অংকের বিচিত্র জগত সব পর্ব একত্রে
এবারে ভাস্কর-২ এর সিদ্ধান্ত শিরোমণি নিয়ে আরেকটু গভীরভাবে দেখা যাক।
এর প্রথম ভাগটার নাম আগেই বলেছি লীলাবতী।
এই অংশটা লেখবার কারণ নিয়ে একটা জনশ্রুতি আছে। ইতিহাসের এপাড়ে বসে সে কাহিনি কতটা সত্যি তা জানবার কোনো উপায় নেই। তবে গল্পটা ভারী মন ছুঁয়ে যাওয়া, তাই এইখানে সেইটে বলে নেয়া যাক। এ বইয়ের পারসিক অনুবাদের দায়িত্ব মহামতি আকবর যাঁকে দিয়েছিলেন, সেই ফৈজির লেখায় গল্পটা পাওয়া যায় নাকি।
লীলাবতী ভাস্কর-২ এর মেয়ে। জন্মের পর তার ভাগ্য গুণে দেখেছিলেন ভাস্কর। দেখেছিলেন তাতে লেখা আছে চিরকৌমার্য ও সন্তানহীনতা। দেখেশুনে কোমর বাঁধলেন ভাস্কর। ঠিক করলেন গ্রহনক্ষত্রের সঠিক অবস্থানমুহূর্তে মেয়ের বিয়ে দিয়ে তাদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে রুখে দেবেন এই দুর্ভাগ্যকে।
সেইমতন কন্যাদানের মুহূর্ত স্থির হল। এখন সে মুহূর্তকে গণনা করা হবে কীভাবে? সেইকাজটা করবার জন্য ভাস্কর একটা জল ঘড়ি তৈরি করলেন। একপাত্র জলে তিনি ভাসিয়ে দিলেন একটা ছোটো বাটি। বাটির তলায় সুক্ষ একটা ফুটো। কতক্ষণে তা জলে ডুবে যায় তা আগে থেকে মেপে নিয়ে, গ্রহনক্ষত্ররা যে মুহূর্তে ঠিক জায়গায় আসবে, তার ঐ সময়টুকু আগে তিনি জলে ভাসিয়ে দিলেন বাটিটা।বাটি যে মুহূর্তে জলে ডুববে, সেই মুহূর্তে কন্যা সম্প্রদান করলেই সব বিপদের শান্তি।
কিন্তু নিয়তিকে কে রুখতে পারে? বিয়ের সাজগোজ সেরে লীলাবতির ভারী কৌতুহল হল, একবার জলঘড়িটা দেখতে যাবেন। যা ভাবা সেই কাজ। গুটি গুটি ঘরের ভেতর ঢুকে যেই না ঝুঁকেছেন বাটির ওপরে অমনি নিজের অজান্তে তাঁর গয়না থেকে একটা মুক্তো খসে পড়ল জলে। ওইতে ভারসাম্য বদলে গেল ফুটো পাত্রটার। বদলে গেল তার জলে ডুবে যাবার সময়। ভাস্করের অজান্তেই চলে গেল সঠিক মুহূর্তটা।
ব্যাপারটা যখন জানা গেল, তখন শুরুতে খুব হতাশ হলেন ভাস্কর। কিন্তু তারপর হতাশা ঝেরে ফেলে দুর্ভাগিনী মেয়েকে কথা দিলেন, তার নাম দিয়ে একটা অমর পুথি লিখে রেখে যাবেন তিনি। সেই পুথির নামের মধ্যে দিয়েই চিরকাল অমর হয়ে থাকবে সন্তানহীনা লীলাবতী। আর, এইভাবেই লীলাবতী পুথির জন্ম হল।
লীলাবতীর পুথিতে রয়েছে তেরোটা অধ্যায়। তাতে শূন্যের সংজ্ঞা, ঋণাত্মক রাশি ও করণি সংক্রান্ত সমস্যা, পাই-এর মাননির্ণয়, ৩, ৫, ৭ বা ৯ এই সংখ্যাগুলোর গুণ, বর্গ, অন্যোন্যক (রেসিপ্রোকাল) এইসব বের করবার পদ্ধতি, অ্যারিথমেটিক ও জিওমেট্রিক প্রোগ্রেশনের অঙ্ক, তলীয় জ্যামিতি,। ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি, সমবায় (সমবায় মানে কিন্তু কো –অপারেটিভ নয়। অঙ্কের ভাষায় ও হল গিয়ে একটা বড় দলের থেকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কতভাবে বিভিন্ন ছোটো ছোটো দল তৈরি করা যায় তার অঙ্ক। যেমন ধরো চল্লিশটা বাংলা আর সতেরোটা ইংরিজি বই-এর থেকে কতভাবে চারটে বই বেছে নেয়া যায় যাতে তাতে ইংরিজি আর বাংলা বই দুটো দুটো করে আসে। চেষ্টা করে দেখো তো পারো কি না! তুমি যদি স্কুলপড়ুয়া হও আর এইটে ঠিকঠাক কষে আমাদের জানাতে পারো তাহলে প্রথম যে ঠিক উত্তর দেবে তাকে জয়ঢাক প্রকাশন্থেকে একটা দারুণ বই উপহার দেয়া হবে।) এমন আরো অনেক কিছু।
বইটাতে অনেক মজার মজার অঙ্ক রয়েছে। সে’সব অঙ্ক সব শুরু হয় লীলাবতীকে উদ্দেশ্য করে। যেমন ধরো একটা অঙ্ক আছে, “মৃগনয়নী ছোট্ট মেয়ে লীলাবতী, তুমি যদি গুণ অঙ্ক শিখে থাকো, তাহলে বলো দেখি ১৩৫কে ১২ দিয়ে গুণ করলে গুণফল কত হয়? বলোতো রূপসী মেয়ে, তাকে ফের ১২ দিয়ে গুণ করলে ফল কত মিলবে?”
