অঙ্কের বিচিত্র জগত সব পর্ব একত্রে
বৈজ্ঞানিক
তা, ভাস্কর২ এর কাজকর্মের পর গণিত নিয়ে মৌলিক অগ্রগতির কাজ বেশ কিছুদিন থমকে ছিল। আসলে দ্বাদশ শতকের উত্তর ভারতে জ্ঞানের চর্চা, ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহ আর আমূল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধাক্কায় স্বাভাবিকভাবেই থমকে গিয়েছিল। মৌলিক তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য যে শান্তি আর নিশ্চিন্ততার আবহাওয়া দরকার হয় তার বড়ো অভাব ঘটেছিল উত্তাল সেই দিনগুলোতে। ভিনদেশ থেকে আসা তুর্কি, আফগান ও অন্যান্যরা তখন তলোয়ার, ষড়যন্ত্র আর ধর্ম এই তিন অস্ত্রে এদেশে নতুন রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি করছে।
বেশ কয়েকটা শতাব্দি কেটে গেল সেই অস্থিরতার বাতাবরণে। আর তারপর, ভারতবর্ষের গণিতচর্চা ফের মাথা তুলল সুদূর দক্ষিণে কেরালার মাটিতে। সেখানে জন্ম নিলেন মাধব। আজকে যেখানে ত্রিশূর শহর, তার কাছাকাছি এলাকায় তাঁর জন্ম। তিনি ত্রিকোণমিতিতে সাইন-এর যে মানটা আবিষ্কার করলেন সেইটে বুঝতে গেলে একটু ভুমিকা প্রয়োজন।
ধরো একটা ছুটন্ত ট্রেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে কতটা দূর যাবে তার হিসেব চাই তোমার। এর রাস্তা হল, তার একটা গড় গতির আন্দাজ নেয়া ও তাকে সময় দিয়ে গুণ করা।
এখন ট্রেন তো আর এক গতিতে চলবে না। সে বাড়াকমা করবে। সেক্ষেত্রে এই গড় গতিটা বের করতে গিয়ে তুমি শুরু ও শেষের মধ্যে তিনটে বিন্দুতে তার গতি নিয়ে তার গড় করলে একটা আন্দাজ পাবে, তবে তাতে খানিক ভুল থেকে যাবে। বিন্দুর সংখ্যা বাড়ালে ভুলের পরিমাণ কমতে থাকবে। ওদিকে আবার খুব বেশি বিন্দু নিলে অঙ্কটা এত বড়ো হয়ে যাবে যে তখন তাকে সামলানো দুষ্কর। তাহলে উপায়?
উপায় হল ট্রেনটার গতিপথে কয়েকটা বিন্দু ধরে নিয়ে তাদের মধ্যে তার গতি পরিবর্তনের হারটা মেপে ফেলা। এই গতিবদলের হারটা ব্যবহার করে, বিন্দুগুলোর মধ্যে একটা থেকে আরেকটায় যেতে যে সময় সে নিচ্ছে তার হিসেব করলে ভুলটা খানিক কমবে।
কিন্তু মুশকিল হল, গতি পরিবর্তনের এই হারটাও কিন্তু সর্বত্র এক থাকে না। যাত্রাপথের দুটো বিন্দুর মধ্যে ট্রেন যে হারে গতি বদলাচ্ছে বলে তুমি দেখছ সেই হারটা আসলে ওই দুই বিন্দুর মধ্যে বিভিন্ন হারে গতি বদলের একটা গড়। ফলে গতি পরিবর্তনের এই হারটা আবার কী হারে বদলাচ্ছে সেইটে যদি হিসেবের মধ্যে ধরো তাহলে মাপজোকের ভুলটা আরো কমবে।
এইবার এই যুক্তিটাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়… গতি পরিবর্তনের হারà গতি পরিবর্তনের হার পরিবর্তনের হারà গতি পরিবর্তনের হার পরিবর্তনের হার পরিবর্তনের হারà গতি পরিবর্তনের হার পরিবর্তনের হার পরিবর্তনের হার পরিবর্তনের হার। যত বেশি সুক্ষ্মভাবে মাপবে ততই তোমার উত্তরটা আরো নিখুঁত হয়ে উঠবে। কমবে ভুলের পরিমাণ। কিন্তু মুশকিল হল, এই সুক্ষ্মতা যত বাড়বে ততই বেজায় গতিতে বেড়ে যাবে অঙ্কটা কষবার ঝামেলা।
এই যে কোনো ক্রমাগত বদলাতে থাকা রাশির বদলের হার, ভারতীয় গণিতশাস্ত্রে একে বলে তার অবকল। আর সাহেবি অঙ্কে তাকে আমরা জানি ডেরিভেটিভ নামে। পরিবর্তনের হার-কে বলব প্রথম স্তরের ডেরিভেটিভ। পরিবর্তনের হার পরিবর্তনের হারকে বলব দ্বিতীয় স্তরের ডেরিভেটিভ আর এমনি করে পরের ধাপগুলো হবে তৃতীয়, চতুর্থ স্তরের ডেরিভেটিভ।
