এই লেখার আগের সমস্ত এপিসোড এই লিংকে একত্রে
আর্যভট্ তো ০ থেকে নব্বই ডিগ্রির মধ্যে মাত্র চব্বিশটা সমদূরত্বের কোণের জন্য সাইনের মান বের করতে পেরেছিলেন জ্যা মেপে মেপে। কিন্তু বাস্তবজীবনে কাজের সময় তো যেকোন কোনের জন্যই সাইনের মান বের করবার দরকার হয়ে পড়তে পারে। সে কাজটার জন্য আর্যভট প্রথমে ঐকিক নিয়মের সাহায্য নিলেন। কিন্তু তার প্রয়োগ করতে গিয়ে তিনি খেয়াল করলেন, কোণগুলোর মানের পালটানোর সঙ্গে তাদের সাইনের মান পাল্টানোটা ঠিক সমানভাবে ঘটছে না। সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম তফাৎ থেকে যাচ্ছে।
ব্যাপারটা একটু বুঝে নেয়া যাক। নীচের ছবিটা দেখ।
এবারে, ধরো তুমি সাইন ১ থেকে ঐকিক নিয়ম প্রয়োগ করে অন্য মানগুলো বানালে। তখন তাদের চেহারাগুলো কী দাঁড়াবে দেখ।তফাৎ যত বাড়ছে তত হিসেবের ভুলের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। আর্যভট বুদ্ধিমান ব্যক্তি। বুঝলেন, এমন ভুল থেকে গেলে মুশকিল। কারণ গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান মাপবার ক্ষেত্রে সুক্ষ্ম ভুলগুলোও অনেক বড়ো বড়ো হিসেবের গণ্ডগোল ঘটিয়ে দিতে পারে। ওদিকে আবার, শূণ্য থেকে নব্বই ডিগ্রির মধ্যে প্রত্যেকটা কোণের মানকেও তো জ্যা পেতে হিসেব করে বের করা সম্ভব নয়। (তুমি হয়ত ১ ডিগ্রি, ২, ৩, ৪,৫ —৯০ ডিগ্রিরও বের করে ফেললে সেভাবে, কিন্তু ১.৩ ডিগ্রি, বা ২.৪৫ ডিগ্রি? এমন তো অগুণতি থাকবে।) তাহলে উপায়?
তুমি আমি হলে ওইখানেই হাল ছেড়ে দিয়ে অনেক হয়েছে বলে খেলতে চলে যেতাম। কিন্তু আর্যভট সে বান্দাই নয়। খানিক ভেবেচিন্তে তিনি বললেন, দাঁড়াও। শূন্য থেকে নব্বই ডিগ্রির মধ্যে, ৩.৭৫ ডিগ্রি পর পর যে চব্বিশটা সমদূরত্বের কোণের সাইনের মান (সাইন ০, সাইন৩.৭৫,সাইন৭.৫—-) আমি হিসেব করে বের করেছি সেগুলোর মধ্যে তফাৎগুলো হিসেব করে দেখা যাক। তৈরি হল সাইনের সেই মানগুলোর মধ্যে বদলের হারের চার্ট। বলাবাহুল্য তারা ঠিক সুষম নয়। এইবার আর্যভট্ট আরেকটা উদ্ভট পদক্ষেপ নিলেন। বললেন, বদলগুলো কী হারে পালটাচ্ছে সেইটে দেখা যাক। এই দ্বিতীয় স্তরের তফাৎগুলো ( বা বদলের বদলে যাবার হার) দেখা গেল সাইনের মানগুলোর সঙ্গে সমানুপাতিক।
অন্যভাবে বললে, প্রথমে আর্যভট মাপলেন কোণের মান বাড়লে তার সাইনের মান কত দ্রুতহারে বাড়ে (একে আমরা আধুনিক কলনবিদ্যা বা ক্যালকুলাসের ভাষায় বলি সাইনের প্রথম ডেরিভেটিভ)। তারপর তিনি মেপে নিলেন কোণ যত বড়ো হয় তার সঙ্গেসঙ্গে এই মান বাড়বার হারটা কত দ্রুত বদলায় আধুনিক ক্যালকুলাসের ভাষায় সাইনের দ্বিতীয় ডেরিভেটিভ)। তখন তিনি দেখতে পেলেন সাইনের মান আর তার দ্বিতীয় ডেরিভেটিভের মান সমানুপাতিক।
এইখানে একটা ছোট্ট জিনিস শিখে নিই এস।
তিনটে প্রশ্নঃ ফেব্রুয়ারি, জুলাই আর সেপ্টেম্বর মাসে
১। ক’দিনে এক সপ্তাহ
২। ক’দিনে এক মাস
৩। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত?
উত্তরঃ
১। তিনটে মাসেই সাত দিনে এক সপ্তাহ
২। ২৮ বা ২৯, ৩১, ৩০
৩। ধুস। জানি না। প্রত্যেক মুহূর্তে চাঁদ উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে ঘিরে ছুটছে আর দূরত্বটা বদলাচ্ছে।
প্রথম জাতের রাশিকে বলে ধ্রুবরাশি। ওর মান সসময় এক থাকে।
দ্বিতীয় জাতের রাশিকে বলে অসন্তত চলরাশি। ওর মান অন্য রাশির মানের বদলের (এক্ষেত্রে মাসের সংখ্যা ২, ৭ আর ৯)ওপর নির্ভর করে বদলায় বটে, তবে কয়েকটা নির্দিষ্ট মানই নিতে পারে।
তৃতীয় জাতের রাশিকে বলে সন্তত চলরাশি বা কন্টিনিউয়াস ভেরিয়েবল। এখানে দূরত্বটা প্রত্যেক মুহূর্তে বদলে যায়। সময়টাকে যত সুক্ষ্ম করবে তত সুক্ষ্মভাবে সেটা বদলাতে থাকবে। নিকটতম আর দূরতম অবস্থানের মধ্যেকার সমস্ত মানই সে নেবে একেক সময় একক পার হতে গিয়ে। এই বস্তুটিকে না জেনে কায়দা করতে গিয়েই আর্যভটের হাতে সাইন টেবিল আর ঐ ক্যালকুলাসের একটা মূলতত্ত্বের আবিষ্কার।
সাইনের মান আর তার দ্বিতীয় ডেরিভেটিভের মান সমানুপাতিক—অদ্ভুত এই সমাপতনটা আর্যভট লক্ষ করেছিলেন। তবে তাকে বিশেষ কোন কাজে তিনি লাগাতে পারেননি। এবং, তা পেতে গিয়ে যে পদ্ধতিটার উদ্ভব তিনি করেছিলেন, সে-পদ্ধতিকে যেকোন সন্তত চলরাশির ডেরিভেটিভ বা দ্বিতীয় ডেরিভেটিভ বের করবার কৌশল হিসেবে গড়ে তোলা বা জীবনের অন্যান্য চলরাশির ক্ষেত্রে তাকে ব্যবহার করবার কথা তখন তিনি ভাবেননি।
পাশাপাশি, চাঁদের অবস্থানকে নিখুঁতভাবে ধরবার জন্য তার গতিপথকে অতিক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ভেঙে নিয়ে সেই খণ্ডমুহূর্তেগুলোয় তার গতি ও অবস্থানকে মেপে নেবার পদ্ধতির মধ্যে নিজের অজ্ঞাতেই তিনি বুনে দিয়েছিলেন কলনবিদ্যার দ্বিতীয় স্তম্ভ ইনফাইনাইটসিমাল (বা, তাঁর ভাষায় তৎকালিকা) গতিমুহূর্তের কথা। কিন্তু এই দুইকে জুড়ে সন্তত চলরাশির অতিক্ষুদ্র পরিসরে পরিবর্তনের হার পরিমাপের গণিত বা ক্যালকুলাসকে গড়ে তোলা তাঁর হয়ে ওঠেনি। তাঁর পুঁথিতে সেই ভবিষ্যতের কলনবিদ্যার বীজদুটি জন্ম নিয়ে ঘুমিয়ে রইল বহুকাল, ব্রহ্মগুপ্ত ও তাঁর পরবর্তী গণিতজ্ঞদের আসবার অপেক্ষায়।
ক্রমশ