনি বানিয়েছিলেন তার হিসেবনিকেশ করতে গিয়েই তিনি তার দেখা পান। তবে সে গল্প পরের সংখ্যায়। সেখানে আমরা সাইন রহস্যর গল্প বলব। জানা যাবে কেমন করে ‘জ্যা’ নামটা বিচিত্র একটা ভুলের মধ্যে দিয়ে ‘সাইন’ নামে বদলে গেল বিলেতের অঙ্কখাতায়।
ক্রমশ
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর