গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের আরো লেখাঃ দেড়শো বছর আগের এক সূর্যগ্রহণের গল্প, স্বর্ণযুগের কাহিনি, কৃষ্ণগহ্বর, ব্যতিক্রমী বিন্দু ও স্টিফেন হকিং
তেজষ্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ-নিউক্লিয় বিজ্ঞানে নারী
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
কথারম্ভ
নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলির খুব বিখ্যাত একটা চিঠির সম্বোধন অনুসরণে এই লেখার শিরোনাম। ১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাসে রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে আলোচনার জন্য এক মিটিঙে জার্মানির কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলিত হয়েছিলেন, চিঠিটা পাউলি পাঠিয়েছিলেন তাঁদের উদ্দেশে। চিঠিটা বেশ মজা করেই লেখা, তার মধ্যেই পাউলি বিটা ক্ষয়ের সময় নিউট্রিনো বলে এক নতুন কণা বেরোয় বলে প্রস্তাব করেছিলেন। বিটা ক্ষয় বা নিউট্রিনোর কথায় আমরা পরে আসব। পাউলি চিঠিটা শুরু করেছিলেন “Liebe Radioaktive Damen und Herren” এই জার্মান শব্দগুলো দিয়ে। বাংলায় অনুবাদ করলে হবে, ‘প্রিয় তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ’। মহিলারা কি সত্যি সত্যি উপস্থিত ছিলেন সেই মিটিঙে, নাকি পাউলি অত কিছু না ভেবে সাধারণভাবে সম্বোধনটা লিখেছিলেন? একজন তো ছিলেনই, লিজে মাইটনার; তিনি আমাদের গল্পের এক কেন্দ্রীয় চরিত্র।
ছাব্বিশ বছর পরে নিউট্রিনো মানুষের যন্ত্রে ধরা পড়েছিল। ১৯৬১ সালে নিউট্রিনো আবিষ্কারের ইতিহাস লিখতে বসে পাউলি তাঁর সেই চিঠিটার কপি মাইটনারের কাছেই খুঁজে পেয়েছিলেন। চিঠির সেই কপির সম্বোধন অংশের ছবিটা তোমরা উপরে দেখতে পাচ্ছ।
মিটিংটা ছিল একেবারেই স্থানীয় ব্যাপার, সেখানে একজন মহিলাও না থাকতে পারতেন। কোনো বিজ্ঞান সম্মেলনে মহিলাদের উপস্থিতি সে যুগে মোটেই খুব রুটিনমাফিক ব্যাপার ছিল না, তা ছিল ব্যতিক্রম। সারা পৃথিবীতেই আধুনিক বিজ্ঞানের জগত প্রথম যুগে মহিলাদের জন্য দরজা খুলতে চায়নি। তবু তার মধ্যেও কয়েকটা বিশেষ ক্ষেত্রে অন্তত মহিলার সংখ্যা গত শতাব্দীর প্রথম দিকে অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল, তার মধ্যে পড়বে নিউক্লিয় বিজ্ঞান এবং ক্রিস্টালোগ্রাফি অর্থাৎ কেলাসের গঠন সংক্রান্ত বিজ্ঞান। নিউক্লিয় বিজ্ঞানের নারীদের অবদান নিয়েই আমাদের আলোচনা, তার আগে কেলাসবিদ্যাতে গবেষক মহিলাদের সম্পর্কে দু চার কথা বলে নিই।
প্রথমেই আসে ব্রিটেনের কথা। ক্রিস্টালোগ্রাফির জন্য নোবেলজয়ী পিতাপুত্র উইলিয়াম ব্র্যাগ ও লরেন্স ব্র্যাগ এবং উইলিয়াম ব্র্যাগের ছাত্র বিখ্যাত বিজ্ঞানী জন ডেসমন্ড বার্নাল তাঁদের ল্যাবরেটরিতে মহিলাদের জায়গা দিতে আলাদা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেলাসের গঠন নিয়ে ব্রিটেনে কাজ করেছিলেন রয়্যাল সোসাইটির প্রথম মহিলা ফেলো ক্যাথলিন লন্সডেল, রসায়নে নোবেলজয়ী ডরোথি হজকিন বা ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কারের পিছনে যাঁর বিশেষ ভূমিকা আছে সেই রোসালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নেও অনেক মহিলা বিজ্ঞানী এই বিষয়ে গবেষণা করতেন। ভারতে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন তাঁর ছাত্রী আন্না মানিকে কেলাসের গঠন বিষয়ে গবেষণা করিয়েছিলেন। অবশ্য ছাত্রীদের গবেষণা করানোর ব্যাপারে রমন যে খুব উৎসাহী ছিলেন তা নয়। আন্নার কাহিনি এখানে পড়তে পার।
অচলায়তনকে ভাঙার কাজটা অবশ্য সহজ ছিল না। বার্নাল ডরোথি হজকিনের সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, নোবেল তিনি জিতবেনই। মৃদুভাষী ডরোথি বললেন তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হলেই সন্তুষ্ট হবেন। বার্নালের সংক্ষিপ্ত উত্তর, সেটা বেশি কঠিন। ভুল বার্নাল বলেননি। ১৯৪৫ সালে প্রথম দুই মহিলাকে ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত করা হয়, ততদিনে মেরি কুরি দুবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁর মেয়ে আইরিন জোলিও কুরিও পেয়েছেন রসায়নে। সবাই জানেন যে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের প্রথম যুগ থেকেই একজন মহিলা বিজ্ঞানী অন্তত পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করেছেন। মেরি কুরির দুটি নোবেল পুরস্কারের প্রথমটি পদার্থবিজ্ঞানে, দ্বিতীয়টি রসায়নে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দুটিকেই আমরা নিউক্লিয় বিজ্ঞানের মধ্যে ফেলব, একটি নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান, অন্যটি নিউক্লিয় রসায়ন। সেই মেরি কুরি ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের সদস্যপদের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিক নির্বাচিত হননি তো বটেই, কিন্তু বলার কথা যে তাঁর বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচার চলেছিল, এমনকি তাঁর বাড়ি আক্রান্ত হয়েছিল। অবশ্য এই ধারার ব্যতিক্রমও ছিল, সে বছরের শেষে মাদাম কুরি তাঁর দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। নোবেল কমিটিকে অন্তত তাঁর চরিত্রে কালি মাখানোর চেষ্টা প্রভাবিত করেনি।
কোন বিজ্ঞানীই একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেন না, তাঁর পূর্বসূরীদের কাজের উপর দাঁড়িয়ে তাঁকে এগোতে হয়। তেমনি তাঁর সঙ্গে একই সময়ে একই বিষয়ে গবেষণা করেন আরো অনেকে, পরস্পরের মতের আদানপ্রদানে সমৃদ্ধ হয় প্রত্যেকের কাজ। নিউক্লিয় বিজ্ঞানে গবেষণা করেছেন যে নারী বিজ্ঞানীরা, তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে এই লেখা — কিন্তু তাঁদের গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে গেলে আমাদের যেমন তাঁদের পাশাপাশি পুরুষ বিজ্ঞানীরা কী কাজ করছেন তাও সংক্ষেপে জেনে নিতে হবে, তেমনি তাঁদের কাজের প্রেক্ষাপটটা জানতে হবে।
পূর্বকথাঃ পরমাণু
মেরি কুরি যখন প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন, তখন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের অস্তিত্বই জানা ছিল না। নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের আগেই অবশ্য অনেক গবেষণা হয়েছে, যাকে আমরা পরবর্তীকালে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের অংশ বলে চিহ্নিত করতে পেরেছি। নিউক্লিয় বিজ্ঞানের সূচনা নিশ্চয় ১৮৯০-এর দশকে, কিন্তু তার উৎস খুঁজতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে অনেক শতাব্দী। বস্তু বা পদার্থ সম্পর্কে বহু প্রাচীন এক মৌলিক প্রশ্নের আধুনিক উত্তর খুঁজতে গিয়েই তার উৎপত্তি। প্রাচীন কালের দার্শনিকরা একটা প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করছিলেন। ধরা যাক একটুকরো লোহা, তাকে যদি দু ভাগে ভাগ করি, তাহলে দুটো ছোট টুকরো লোহা পাওয়া যাবে। এদের একটাকে যদি আবার ভাঙি, তাহলে আরো ছোট ছোট লোহার টুকরো পাওয়া যাবে। এভাবে ভাঙতে থাকলে তার শেষ কোথায়?
