আবিষ্কারের খোঁজখবর সব পর্ব একত্রে
এই নীলগ্রহের জন্মলগ্ন থেকেই ঘটে চলেছে কতই না আজব কাণ্ডকীর্তি। বিশেষত মানুষ বা তার পূর্ব-প্রজাতির সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন আবিষ্কার। আদিযুগ থেকে বিভিন্ন খোঁজ আর আবিষ্কারের যথাসম্ভব তথ্য ক্রমানুসারে নথিভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে এই বিভাগে।
পর্ব – ১১
জলঘড়ি (Water Clock) (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০)
জলঘড়ি বা গ্রীক ভাষায় ‘ক্লেপসিন্দ্রা’ হচ্ছে এমনই এক যন্ত্র যার সাহায্যে কোনও নিয়ন্ত্রিত জলরাশিকে কোনও নির্গমন নালির নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনায়াসে নির্গত জলের পরিমাণ মাপা যায়। এ ঘড়ি চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর দৃষ্টি রেখে চালনার ওপর নির্ভরশীল নয়। প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কালের এমনই এক ঘড়ি আবিষ্কৃত হয় আমেনহোটেপ-এক সমাধিস্থলে। প্রাথমিক অবস্থায় পাথর কেটে গোলাকার পাত্র তৈরি করে নিয়ে তাকে জলঘড়ি হিসেবে ব্যবহার করলেও পরবর্তী সময়ে তাতে ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়। উক্ত পাত্রের ভেতরের দিকে সময়ের দাগ কাটা থাকত। জল এসে জমা হলে সে দাগ ধরে নির্ণয় করে নেওয়া হত কতটা সময়ে কত পরিমাণ জল জমেছে।
ইস্পাত (Steel) (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০)
সর্বপ্রথম পূর্ব আফ্রিকায় উপ-সাহারা অঞ্চলে প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইস্পাতের জন্ম ঘটে। অ্যান্টোলিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল খনন করে তা উদ্ধার করা হয়। ইস্পাত হচ্ছে মূলত লোহা এবং ০.২-২.৪ শতাংশ কার্বনের সংমিশ্রণ। এছাড়াও তাতে ভ্যানাডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও টাংস্টেনের উপাদান পরিলক্ষিত হয়। ভারতবর্ষে এর প্রচলন শুরু হয় অনেক পরে প্রায় ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
তলোয়ার (Sword) (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০)
মানুষ ব্রোঞ্জযুগেই এধরনের ধাতব অস্ত্র তৈরি করতে শিখে গিয়েছিল। তবে তা ছিল বড়োজোর ছোরা-আকৃতির। পরবর্তী সময়ে রোমান সভ্যতায় ছোরা অপেক্ষা বৃহদাকার বাঁকানো তলোয়ার কারিগরেরা তৈরি করতে সক্ষম হয়। সময়কাল প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
হাল (Rudder) (খ্রিস্টপূর্ব ১৪২০)
মিশরীয় সমাধিক্ষেত্রের দেওয়ালচিত্রে প্রায় ১৪২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সময়কালের সর্বপ্রথম হালের হদিশ মেলে। নৌকোর গতিপথ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রায় আয়াসহীন এই যন্ত্রাংশ মানুষ সেই কালেই আবিষ্কার করে ফেলেছিল। টুকরো কাঠের পরিমাপমতো তক্তা জুড়ে ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের মতো আকারের হাল নৌকোর পেছনে লাগিয়ে সে যুগের মানুষ জলপথ পাড়ি দিত। এর মূল কৌশল আজও সমানভাবে যেকোনও জলযানে ব্যবহৃত হয়।
গণনা-যন্ত্র (Abacus) (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০)
কাঠের বা প্লাস্টিকের ফ্রেমে ইস্পাতের শলাকায় গাঁথা পুঁতির যেসব অ্যাবাকাস আমরা বর্তমানে দেখতে পাই, সে আবিষ্কার হয়েছিল প্রায় ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। মেসোপটেমিয়ার বাসিন্দারা তখনকার যুগে কাদামাটির ফ্রেমে কাঠের শলাকায় চ্যাপটা আকৃতির নুড়ি-পাথর গেঁথে গণনা-যন্ত্র তৈরি করে নিয়েছিল। একেকটা নুড়ি সরিয়ে সরিয়ে তারা গণনা সম্পাদন করার পর সামান্য ঝাঁকিয়ে সে যন্ত্র আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনত। শুরু হত আবার নতুন গণনা।
খেয়া সেতু (Pontoon Bridge) (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০)
