এই লেখার আগের সমস্ত এপিসোড এই লিংকে একত্রে
আর্যভটের এক শতাব্দি বাদে আরেকজন গণিতজ্ঞ সাইনের মানের এই পরিবর্তনের হারের বিষয়ে কৌতুহলী হয়ে ওঠেন। তিনি ব্রহ্মগুপ্ত। এ-যে গণিতশাস্ত্রের এক সোনার খনি সে-কথা সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ব্রহ্মগুপ্ত এক অতুলনীয় গণিত প্রতিভা ছিলেন। সেইসঙ্গে একটা বৈপরিত্যও ছিল তাঁর বিজ্ঞানসাধনায়। একদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের তাঁর ধ্যানধারণা যেমন সেকেলে মার্কা, বিশুদ্ধ গণিতচর্চায় তা তেমনি আধুনিক, তেমনি দুঃসাহসী। আর্যভট পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘোরে বলবার জন্য ভারী রাগ করেছিলেন তিনি। মহাবিষুব আর জলবিষুব (ভের্নাল ও অটামনাল ইকুইনক্স)-এর অয়নচলন (বা সূর্যের অবস্থান বদলাবার সঙ্গেসঙ্গে বদলে যাওয়া) নিয়ে আর্যভটের চিন্তাভাবনাকেও বেশি গুরুত্ব দেননি। এর ফলে তাঁর তৈরি পঞ্জিকাগণনাপদ্ধতিতে কিছু বেজায়রকম ভুলও থেকে গিয়েছিল।
কিন্তু অঙ্কের খাতা নিয়ে বসলে তিনি একেবারে অন্য মানুষ। সর্বকালের সেরাদের অন্যতম। শূন্যের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন যে বইটাতে, সেই মহাগ্রন্থ ব্রহ্মসূত্র সিদ্ধান্ত লেখবার প্রায় ৩৫ বছর বাদে ব্রহ্মগুপ্তর খেয়াল হল, আর্যভটের করা সাইন-এর পরিবর্তনের হার বিষয়টাকে নিয়ে খানিক নাড়াচাড়া করে দেখা যাক।
ধরা যাক, শেয়ার বাজারে যে দামটাম পালটায় সে নিয়ে কয়েকদিনের তফাতের তথ্য কারো কাছে রয়েছে। সেক্ষেত্রে আগের আর পরের যে-কোনো দুটো দিনের দরদামের তথ্য থেকে ঐকিক নিয়মটিয়ম বা অন্যান্য কায়দাকানুন কাজে লাগিয়ে একজন গণিতজ্ঞ তাদের মাঝখানের কোনো একটা দিনে দরদামটা কেমন হবে তার একটা আন্দাজি হিসেব লাগাতে পারবেন। অঙ্কের ভাষায় একে বলে ইন্টারপোলেশান।
ব্যাপারটা অনেকটা এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফ মেরে যাবার মত। গাছদুটো যদি কাছাকাছি হয় তাহলে ঝাঁপটা নিখুঁত হবে। আর দূরে দূরে হলে লাফ দিতে গিয়ে মাটিতে আছাড় খেতে হবে। মার্চের দশ তারিখের দরদাম জানতে গেলে যার কাছে মার্চের পাঁচ আর পনেরো তারিখের তথ্য আছে তার হিসেবটা যতটা সঠিক হবে তার চেয়ে অনেক বেশি ভুল হবে যদি জানুয়ারির পয়লা আর এপ্রিলের তিরিশ তারিখের তথ্য নিয়ে ও-হিসেবটা করা হয়।
বিভিন্ন কোণের সাইনের মান নির্ধারণের ক্ষেত্রেও এই একই সমস্যা ছিল। আর্যভট যে সাইনের সারণি বা টেবিলটা বানিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে যেসব কোণের মান ছিল না সেগুলোকে বের করবার জন্য লোকজন করত্ত কী, উদ্দিষ্ট কোণটার কাছাকাছি যে কোনটার সাইনের মান টেবিলে রয়েছে সেইটের সঙ্গে তার পরের টেবিলে থাকা কোণের সাইনের মানের তফাৎটা কে কাজে লাগিয়ে একটা আন্দাজি উত্তর বের করে নিতেন।