আজ এই রকম কোনো প্রশ্নের উত্তর আমরা তার পক্ষে বিপক্ষে দার্শনিক যুক্তি বিচার না করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখে নিই। প্রাচীন যুগে পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ ছিল না, বিজ্ঞানের তখন একেবারেই শৈশব অবস্থা। সে যুগে তাই দর্শনের যুক্তির উপর ভিত্তি করে দুটি দল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। একদল দার্শনিক বলতেন কোনো পদার্থকে যত খুশি ছোট করতে পারি। অন্য দল বলেছিলেন তা নয়, বস্তুকে ভাঙতে ভাঙতে আমরা একসময় তার পরমাণু পৌঁছে যাব। সেখানেই ইতি, পরমাণুকে আর ভাঙা যায় না।
আমাদের দেশে কণাদ, গ্রিসে ডেমোক্রিটাস এঁরা এই পরমাণুবাদ প্রচার করেছিলেন। বৌদ্ধ দার্শনিকরাও পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সেটা যে অধিকাংশ লোকের মত ছিল তা নয়। গ্রিসে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল, ভারতবর্ষে শঙ্করাচার্যের মতো বিখ্যাত দার্শনিকরা ছিলেন পরমাণুবাদের তীব্র বিরোধী। এই লেখাতে তার কারণ আলোচনা করার সুযোগ নেই। একটা কথা মনে রেখো, প্রাচীন পণ্ডিতদের পরমাণুবাদ মূলত দর্শন, আজকের মাপকাঠিতে তাকে বিজ্ঞান বলা যায় না। কারণ কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ কণাদ ডেমোক্রিটাসদের তত্ত্বে পাওয়া যাবে না।
অবস্থার পরিবর্তন ঘটে রসায়নবিদদের হাত ধরে। উনিশ শতকের গোড়াতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন ডালটন আবার বললেন পরমাণুর কথা। রাসয়ানিক বিক্রিয়াতে বিভিন্ন পদার্থ সুনির্দিষ্ট অনুপাতে অংশ নেয়, তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন সমস্ত পদার্থ অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবিভাজ্য পরমাণু দিয়ে তৈরি। পদার্থবিদদের অবশ্য পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে সময় লেগেছিল আরো বেশি। উনিশ শতকের শেষের দিকে বিখ্যাত বিজ্ঞান দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী আর্ন্স্ট মাখ। তিনি যে মতের প্রচার করেছিলেন তার নাম যুক্তিমূলক দৃষ্টবাদ (Logical Positivism)। সেই দর্শনে যা অনুভব করা যায় না, সেই পরমাণুর কোনো জায়গা ছিল না। অধিকাংশ পদার্থবিজ্ঞানী তাঁর মতে বিশ্বাস করতেন, এমনকি আইনস্টাইনও বহুদিন পর্যন্ত মাখের কিছুটা অনুসারী ছিলেন। পরিস্থিতি এমনই ছিল যে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জোসেফ জন টমসন যখন রয়্যাল সোসাইটিতে পরমাণু ভেঙে ইলেকট্রন আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেছিলেন, অন্তত একজন বিজ্ঞানী টমসনকে বলেছিলেন যে তিনি নিশ্চয় মজা করছেন। যে পরমাণুর অস্তিত্বই নেই, তাকে আবার টুকরো করা! কেমিস্টরা হাতে কলমে কাজ করছিলেন, তাঁদের অনেকেই দর্শন আলোচনাতে উৎসাহী ছিলেন না।
টমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৯৭ সালে। সেই সময়টা ছিল পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে উথালপাথালের যুগ। তার আগে পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে তাঁদের বিষয়ের মূল কথাগুলো সব জানা হয়ে গেছে। সেই পর্যন্ত আমাদের যা জ্ঞান, তাকে আমরা বলি চিরায়ত পদার্থবিদ্যা। জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ককে তাঁর শিক্ষক ফিলিপ ফন জলি বলেছিলেন, পদার্থবিদ্যা পড়ে কোনো লাভ নেই। আমাদের সৌভাগ্য যে প্ল্যাঙ্ক তাঁর কথা শোনেন নি। ১৯০০ সালে তিনি কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ সংক্রান্ত যে সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন, তার থেকে শুরু হয় বিজ্ঞানে কোয়ান্টাম বিপ্লবের।
১৮৮৭ সালে হাইনরিখ হার্জ আবিষ্কার করেন যে কোনো কোনো ধাতুর উপর অতিবেগুনি আলো পড়লে তার থেকে তড়িৎ নির্গত হয়; পরে বোঝা গেল যা বেরোচ্ছে তা হল ইলেকট্রন। একে বলে ফটোইলেকট্রিক এফেক্ট বা আলোকতড়িৎ বিক্রিয়া। ১৮৯৫ সালে রন্টজেন আবিষ্কার করলেন এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মি। পরের বছর বেকারেল তেজস্ক্রিয়া বা রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি আবিষ্কার করলেন। ১৮৯৭ সালে টমসন ঘোষণা করলেন পরমাণু অবিভাজ্য নয়, তার মধ্যে থাকে ঋণাত্মক কণা ইলেকট্রন।
আলোকতড়িৎ বিক্রিয়া, রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি, পরমাণুর ইলেকট্রন – এ সমস্ত নতুন আবিষ্কারের কোনো ব্যাখ্যা চিরায়ত পদার্থবিদ্যাতে পাওয়া সম্ভব ছিল না। যাঁরা পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন, তাঁদের কাছেও পরমাণু ছিল অবিভাজ্য কণা। রসায়নবিজ্ঞানীরা পরমাণু কত বড় হয় তা মোটামুটি নির্ণয় করে ফেলেছেন। এক মিটারের একশো কোটি ভাগের এক ভাগকে বলে এক ন্যানোমিটার। এক ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের মধ্যে গোটা দশেক পরমাণু পাশাপাশি বসা সম্ভব। এই ছোট্ট পরমাণুর আবার টুকরো! টমসন ইলেকট্রনের কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু পরমাণুর গঠন সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা সঠিক ছিল না। পরমাণুর গঠনটা যে বেশ জটিল, তার ইঙ্গিত প্রথম দেয় তেজস্ক্রিয়তা।
তেজস্ক্রিয়তা থেকে নিউক্লিয়াসঃ প্রথম ধাপ
রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটির কথায় আসি — আবিষ্কারের গল্পটা অনেকেরই জানা। এক্স-রে নিয়ে কাজ করার সময় আঁরি বেকারেল একবার ড্রয়ারের মধ্যে কিছুটা পটাশিয়াম ইউরানিল সালফেট নামের একটা যৌগের কেলাসের সঙ্গে একটা এক্স রে প্লেট রেখে দিয়েছিলেন। পরে প্লেটগুলো পরীক্ষা করে তিনি দেখেন যে পটাশিয়াম ইউরানিল সালফেট থেকে থেকে সারাক্ষণ বিকিরণ নির্গত হয়। নানা পরীক্ষা করে বেকারেল নিশ্চিত হন যে এই বিকিরণের জন্য দায়ী ইউরেনিয়াম। তিনি দেখালেন যে এই বিকিরণ এক্স-রে হওয়া সম্ভব নয়। এক্স-রে তড়িৎ-নিরপেক্ষ। আজ আমরা জানি যে এক্স-রে আসলে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ অর্থাৎ আলোক। কিন্তু তড়িৎক্ষেত্র বা চৌম্বকক্ষেত্রে রাখলে ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত বিকিরণের