অঙ্কের বিচিত্র জগত সব পর্ব একত্রে
ত্রিকোণমিতির ক্ষেত্রে ভাস্কর-২ –এর সিদ্ধান্ত শিরোমণিতে কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে। সাইন কস, ট্যান, কট ইত্যাদি যে বিভিন্ন রকম ত্রিকোণমিতিক রূপ রয়েছে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করা রয়েছে সেই বইতে। রয়েছে বিভিন্ন কোণ-এর সাইন-এর মান হিসেব করবার টেবিল।
পাটিগণিত ও বীজগণিত বাদে সিদ্ধান্ত শিরোমণির আর দুটো অধ্যায় হল, গ্রহগণিত আর গোলাধ্যায় (গোলক বা পৃথিবী সম্পর্কিত হিসেবনিকেশ)
গ্রহগণিত অংশে রয়েছে ১২টা অধ্যায়। গ্রহের গড় দ্রাঘিমা, গ্রহের প্রকৃত দ্রাঘিমা, দৈনিক আবর্তনের তিনটি সমস্যা, সূর্য আর চাঁদের পারস্পরিক আপেক্ষিক অবস্থান সংক্রান্ত গণিত, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, অক্ষাংশ সম্পর্কিত হিসেবনিকেশ, সূর্যোদিয়ের সময় সংক্রান্ত সমীকরণ, চন্দ্রকলার বিবরণ, বিভিন্ন গ্রহের পারস্পরিক আপেক্ষিক অবস্থানগত হিসেবনিকেশ, ধ্রুবতারার মত স্থির অবস্থানে দেখতে পাওয়া তারাদের সাপেক্ষে গ্রহদের অবস্থানের হিসেবনিকেশ, সূর্য আর চন্দ্রের যাত্রাপথের অঙ্ক।
গোলাধ্যায় অংশে রয়েছে গোলকের হিসেবনিকেশ সম্পর্কিত তেরোটা অধ্যায়। তাতে গোলকের গাণিতিক চরিত্র, বিশ্বতত্ত্ব ও ভূগোলকতত্ত্ব, গ্রহদের গতিপথ, গ্রহদের আবর্তনের উপবৃত্তাকার পথের হিসেবনিকেশ, আর্মিলারি স্ফিয়ার (পৃথিবী বা সূর্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তার সাপেক্ষে মহাজাগতিক বস্তুদের অবস্থানের ত্রিমাত্রিক মডেল), গোলীয় ত্রিকোণমিতি, উপবৃত্তের হিসেবনিকেশ, চন্দ্রকলার পরিমাপ, জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার যন্ত্রপাতির বিবরণ, ঋতু, জ্যোতির্বিদ্যার হিসেবনিকেশ নিয়ে কিছু অঙ্ক।
এইখানে এই গোলীয় ত্রিকোণমিতি বিষয়টাকে একটু সরল করে বোঝবার চেষ্টা করা যাক। একটা লোক ধরো পুবদিকে এক মাইল হেঁটে গেছে। তারপর উত্তর মুখে ঘুরে ফের এক মাইল গেছে, তারপর পশ্চিম মুখ করে এক মাইল আর শেষে দক্ষিণ মুখ করে এক মাইল। তাহলে শুরুর বিন্দু থেকে শেষের বিন্দুর দূরত্ব কত?
যারা খানিক জ্যামিতি জানে তারা হেসে বলবে এ আর কঠিন কী? লোকটা একটা বর্গক্ষেত্রের এক কোণের বিন্দু থেকে রওনা হয়ে তার চারটে এক মাইল লম্বা বাহু ধরে হেঁটে ফের শুরুর বিন্দুতেই পৌঁছেছে। দূরত্ব শূন্য।
কিন্তু বাস্তব জীবনে তা কিন্তু ঘটে না। কারণ আমরা যে পৃথিবীর পিঠে থাকি সে একটা গোলক। তার পিঠটা বাঁকা। সেই বাঁকার পরিমাণটা আবার সর্বত্র একরকম নয়। ফলে আমরা যে পথ ধরে হাঁটি সেটা আসলে সরলরেখা নয়, সে আসলে গোলকের বাঁকানো পৃষ্ঠতল। খুব ছোটো দূরত্ব (ধরো এই এক মাইল) হাঁটলে,পৃথিবীর ব্যাস যেহেতু বিরাট , তাই সেটাকে একটা সরলরেখা বলেই ঠেকবে, আর তার ফলে শুরু আর শেষের বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব খুব সামান্য হবে। কিন্তু দূরত্বটা যদি অনেক বেড়ে যায়, ধরো গিয়ে একেকদিকে এক হাজার মাইল, তাহলে কিন্তু শুরু আর শেষের বন্দুটা এক থাকবে না। সঙ্গের ছবিটা দেখলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। এখন প্রশ্ন হল, যে সমতলভিত্তিক জ্যামিতি বা ত্রিকোণমিতি আমরা জানি তাই দিয়ে এই শুরু আর শেষের মধ্যের দূরত্ব মাপা সম্ভব নয়, কারণ, সে ধরেই নিয়েছে, জায়গাটা একেবারে সমতল, পরীক্ষার খাতার কাগজটার মত। তার হিসেবে সে দূরত্ব সবসময়েই শূন্য।