কাল ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। প্রাচীন চিনে তখন ঝউ সাম্রাজ্যের রাজা ওয়েন-এর রাজত্ব। তাঁর বিয়ে ঠিক হল। কিন্তু রাজধানী থেকে বরযাত্রীদের বিয়ের আসরে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটা বিরাট সমস্যা দাঁড়াল। মাঝে ওয়েহি নদী। পারাপারের ব্যবস্থা নেই। সম্রাটের আদেশে অচিরেই তৈরি হয়ে গেল নদীর বুকে ভাসমান লম্বা এক বাঁশের সাঁকো। সে সাঁকো দেখতে কিছুটা খেয়া নৌকোর মতো। সেই প্রথম পৃথিবীর মানুষ অপ্রশস্ত নদীর বুকে সাঁকো তৈরি করে পারাপার শিখে নিল।
সম্রাট ওয়েনের এই সাঁকোর ডিজাইন এখনও বিভিন্ন দেশের মিলিটারি প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকে।
দ্বারভাঙা দণ্ড (Battering Ram) (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০)
মানবসভ্যতার যতই বিকাশ ঘটতে লাগল, যুদ্ধবিগ্রহ ততই প্রবল হয়ে উঠতে থাকল। দিন দিন প্রয়োজন হয়ে পড়ল নতুন নতুন অস্ত্রশস্ত্র-যন্ত্রপাতির। বড়ো বড়ো পাথরের টুকরোর উঁচু উঁচু দুর্গ তৈরি করে মানুষ শত্রুর আক্রমণ আর ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। কারণ, ততদিনে সে শত্রু লৌহদৃঢ় কপাটও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে শিখে গেছে। আবিষ্কার করে ফেলেছে দ্বারভাঙা দণ্ড। শক্ত গাছের গুঁড়িকে দু-চার দশজনে মিলে উঠিয়ে তা দিয়ে মুহুর্মুহু আঘাত করে দেওয়াল ভাঙতে শুরু করেছিল প্রথমে। ক্রমে সে দণ্ডের মাথা ধাতব ফলকে মুড়ে আরও কার্যকরী করে তুলল। তারপর চাকাযুক্ত যান তৈরি করে তাতে কপিকলের আদলে উল্লম্বভাবে ঝুলিয়ে ধাক্কায় ধাক্কায় সে দণ্ডের আঘাত করা হত দুর্গের দেওয়াল বা দরজায়। এ দণ্ড প্রথম তৈরি হয় অ্যাসিরীয় সভ্যতায় প্রায় ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
স্যান্ডউইচ (Sandwich) (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০)
আধুনিক সভ্যতায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্যান্ডউইচের জন্ম হিসেবে মানা হলেও খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সময়কালে সে জিনিসের ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। দু’টুকরো রুটি বা সে জাতীয় খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে অন্যান্য খাদ্যবস্তু পরতে পরতে সাজিয়ে তা গলাধঃকরণের রীতি সে যুগেও ছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।
টিকা (Inoculation) (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০)
প্রাণ থাকলে বিভিন্ন রোগবালাইও থাকবে বলা বাহুল্য। প্রাচীন মানবসভ্যতা এমন ভুরিভুরি রোগের শিকারও হয়ে আসছিল, প্রতিকারের উপায় বের করা যাচ্ছিল না। সভ্যতার এ ধাপে এসে আমরা সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রমাণ পাই। আবিষ্কৃত হয় এক মারণরোগ থেকে অব্যাহতির টিকা।
তৎকালীন চিনা প্রধানমন্ত্রী ওয়াং ড্যান-এর জ্যেষ্ঠপুত্রের গুটি বসন্তে মৃত্যুর পর তিনি বেজায় মুষড়ে পড়েন। সে ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সময়কাল। অচিরে তিনি এমন এক সন্ন্যাসীর খোঁজ পান যিনি টিকারূপে এ রোগের ওষুধ জানেন। সে সন্ন্যাসী বিষ দিয়ে বিষক্ষয় করতেন। যা আধুনিক যুগের টিকাকরণ পদ্ধতির মূল কৌশল। তিনি আক্রান্তের শরীর থেকে মামড়িযুক্ত ফুসকুড়ি তুলে এনে সুস্থ মানুষের নাকে ঢুকিয়ে দিতেন। এতে সে রোগের জীবাণু সুস্থ মানবদেহে ঢুকে ধীরে ধীরে সে রোগের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা তৈরি করে নিত।
ঘুড়ি (Kite) (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০)
প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে প্রাচীন চিনে প্রথম ঘুড়ি তৈরি হয়। প্রাথমিক অবস্থায় সেগুলো চৌকোনা আকৃতির হলেও এরপর ধীরে ধীরে কৌশলের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আকারগত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। কাপড় এবং বাঁশের কঞ্চির সাহায্যেই প্রথম ঘুড়ি ওড়ানো হয়। পরবর্তী সময়ে চিনারা ঘুড়ির সঙ্গে বায়ুচালিত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রও বেঁধে ওড়াতে শিখেছিল যা আকাশে উঠে বিভিন্ন সুরেলা সুরে বেজে উঠত।
(ক্রমশ)