পথ বেঁকে যায়, অর্থাৎ এই বিকিরণের আধান বা চার্জ আছে। তরঙ্গের আধান থাকতে পারে না, তার মানে বিকিরণ অবশ্যই পদার্থকণা। তিনি অনুমান করেছিলেন যে তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়াম মৌলিক পদার্থেরই ধর্ম, ইউরেনিয়ামের যৌগের নয়। সে সময় এই বিকিরণের নাম ছিল বেকারেল রশ্মি। কিন্তু এই রশ্মির শক্তির উৎস কী, অবিরাম এই বিকিরণ শক্তির নিত্যতা সূত্র মেনে চলে কিনা, এ কি শুধু ইউরেনিয়ামের ধর্ম নাকি অন্য মৌলিক পদার্থেও একে পাওয়া যাবে, বিকিরণটা আসলে কী – এ ধরনের নানা প্রশ্নের উত্তর তখন অজানা। এখানেই বলে রাখি, শক্তি সংক্রান্ত উত্তর পাওয়া যাবে ১৯০৫ সালে যখন আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে দেখাবেন যে ভর ও শক্তির মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। পরমাণুর ভর তেজস্ক্রিয়তাতে শক্তি হিসাবে মুক্ত হচ্ছে। বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর এই লেখায় ধীরে ধীরে আসবে। বেকারেল ১৮৯৭ সালে তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণাতে সাময়িক ছেদ টানেন। তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন কে?
১৮৯৩ সালে পোল্যান্ডের মেয়ে মারিয়া বা মেরি স্ক্লোদোভস্কা ফ্রান্সের সরবোন অর্থাৎ প্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম হয়ে এম এস সি পাস করেছেন। মেরি কুরির জীবনসংগ্রাম আজ প্রায় কিংবদন্তী, তোমরা অনেকেই সে ইতিহাস জানো। সেই কাহিনির কিছুটা এখানে পাবে। ১৮৯৫ সালে তিনি বিয়ে করলেন তাঁর গবেষণার সহযোগী পিয়ের কুরিকে। ঠিক তার পরের বছর বেকারেল তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন।
মেরি কোন বিষয়ে গবেষণা করা যায় তা খুঁজছিলেন। এক্স-রে ও বেকারেল রে, এই দুয়ের মধ্যে সে সময় অধিকাংশ বিজ্ঞানী প্রথমটিকে গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। মেরি ও পিয়ের ঠিক করলেন মেরি দ্বিতীয়টি নিয়ে কাজ করবেন। অন্য সবাই যখন বিকিরণ দেখার জন্য ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করছিলেন, মেরি কাজে লাগালেন পিয়ের ও তাঁর দাদা জ্যাকসের আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রোমিটার যন্ত্র। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ যখন বাতাসের মধ্যে দিয়ে যায়, তখন তা বাতাসকে আয়নিত করে। ইলেক্ট্রোমিটার বাতাসের আয়ননের পরিমাণ বেশি না কম তা খুব ভালোভাবে মাপতে পারে। তার ফলে মেরি তেজস্ক্রিয়তার যে পরিমাপ বার করছিলেন, তা অন্যদের থেকে অনেক ভালো।
রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি শব্দটি মেরিরই তৈরি। ১৮৯৮ সালে মেরি দেখলেন যে শুধু ইউরেনিয়ামই নয়, থোরিয়ামও এক তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ। ইউরেনিয়াম বা থোরিয়াম কঠিন অবস্থায় থাকুক বা অন্য মৌলের সঙ্গে যৌগ রূপে দ্রবণে, ধাতুর বাঁট হিসাবে বা গুঁড়ো অবস্থায়, তাপমাত্রা যেমনই হোক না কেন, তাদের তেজস্ক্রিয়তার কোনো পরিবর্তন হয় না। এভাবেই তিনি প্রমাণ করলেন বেকারেল ঠিকই বলেছেন, তেজস্ক্রিয়তা মৌলিক পদার্থেরই ধর্ম।