ঠিক একইভাবে আবার আমাদের ঘিরে যে মহাকাশ তার চরিত্রও কিন্তু ওই বাঁকা পৃষ্ঠতলযুক্ত গোলকের। গ্রহনক্ষত্ররা যে পথে তার গায়ে ঘোরে তাও সরলরৈখিক মোটেই নয়। ফলে সাধারণ ত্রিকোণমিতি দিয়ে গ্রহদের চলাচল, নক্ষত্রদের নিখুঁত অবস্থান বা সে বিষয়ক পূর্বাভাষ দিতে গেলে তাতে বেশ কিছু ভুল থেকে যাবে। আগেকার দিনে এর ফল হত পুজোয়ার্চার তিথি গুলিয়ে যাওয়া, তারপর ওতে সমস্যা হত গ্রহতারা দেখে জাহাজটাহাজের নিখুঁত অবস্থান নির্ণয়ে। এই গোলীয় চরিত্রের বস্তুকে সমতল চরিত্রের জ্যামিতি/ত্রিকোণমিতি দিয়ে হিসেব করতে গেলেই খানিক খানিক ভুল তাতে থেকে যেত। এখনকার দিনে সে সমস্যা আরো ভয়ঙ্কর। মহাকাশে যান যাচ্ছে আমাদের। কখন সে ঠিক কোনখানে পৌঁছোবে পাক খেতে খেতে তার নিখুঁত ও নির্ভুল হিসেব না থাকলেই চিত্তির।
সমস্যার এই চরিত্রটাকে অনুধাবন করেই গোলীয় ত্রিকোণমিতির হিসেবের কাজটা করেছিলেন ভাস্কর ২।
বিষয়টা খানিক জটিল। তাই তার বিস্তারিত বিবরণে যাব না। শুধু একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে ধরা যায় সেইটে বোঝাবার চেষ্টা করি।
সঙ্গের ছবিটা দেখঃ
একটা গোলকে ওপরে তুমি এ থেকে বি, বি থেকে সি-তে যাচ্ছ। সমতলভিত্তিক ত্রিকোণমিতি এ সম্পর্কিত যাবতীয় হিসেব করবে ওই লাল ত্রিভূজটাকে ধরে।
কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীর গোলীয় তলের দরুণ আসল যাত্রাটা ঘটবে ত্রিভূজের বাঁকানো কালো দাগগুলোর পথে। এর ফলে, ওই বাঁকা তাগের গোলীয় ত্রিভূজটার কোণগুলোও বদলে যাবে। তাদের যোগফল আর ১৮০ ডিগ্রি থাকবে না। আর সেটা হলেই ব্যস, সমতলের ত্রিকোণমিতির সব হিসেব যাবে গুলিয়ে। তাহলে সে যাত্রার হিসেবনিকেশ কীভাবে ঘটবে?
এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন হল রৈখিক ত্রিভূজ আর গোলীয় ত্রিভূজের কোণগুলোর মধ্যে একটা সমীকরণ খুঁজে বের করা। তাহলেই যেকোনো গোলীয় ত্রিভূজের সঙ্গে তূলনীয় একটা সমতল ত্রিভূজ বের করে নিয়ে তার ধর্ম থেকে গোলীয় ত্রিভূজের ধর্মগুলোকে নির্ণয় করে নেয়া যাবে। আর, তার থেকেই বেরিয়ে আসবে গোলীয় তলের ত্রিকোণমিতি।
প্রযুক্তিবিদ্যা
ভাস্কর ২ এ লাইনে বেশ কিছু আকর্ষণীয় কাজ করেছেন। তার একটা হল যষ্টিযন্ত্র। জিনিসটা একটা লাঠি। সেটাকে আবার ইংরিজি ভি অক্ষরটার মত করে বিভিন্ন কোণে বাঁকানো যায়। তার গায়ে আবার কোণ পরিমাপক দাগটাগ কাটা আছে। যষ্টিযন্ত্র দিয়ে বিভিন্ন কোণকে নিখুঁতভাবে মেপে ফেলা যেত।
আরেকটা অদ্ভুত দাবীর কথা বলে আজকের মত শেষ করব। বাস্কর ২ একখানা বিবিত্র চাকার বিবরণ দিয়েছিলেন যেটা নাকি একবার চালিয়ে দিলে চিরকাল চলতে থাকবে। ১১৫০ খৃস্টাব্দে সেই প্রথম মানুষের পার্পেচুয়াল মোশন মেশিন তৈরি করবার চেষ্টা। ভাবো একবার!
ক্রমশ