একটু ভেঙে বলি। ধরো কেউ সাইন ৩১ ডিগ্রির মান চাইছেন। টেবিলে সাইন ৩০ ডিগ্রির মান ০.৫ আর সাইন ৩২ ডিগ্রির মান ০.৫৩ আছে বলে জানা আছে। অতএব ২ ডিগ্রির জন্য এদের সাইনের তফাৎ ০.০৩। তাহলে ১ ডিগ্রির জন্য তফাৎ হবে ০.০১৫। তাহলে সাইন ৩১ ডিগ্রির মান ধরে নেয়া যায় ০.৫১৫।
ধরো কেউ সাইন ৩১ ডিগ্রির মান চাইছেন। টেবিলে সাইন ৩০ ডিগ্রির মান ০.৫ আর সাইন ৪৫ ডিগ্রির মান ০.৭ আছে বলে জানা আছে। অতএব ১৫ ডিগ্রির জন্য এদের সাইনের তফাৎ ০.২। তাহলে ১ ডিগ্রির জন্য তফাৎ হবে ০.২/১৫ =০.০১৩। তাহলে সাইন ৩১ ডিগ্রির মান ধরে নেয়া যায় ০.৫১৩।
ক্যালকুলেটরে কষে দেখলে দেখবে আসল মানটা ওই ০.৫১৫ ।
অর্থ্যাৎ এই কায়দায় দুই ডিগ্রির ব্যবধানে দুটো জানা মান নিয়ে তার তফাৎ থেকে মধ্যের মানটা ইনটারপোলেট করলে তার উত্তর অনেক নিখুঁত হয় আর ১৫ ডিগ্রির ব্যবধানে দুটো জানা মান নিয়ে কাজটা করলে উত্তরটায় বেশ একটু ভুল হয়ে যায়।
তফাতটা আরো বাড়ালে কী হয় দেখঃ ধর টেবিলে সাইন ৩০ ডিগ্রির মান ০.৫ আর সাইন ৬০ ডিগ্রির মান ০.৮৬৬ আছে বলে জানা আছে। অতএব ৩০ ডিগ্রির জন্য এদের সাইনের তফাৎ ০.৩৬৬। তাহলে ১ ডিগ্রির জন্য তফাৎ হবে ০.৩৬৬/৩০ =০.০১২। তাহলে সাইন ৩১ ডিগ্রির মান ধরে নেয়া যাবে ০.৫১২।
ক্যালকুলেটরে কষে দেখলে দেখবে আসল মানটা ওই ০.৫১৫।
তার মানে যেদুটো মানের মধ্যে ইন্টারপোলেট করছি তাদের তফাৎ যত বাড়বে ততই বেড়ে যাবে আমাদের হিসেবের ভুলের পরিমাণ।
এইখানেই ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর খেলা দেখালেন। এমন একটা কায়দা তৈরি করলেন তিনি যাতে করে জানা মান দুটো ১৫ ডিগ্রি অবধি তফাতে থাকলেও তাদের মধ্যেকার কোনো কোণের সাইনের মানটা বেশ নিখুঁতভাবে মেপে ফেলা যায়।
আধুনিককালে এ কায়দাটাকে বলে স্টারলিং-এর ফর্মুলা। হরবখত তার ব্যবহারও করা হয়। কিন্তু সে-যুগের পক্ষে সে এক বিরাট আবিষ্কার ছিল। এতে তিনি গণিতশাস্ত্রে প্রথমবার ইনটারপোলেশান বা অন্তর্বর্তী মান নির্ণয়ের গণিতে চলরাশির মানের দ্বিস্তর তফাৎ (আগের সংখ্যা দেখ। মানের তফাৎ ও সেই তফাৎদের তফাৎ) এর প্রয়োগ করা হয়েছিল। কেমন করে যে ফর্মুলাটা বানিয়েছিলেন ব্রহ্মগুপ্ত সে-কথা তিনি ভেঙে বলে জাননি কোথাও। শুধু ফর্মুলাখানা দিয়ে গিয়েছিলেন মানুষকে। তবে লোকের বলে, জ্যামিতি ব্যবহার করে কায়দাটার আন্দাজ লাগিয়েছিলেন ব্রহ্মগুপ্ত।
তবে এই মানের তফাৎদের নিয়ে কাজ করলেও, অতিক্ষুদ্র (শূন্যের কাছাকাছি) ব্যবধানে কেমন করে তারা বদলায় সে নিয়ে কাজ করেননি। সে-কাজটা করেছিলেন দ্বিতীয় ভাস্কর। এর কয়েক শতাব্দি বাদে।
ক্রমশ