এবারে, ধরো, একটা গ্রহ সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে। তার গতি বদলে যাচ্ছে প্রত্যেক মুহূর্তে। কক্ষপথে তার দুটো অবস্থানকে দুটো বিন্দু আর কেন্দ্রস্থলে সূর্যকে একটা বিন্দু ধরে একটা ত্রিভূজ আঁকলে (আর্যভট এইভাবে ত্রিকোনোমিতিতে কোনো কোণের ‘সাইন’-এর মান বের করেছিলেন, মনে পড়ছে? সাইনের রহস্যটা জানতে হলে জয়ঢাকের ৬২ নম্বর সংখ্যায় এই লেখার এপিসোডটা দেখ) সূর্যকে চূড়া ধরে যে কোণটা তৈরি হবে তার সাইন-এর মান বের করতে পারলে, সেই সাইন-এর মান কীভাবে বদলাচ্ছে সেই থেকে গ্রহটার গড় গতিটাও বের করে ফেলা যাবে। এইবার এখানে ওপরের যুক্তিটা প্রয়োগ কর। এই বদলের হারের যত উঁচু স্তরের ডেরিভেটিভ তুমি বের করতে পারবে ততই কমবে গ্রহদের গতি, গতিপথ এইসব মাপজোক করবার কাজে তোমার ভুলের পরিমাণ।
তা মাধব এই কঠিন কাজটা করে ফেলেছিলেন। ত্রিকোণমিতিতে সাইন-এর চতুর্থ স্তরের ডেরিভেটিভ বের করে ফেলেছিলেন তিনি। তবে মুশকিল হল, সে কাজের পরপর ধাপগুলো তিনি নথিভুক্ত করে যাননি। আজকের গণিতে কলনবিদ্যা বা ক্যালকুলাসের সাহায্যে এই বিভিন্ন স্তরের ডেরিভেটিভ বের করা হয়। ক্যালকুলাস দিয়ে হিসেব করা সাইন-এর এই ডেরিভেটিভদের মান, মাধবের কষা ডেরিভেটিভদের মানের খুবই কাছাকাছি। অথচ মাধব কলনবিদ্যা জানতেন না বা তার প্রয়োগও করেননি। গণিতের ইতিহাসবিদদের অনুমান কাজটা তিনি করেছিলেন জ্যামিতিক পদ্ধতিতে।
মাধবের কোনো পুথির সন্ধান মেলেনি। পরবর্তী গণিতজ্ঞদের কাজে তাঁর উল্লেখ থেকে তাঁর কাজগুলোর হদিশ মেলে।
অসীম নিয়ে মাধব বেশ সচ্ছন্দ ছিলেন। ‘অসীম শ্রেণী’ নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, ১/২ + ১/৪ +১/৮ +১/১৬ এইভাবে যোগ করতে থাকলে ক্রমশই যোগফলটার মান ১ এর কাছে এসে পৌঁছোয়। কিন্তু যোগফল ঠিকঠাক ১ পেতে গেলে এই শ্রেণীটাকে অসীম অবধি বাড়িয়ে যেতে হবে। (এইটে অসীম শ্রেণীর একটা উদাহরণ)
বিষয়টা প্রাচীন গ্রিস ও মিশরের গণিতবিদরাও জানতেন। কিন্তু এখানেই থেমে না থেকে মাধব আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তিনি করলেন কি, অসীম শ্রেণীর ধারণাটাকে সরাসরি জ্যামিতি আর ত্রিকোণমিতিতে নিয়ে এলেন।
‘পাই’ ব্যাপারটা তো জানো। যেকোনো বৃত্তের পরিধি আর ব্যাসের অনুপাতটা সবসময় ২২/৭ এই মানটার সমান হয়। এই মানটাকে দশমিকে প্রকাশ করতে হলে তাতে ভাগশেষ কখনো শূন্য হয় না। ভাগফলটা ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭…… এইভাবে চলতেই থাকবে। তিন আর চারের মধ্যে থাকবে মানটা। কিন্তু তা ঠিক কত তা জানা যাবে না। আর এইখানেই মাধব নিয়ে এলেন তাঁর অসীম শ্রেণীর ধারণাকে। বললেন চার-এর সঙ্গে ক্রমাগত ৪/৩, ৪/৫, ৪/৭, ৪/৯ এইভাবে একবার যোগ আর একবার বিয়োগ করতে থাকলে উত্তরটা ক্রমশ পাই-=এর আসল মানের কাছাকাছি আসতে থাকবে, আর তাকে অসীম পর্যন্ত কষতে থাকলে পাওয়া যাবে পাই-এর সঠিক মান।
সঙ্গের ছবিটায় ব্যাপারটা দেখলে বোঝা যাবে কীভাবে পরপর যোগ আর বিয়োগের মধ্যে দিয়ে মানটা পাই-এর আসল মানের কাছে স্ক্রু-এর প্যাঁচের মত এগিয়ে আসছে। পদ্ধতিটা কাজে লাগিয়ে দশমিকের পর তেরো ঘর অবধি নিখুঁতভাবে পাই এর মান বের করেছিলেন মাধব।
এই একই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সাইন-এর মানও যতটা প্রয়োজন তত নিখুঁত করে বের করবার কৌশল বানিয়ে দেখালেন তিনি। আর, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই এই মানগুলোতে কতটা ভুল রয়ে গেল তারও একটা আন্দাজ তিনি দিলেন। মাধবের এই ত্রিকোণমিতিক রাশির অসীম শ্রেণীর মান নির্ণয়ের পদ্ধতির আরও উন্নতিসাধন করেন তাঁর পরবর্তীকালে কেরালার গণিতজ্ঞরা। এরপর কোচি বন্দরের এলাকায় কার্যরত জেসুইট পাদ্রিদের হাত ধরে এই বিশ্লেষণগুলো ইউরোপে পৌঁছোয়। পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত ক্যালকুলাস ও রিয়েল অ্যানালিসিস নামে অঙ্কের দুটো শক্তিশালী ধারার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল এই কাজগুলোর মাধ্যমে।
মাধবের একটা ছোট্ট আবিষ্কারের কথা দিয়ে এই সংখ্যার লেখা শেষ করব। প্রতি ৩৬ মিনিট অন্তর চাঁদের অবস্থান বের করবার অঙ্ক তৈরি করেছিলেন তিনি।
ক্রমশ