মেরি বেকারেলের থেকে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন, বললেন যে তেজস্ক্রিয়তা মৌলের পরমাণুর থেকে আসে। এখন আমরা জানি যে পরমাণুর নিউক্লিয়াস হল তেজস্ক্রিয়তার উৎস, কিন্তু তখনো নিউক্লিয়াস আবিষ্কার হয়নি। কথাটা বলা তখন খুব সহজ ছিল না। মেরি যে শুধু পরমাণুর অস্তিত্বের কথা বলছেন তা নয়, বলছেন তার ভিতর থেকে বিকিরণ বেরোয়। তখন পরমাণুর মডেল বলতে ছিল টমসনের প্লাম-পুডিং মডেল। আমরা জানি যে ইলেকট্রনের চার্জ অর্থাৎ আধান ঋণাত্মক। পরমাণু তড়িৎ-নিরপেক্ষ, তার মানে কিছুটা ধনাত্মক আধানও পরমাণুর মধ্যে থাকতে হবে। টমসনের মডেলে ধরে নেয়া হত যে পরমাণুর ধনাত্মক অংশ কিছুটা পুডিঙের মতো, তার মধ্যে কিসমিসের মতো ইলেকট্রনগুলো ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। এই রকম পরমাণু থেকে এত পরিমাণ শক্তি বেরোবে কেমন করে? টমসনের পরমাণুর মডেল থেকে কিছুতেই তেজস্ক্রিয়তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। মেরিও তেজস্ক্রিয়তার ব্যাখ্যা করতে পারেননি, এর পর দীর্ঘ দিন বিজ্ঞানীরা পরমাণুর গঠন নিয়ে গবেষণা করবেন। কিন্তু মেরি এটা বুঝেছিলেন যে পরমাণুর গঠন টমসনের মডেলের মতো সরল হতে পারে না। নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের এ ছিল প্রথম ধাপ।
দুটি (?) নতুন মৌল
মেরির অগ্রগতিতে উৎসাহী হয়ে কিছুদিন পরেই পিয়ের তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। ইউরেনিয়ামের দুই আকরিক হল পিচব্লেন্ড ও চালকোলাইট, মেরিরা তাদের থেকে ইউরেনিয়াম বার করছিলেন। অবাক হয়ে তাঁরা দেখলেন ইউরেনিয়ামের আকরিকের তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা ইউরেনিয়ামের থেকে বেশী। ধরা যাক পিচব্লেন্ড, তার মধ্যে অনেক মৌল আছে যা তেজস্ক্রিয় নয়। তা সত্ত্বেও আকরিকের তেজস্ক্রিয়তার মাপ ইউরেনিয়ামের থেকে বেশি হওয়ার একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, আকরিকের মধ্যে এক বা একাধিক অজানা মৌলিক পদার্থ আছে যাদের তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক বেশি। মনে রেখো, পিচব্লেন্ডের তেজস্ক্রিয়তা যে ইউরেনিয়ামের থেকে বেশি তা মেরিরা বুঝতে পেরেছিলেন, কারণ তাঁরা ইলেক্ট্রোমিটার ব্যবহার করছিলেন।
মেরিরা ঠিক করলেন যে তাঁরা সেই মৌলিক পদার্থগুলোকে খুঁজে বার করবেন। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। পিচব্লেন্ড হল মূলত ইউরেনিয়ামের অক্সাইড, কিন্তু তার মধ্যে প্রায় তিরিশ রকম মৌলিক পদার্থ থাকে, তাদের একে একে পৃথক করতে হত। কেন ইউরেনিয়ামের আকরিকে এত মৌল থাকে, সে কথাও আমাদের কাহিনিতে আসবে। নতুন মৌলের রাসয়ানিক ধর্ম সম্পর্কে তাঁদের কিছুই জানা ছিল না, তাই তাকে খোঁজার জন্য তাঁদের রাসয়ানিক বিশ্লেষণের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হয়েছিল। মেরি ও পিয়েরের ল্যাবরেটরি একেবারেই উন্নত মানের ছিল না। আর্থিক সমস্যাও ছিল সাংঘাতিক।
