আবিষ্কারের খোঁজখবর আগের পর্বগুলো একত্রে
রাজীবকুমার সাহা
এই নীলগ্রহের জন্মলগ্ন থেকেই ঘটে চলেছে কতই না আজব কাণ্ডকীর্তি। বিশেষত মানুষ বা তার পূর্ব-প্রজাতির সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন আবিষ্কার। আদিযুগ থেকে বিভিন্ন খোঁজ আর আবিষ্কারের যথাসম্ভব তথ্য ক্রমানুসারে নথিভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে এই বিভাগে।
পর্ব – ১২
কপিকল (Pulley) (খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০)
কপিকল ভার উত্তোলনকারী সহায়ক যন্ত্র হিসেবে পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত। প্রায় ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বে অ্যাসিরীয় জনজাতি দ্বারা সর্বপ্রথম কপিকলের ব্যবহার প্রমাণিত হয়েছে। সে যুগে আঁকা যুদ্ধক্ষেত্রের এক ছবিতে দেখে যায়, এক সৈনিক কপিকলে দড়ি পেঁচিয়ে কুয়ো থেকে বালতি ভরে জল তুলছে। কপিকল জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা চাকা যা নিজের অক্ষদণ্ডে ঘুরে গিয়ে বেড় দেওয়া দড়ির ভারকে অপেক্ষাকৃত কম আয়াসে ওঠানামা করাতে সক্ষম। সে কৌশল আজও জাহাজ থেকে থিয়েটারের পর্দা অবধি সমান কার্যকারী।
বাকল (Buckle) (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০)
এ জিনিস প্রথম তৈরি করে গ্রীকরা। সময়কাল প্রায় ৭০০ খ্রিস্টপূর্ব। প্রাচীনকালে বাকল তৈরি হত হাড়গোড়, হাতির দাঁত আর বিভিন্ন ধাতু থেকে। ব্যবহার হত মিলিটারি সাজপোশাক, ঘোড়ার সাজ আর বর্মে। পোশাকে চেন আঁটার কৌশল আবিষ্কারের আগে অবধি তারা জুতো, কোমর বন্ধনীতে বাকল ব্যবহার করত।
নোঙর (Anchor) (খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০)
সে পাল তোলা নৌকোই হোক কিংবা জাহাজ, তীরে ভিড়িয়ে ওই নোঙরটি না করালে দুর্গতির শেষ নেই। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর, গ্রীস এবং রোমে নাবিকেরা এক ঝুড়ি পাথর কিংবা বালিভর্তি থলে জলে ডুবিয়ে দিয়ে তাতে তাদের জলযান বেঁধে রাখত। তারপর প্রচলিত হল বড়সড় এক পাথর জলে ফেলে তাতে বেঁধে রাখা।
ধীরে ধীরে সে নোঙরের আকার আকৃতি এবং প্রস্তুতির ধরন পরিবর্তিত হতে থাকল যার যার জলযানের আকার-আকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। শুরু হল ব্রোঞ্জ, কাঠ, লোহা ইত্যাদি দ্বারা আংটা সদৃশ নোঙর নির্মাণ যা প্রাচীন পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি সুবিধেজনক ও কার্যকর।
আধুনিক নোঙরের রূপকার হিসেবে কিংবদন্তী রাজা মিডাসকে মনে করা হয়। সে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কথা। কিন্তু অন্য এক সূত্র দাবি করে যে, ৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই গ্রীক নাবিকেরা আধুনিক নোঙর নির্মাণ করতে সক্ষম হয় যা আজও সমানভাবে প্রযোজ্য। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কির ক্লাজোমেনাই নামক স্থানের গ্রীক কলোনিতে পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ধাতুর পাতে মোড়া এক কাঠের নোঙর খুঁজে পাওয়া যায় যা পূর্ণ ধাতুর নোঙরের ঠিক পূর্ববর্তী অবস্থা বলে ধারণা করা হয়। কার্বন ডেটিং পরীক্ষায় সে নোঙরের জন্মকাল স্থির হয়েছে ৬০০ খ্রিস্টপূর্ব।
আড়ধনু (Crossbow) (৫৫০ খ্রিস্টপূর্ব)
আড়ধনু আবিষ্কার তৎকালীন যুগে নিঃসন্দেহে যুদ্ধবিদ্যায় অনন্য এক কৌশলের জন্ম দিয়েছিল। এই আবিষ্কার ক্রমে এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সুদূর ইউরোপ অবধি পৌঁছেছিল। একেকজন তিরন্দাজের কাছে তা ছিল যুদ্ধদেবতার আশীর্বাদ স্বরূপ।
এই আবিষ্কার সর্বপ্রথম ঘটে চিন বা তার প্রতিবেশী মধ্য এশিয়ার কোনও এক অঞ্চলে। আজও জানা যায় না সে অভিনব ও শক্তিশালী শস্ত্র কে বা কারা আবিষ্কার করেছিল। তবে খুঁজে পাওয়া প্রামাণ্য আড়ধনুতে লিখিত ভাষা ও তার পরীক্ষিত বয়স সে শস্ত্রের উৎপত্তিস্থল চিন বা মধ্য এশিয়ার দিকেই নির্দেশ করে।