তবে সব অঙ্কই এত সহজ নয়। একটু বেশি মজাদার একটা অঙ্কের উদাহরণ দেখঃ
একদল মৌমাছির এক পঞ্চমাংশ একটা পদ্মফুলের মধু আনবার জন্য গেল। এক তৃতীয়াংশ গেল একটা কলাগাছের দিকে। তারপর কী হল জানো আমার মৃগনয়নী মেয়ে, তাদের সংখ্যাদের বিয়োগফলের তিনগুণ সংখ্যক মৌমাছি উড়ে গেল তিতোস্বাদের কোড়াগা গাছের ফুলের দিকে। তারা চলে যাবার পর পড়ে রইল একলা একটা মৌমাছি। সে শুধু একবার চাঁপাফুল আর একবার পান্দানুসের ফুলের দিকে ঊড়ে উড়ে যায়।
এবারে তবে বলো দেখি আমার মিষ্টি মেয়ে, ঝাঁকটায় কতগুলো মৌমাছি ছিল?
এমন সব মজাদার অঙ্কে ঠাসা পুথি ছিল লীলাবতী। বুঝতেই পারছ, সংখ্যাদের নিয়ে খেলা করে দৈনন্দিন জীবনের নানান সমস্যার সমাধান করবার নানা পদ্ধতিকে একত্র করা হয়েছিল এখানে। উদ্দেশ্য ছিল, অঙ্কের গভীর তত্ত্বকে বোঝবার বদলে কিছু যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বা ফর্মুলা ব্যবহার করে যাতে মানুষ সরাসরি কেজো অঙ্কগুলো কষতে পারে তার কায়দাগুলো ছাত্রদের বলে দেয়া, বা এককথায় ফলিত (অ্যাপ্লায়েড) গণিত।
সিদ্ধান্ত শিরোমণির আরেক অধ্যায়, বীজগণিত কিন্তু অনেক বেশি গভীর। তার বিস্তৃত আলোচনা বিশুদ্ধ গণিতের তত্ত্বকথা নিয়ে।
বারোটা ভাগে বিভক্ত এই অধ্যায়ে রয়েছে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যাদের ধর্ম, শূন্যের ধর্ম, বীজগণিতের অঙ্ক কষবার প্রধান অবলম্বন ‘অজানা রাশি’কে কাজে লাগাবার সুলুকসন্ধান, কুট্টক (কয়েক সংখ্যা আগে এর বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে আর্যভট-এর গণিত অংশে।এ হল একটা বড়ো সমীকরণকে ক্রমশ ছোটো থেকে আরো ছোটো চেহারায় ভেঙে নিয়ে তার পুর্ণসংখ্যার সমাধান খুঁজে বের করবার পদ্ধতি।) দুই তিন ও চার ঘাতের সরল একরাশির সমীকরণ, দুই রাশির সমীকরণ, ইনডিটারমিনেট (যার নির্দিষ্টসংখ্যক সমাধান পাওয়া যায় না) দ্বিঘাত সমীকরণ (যেমন 5×2+6y2=11 এখানে x ও y এর মান যদি ১ হয় তাহলে সমীকরণটা মিলবে। y=0 ও x=±√(11/5) হলেও মিলবে, x =0 ও = y ±√(11/6) হলেও মিলবে, আর x, y এর এমন অগুন্তি সব মানের জুড়ির জন্যই সমীকরণটা মিলে যাবে। অরথাৎ সমীকরণটার কোনো একটা নির্দিষ্ট সমাধান মিলবে না।), দুই রাশির দ্বিঘাত সমীকরণ এই সমস্ত বীজগাণিতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও তাদের সমাধানের পদ্ধতি রয়েছে এখানে।
এই বইতেই বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবার আবির্ভূত হয় সেই বিখ্যাত সূত্র—যেকোনো ধনাত্মক সংখ্যার দুটো বর্গমূল হয়, একটি ধণাত্মক ও একটি ঋণাত্মক (যেমন ধরো ৪-এর দুটো বর্গমূল হবে, (+)২ আর (-)২ কারণ দুটোরই বর্গ করলে ৪ মিলবে। অথবা ধরো ৩; (+)১.৭৩২… আর (-) ১.৭৩২… এই দুটো সংখ্যারই বর্গ করলে ৩ মেলে।)
এই অধ্যায়ে গণিতশাস্ত্রের আরো একটা বেজায় গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব রেখে গেছেন ভাস্কর-২:–
যেকোনো নির্দিষ্ট সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে তার ফল অসীম হয়, অসীমের সঙ্গে যে কোনো সংখ্যা যোগ করলে যোগফল অসীম হয়।
সূর্যকে ঘিরে একপাক ঘুরতে পৃথিবীর কতটা সময় লাগে? ভাস্কর ২ গণনা করে জানিয়েছিলেন, সময়টা হল ৩৬৫.২৫৮৮ দিন। আধুনিক যুগে হিসেবটা অনেক যন্ত্রপাতি নিয়ে কষে দেখা গেছে মানটা হল ৩৬৫.২৫৬৩, মানে মাত্রই তিন মিনিটের ভুল ছিল ভাস্কর-২ এর গণনায়।
এখানেই শেষ নয়। সিদ্ধান্ত শিরোমণির পরের অধ্যায়ে এসেছিল ত্রিকোণমিতি। ছিল এঞ্জিনিয়ারিং অঙ্ক, জ্যোতির্বিদ্যার অঙ্ক। সে গল্প পরের সংখ্যায়।