গবেষণাগারে পিয়ের ও মেরি কুরি
এত সমস্যার মধ্যেও মেরি ও পিয়ের অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাজ করে চলেছেন। ১৮৯৮ সালের জুলাই মাসে তাঁরা একটা নতুন মৌলিক পদার্থটার চিহ্ন খুঁজে পেলেন। বিসমাথ এমন এক মৌলিক পদার্থ যা পিচব্লেন্ডের মধ্যে পাওয়া যায়। নতুন মৌলটার রাসয়ানিক ধর্ম বিসমাথের খুব কাছাকাছি, তাই পিচব্লেন্ড থেকে বিসমাথ যখন রাসয়ানিক পদ্ধতিতে আলাদা করলেন কুরিরা, তখন নতুন মৌলটাও তার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল।
পরাধীন জন্মভূমি পোল্যান্ডের স্মরণে মেরি তার নাম দিলেন পোলোনিয়াম। সেটা ছিল ১৮৯৮ সাল। কিন্তু পোলোনিয়াম দিয়েও পিচব্লেন্ডের তেজস্ক্রিয়তার পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। মেরিরা বুঝতে পারলেন আরো একটি মৌল পিচব্লেন্ডের মধ্যে আছে, সেটা শেষ পর্যন্ত অন্য এক মৌলিক পদার্থ বেরিয়ামের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল। তাঁরা এর নাম ঠিক করলেন রেডিয়াম। সেটা ছিল ১৮৯৮ সালের ডিসেম্বর মাস। যেখানে একটা মৌল আবিষ্কারই যে কোনো বিজ্ঞানীর কাছে স্বপ্ন, মেরিরা সেই কাজে সফল হয়েছেন দুবার। আসলে তাঁরা সফল হয়েছিলেন আরো একবার, কিন্তু সেই মুহূর্তে তা তাঁরা বুঝতে পারেন নি। সেই কথা আমরা পরে জানব। ইতিমধ্যে তাদের বড় মেয়ে আইরিনের জন্ম হয়েছে ১২ সেপ্টেম্বর, তার দেখাশোনাও মেরিকে করতে হত। আইরিনের কথাও আমাদের গল্পে আসবে।
দীর্ঘ তিন বছর চেষ্টা করে কুরিরা রেডিয়ামকে বেরিয়াম থেকে আলাদা করতে সফল হলেন। এই সময় অন্তত আর্থিক সমস্যার একটা সুরাহা হয়েছিল, এক রসায়ন কোম্পানি তাঁদের কিছু সাহায্য করেছিল। বিনিময়ে তারা রেডিয়ামের কিছুটা নিয়ে বিক্রি করে বেশ লাভ করেছিল। কুরিরা প্রথমে ভেবেছিলেন এক টন পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পাওয়া যাবে দশ কিলোগ্রাম। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল একশো মিলিগ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড। একশো মিলিগ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইডের পরিমাণটা নিচের ছবিতে দেখ, আর চিন্তা করো যে ঐটুকু পেতে কুরিদের এক টন পিচব্লেন্ডের রাসয়ানিক বিশ্লেষণ করতে হয়েছিল। পোলোনিয়ামকে তাঁরা কখনোই বিসমাথ থেকে আলাদা করতে সক্ষম হন নি। তার কারণ তখন বোঝা যায়নি, সে কথায় আমরা পরে আসব। রেডিয়াম ক্লোরাইডের বর্ণালীবিশ্লেষণ থেকে কুরিরা নিশ্চিত হলেন যে তাঁরা রেডিয়ামকে বেরিয়ামের থেকে পৃথক করতে পেরেছেন। একাজে তাঁদের সাহায্য করেছিলেন দুই বিজ্ঞানী গুস্তাভ বেমন্ট ও ইউজিন ডেমার্কে। বর্নালী বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানতে হলে এই লেখার পরিশিষ্ট দেখ। কুরিরা তাঁরা রেডিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব বার করলেন, তা হল ২২৫। সহজ কথায়, তাঁরা দেখলেন একটা রেডিয়াম পরমাণুর ভর একটা হাইড্রোজেনের পরমাণুর ভরের থেকে ২২৫ গুণ বেশি।