ভার উত্তোলনকারী কপিকল (Crane) (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০)
ক্রেন সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয় গ্রীক স্থপতিদের দ্বারা প্রায় ৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ঘরবাড়ি দালানকোঠা নির্মাণে মনুষ্যের সাধ্যাতীত ভার উত্তোলনে এই যন্ত্রের আবিষ্কার প্রকৌশল বিদ্যায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ধীরে ধীরে এ কৌশল বিভিন্ন পেশায় ছড়িয়ে পড়ে। সে থেকে আজ অবধি ক্রেন তার কর্মকুশলতায় সমান উপযোগী।
কৃত্রিম অঙ্গ (Artificial Limb) (৫৫০ খ্রিস্টপূর্ব)
কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। যার সময়কাল হিসেবে ৩৫০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বকে ধরা হয়। যুদ্ধ বীরাঙ্গনা রানি বিষপলা যুদ্ধক্ষেত্রে তার একটি পা হারালে দেব চিকিৎসকদ্বয় অশ্বিনীকুমারেরা লোহা নির্মিত নকল পা সফল প্রতিস্থাপন করেন।
তবে এই উল্লেখ সর্বজন স্বীকৃত নয়। অন্য সূত্র মতে অর্থাৎ হেরোডোটাসের লিখিত বয়ান অনুসারে, খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতাব্দী সময়কালে স্পার্টানরা হেজেসিসট্রেটাস নামের এক পার্সি সৈনিককে যুদ্ধবন্দি করে। সে সৈনিক নিজের পায়ের নিম্নাংশ কেটে ফেলে বেড়ি খুলে পালিয়ে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ফেলে। সে কাঠের নকল পা লাগিয়ে সে পথ পাড়ি দেয়। পরে অবশ্য তাকে ফের ধরে এনে শিরশ্ছেদ করা হয়।
১৯৫৮ সালে ইতালির কাপ্রি/ক্যাপুয়াতে কাঠ এবং তামার মিশ্রণে নির্মিত এক নকল পায়ের খোঁজ পাওয়া যায় যা কার্বন ডেটিং পরীক্ষায় ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়কালের বলে জানা যায়।
উইঞ্চ (শক্তিশালী কপিকলবিশেষ) (Winch) (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০)
ভার উত্তোলনকারী এই যন্ত্রের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হেরোডোটাস লিখিত পারস্য যুদ্ধের বিবরণে। সময়কাল ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কাষ্ঠনির্মিত এই যন্ত্রের সাহায্যে সেতুবন্ধনের মোটা মোটা কাছি সজোরে টেনে কষিয়ে বাঁধার কাজ করা হত। এক শতাব্দীর মধ্যেই ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়কালে অ্যাসিরীয়দের আবিষ্কার সে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হল গ্রীক স্থপতিদের কর্মক্ষেত্রে।
দোলনা বিছানা (Hammock) (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৫)
এ আবিষ্কারের পেছনে মায়ান ইন্ডিয়ানদের একটা উল্লেখ থাকলেও প্রমাণাভাবে সেটা স্বীকৃত নয়। বরং সে কৃতিত্ব দেওয়া হয় সক্রেটিসের ছাত্র গ্রীসবাসী অ্যালসিবায়াডেসকে (জীবৎকাল ৪৫০ — ৪০৪ খ্রিস্টপূর্ব)।
ধাতু শৃঙ্খলিত বর্ম (Chain Mail) (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০)
ছোটো ছোটো ধাতুর গোলাকার আংটি একে অপরের সঙ্গে শৃঙ্খলিত করে তৈরি করা হত সে বর্ম। শিরস্ত্রাণ থেকে সে শৃঙ্খল বোনা শুরু হয়ে যোদ্ধার কোমর অবধি ঝুলে থাকত তা। প্রথম প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় রোমান সেল্টিক সমাধিতে। পরীক্ষাগারে সে বর্মের নির্মাণকাল নির্ধারিত হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী।
পাতন (Distillation) (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০)
পূর্ববর্তী ধারণা অনুযায়ী পাতন প্রক্রিয়া আবিষ্কারের সময়কাল এতদিন খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী ধরা হত। তবে বর্তমান পাকিস্তানে সংগ্রহীত সাম্প্রতিক প্রমাণাদি অন্য কথা বলছে। দেখা যাচ্ছে, এ অঞ্চলে পাতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুই রাসায়নিক পদার্থকে আলাদা করার কৌশল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর সময়েই বিদ্যমান ছিল।
(চলবে)