কুরিরা এক টন পিচব্লেন্ড থেকে যে পরিমাণ রেডিয়াম ক্লোরাইড পেয়েছিলেন।(ছবিঃ জিম ও রোডা মরিস http://www.scitechantiques.com/Marie_%20Curie/index.htm)
তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য বেকারেল পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯০৩ সালে। তাঁর সঙ্গেই পেয়েছিলেন মেরি ও পিয়ের, তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে তাঁদের গবেষণার জন্য। মেরির নাম প্রথমে তালিকাতে ছিল না, কিন্তু পিয়ের নোবেল কমিটিকে লিখে পাঠালেন যে তাঁদের সমস্ত কাজই যৌথভাবে করা। নোবেল কমিটিও সে কথা মেনে নিয়েছিল। ১৯১১ সালে মেরি রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম আবিষ্কারের জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, এবার একা। পিয়ের ১৯০৬ সালে এক পথ দুর্ঘটনাতে মারা গিয়েছিলেন, নোবেল পুরস্কার মৃত্যুর পরে দেওয়া হয় না।
পিয়ের ও মেরির কথা শুনতে শুনতে ভুলে না যাই যে তাঁরা ছাড়া অন্য বিজ্ঞানীরাও তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। সেই প্রসঙ্গে আরো এক তেজস্ক্রিয় মহিলার কথা আসবে, হ্যারিয়েট ব্রুক্স।
পরিশিষ্ট
বর্নালী বিশ্লেষণ
বেরিয়াম ও রেডিয়ামের বর্ণালী (ছবিঃ জিম ও রোডা মরিস http://www.scitechantiques.com/Marie_%20Curie/index.htm)
আমরা জানি আলোর তরঙ্গ চরিত্র আছে। বর্ণালী বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে আমরা আলোকে তার মধ্যের বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ভেঙে ফেলতে পারি। এই পদ্ধতিটা আবিষ্কার করেছিলেন নিউটন। কোনো পদার্থের ভেপার বা বাষ্পকে উত্তপ্ত করলে তার থেকে আলো বেরোয়, সেই আলোকে বিশ্লেষণ করে পাওয়া বর্ণালীকে বলে নিঃসরণ বর্ণালী। সমস্ত মৌলিক পদার্থের গ্যাস বা বাষ্পেরই নিঃসরণ বর্ণালীর চেহারা আলাদা আলাদা হয়। তাই গ্যাসীয় অবস্থায় যে কোনো মৌলিক পদার্থকে গরম করলে তার থেকে যে আলো বেরোয় তার বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে আমরা মৌলটাকে চিনতে পারব। ছবিতে দেখ বেরিয়াম ও রেডিয়ামের বর্নালীর চেহারা একদম আলাদা। রেডিয়াম ক্লোরাইডের বিশুদ্ধ নমুনাতে বেরিয়ামের বর্নালীর চিহ্ন পাওয়া যাবে না।
আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় বর্ণালীর ব্যাখ্যা খুব সহজ। ধরা যাক বেরিয়াম পরমাণুর কথা। পরমাণুর ভিতর অনেকগুলি শক্তিস্তর আছে, সাধারণ তাপমাত্রায় পরমাণু সবচেয়ে নিচের স্তরে থাকে। বেরিয়ামের বাষ্পকে উত্তপ্ত করলে তার কিছু সংখ্যক পরমাণু উপরের শক্তিস্তরে চলে যায়। সেখান থেকে পরমাণু যখন নিচের শক্তিস্তরে নামে, তখন সে একটা আলোর কণা অর্থাৎ ফোটন বিকিরণ করে। শক্তির সংরক্ষণসূত্র থেকে আমরা সহজেই বুঝি আলোর ফোটনের শক্তিটা হলে ওই দুই শক্তিস্তরের পার্থক্যের সমান। মনে রেখো ফোটনের শক্তির সঙ্গে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সম্পর্ক আছে। এই পরমাণুর শক্তিস্তর কোনো দুটো পরমাণুর ক্ষেত্রে একরকম হয় না, তাই প্রত্যেক মৌলের বর্ণালীর চেহারা আলাদা।
এরপর আগামী সংখ্যায়