গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের আরো লেখাঃ দেড়শো বছর আগের এক সূর্যগ্রহণের গল্প, স্বর্ণযুগের কাহিনি, কৃষ্ণগহ্বর, ব্যতিক্রমী বিন্দু ও স্টিফেন হকিং , তেজষ্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ ১ম পর্ব
(২)
তেজস্ক্রিয়তা ও পদার্থের রূপান্তর: আধুনিক অ্যালকেমি
মেরিরা যখন নতুন মৌলের খোঁজ করছেন, একই সঙ্গে তখন ইউরেনিয়াম বা থোরিয়ামের থেকে বেরোনো বিকিরণের চরিত্র নিয়েও গবেষণা চলছে। ১৮৯৮ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী পল উলরিচ ভিলার্ড দেখালেন যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে যে শুধু তড়িতাহিত কণা বেরোয় তা নয়। বিকিরণের একটা অংশ আছে যা নিউট্রাল অর্থাৎ নিস্তড়িৎ। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড আবিষ্কার করেন তড়িতাহিত বিকিরণকেও দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের বিকিরণ বস্তুর মধ্যে খুব সহজেই আটকে যায়, দ্বিতীয়টার পাল্লা অপেক্ষাকৃত বেশি। রাদারফোর্ড এই দুই রকম বিকিরণের নাম দেন আলফা ও বিটা রশ্মি। বেকারেল অবশ্য দু বছর আগেই দেখেছিলেন বিকিরণের দুরকম ভেদন-শক্তি আছে, কিন্তু বিকিরণকে দুই ভাগে ভাগ করার কথা তিনি ভাবেননি। জার্মানিতে অস্কার গিসেল দেখালেন দ্বিতীয় প্রকার বিকিরণের চার্জ বা আধান ঋণাত্মক। ১৯০০ সালে ভিলার্ড দেখান যে নিস্তড়িৎ বিকিরণের ভেদন-ক্ষমতা বিটা রশ্মির থেকেও বেশি। রাদারফোর্ড এই তৃতীয় ধরনের বিকিরণের নাম দেন গামা রশ্মি। আলফা বিটা ও গামা হল গ্রিক বর্ণমালার প্রথম তিন অক্ষর। রাদারফোর্ড দেখান যে আলফা রশ্মির আধান ধনাত্মক। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। রাদারফোর্ড প্রথমে ইউরেনিয়াম নিয়ে কাজ করছিলেন। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়ার মান দুর্বল, তাই রাদারফোর্ড এক্স রশ্মি ও তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মধ্যে তফাত করতে পারছিলেন না। কুরিদের আবিষ্কৃত নতুন তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো ব্যবহার করেই রাদারফোর্ড আলফা ও বিটা রশ্মির অস্তিত্ব বুঝতে পারেন।
এই রশ্মিগুলো আসলে কী? রাদারফোর্ড, উইলিয়াম র্যামসে ও ফ্রেডরিক সডি নানা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে আলফা রশ্মি হল হিলিয়ামের আয়ন। মেরি বলেছিলেন তেজস্ক্রিয়তা হল পরমাণুর ধর্ম, অর্থাৎ তেজস্ক্রিয় মৌলের পরমাণু থেকে হিলিয়াম পরমাণু বেরিয়ে আসছে। রাদারফোর্ড ও তাঁর সহযোগী সডি বললেন যে তেজস্ক্রিয়াতে এক পরমাণু অন্য পরমাণুতে পাল্টে যাচ্ছে। মধ্যযুগে অ্যালকেমিস্টরা সস্তার ধাতুকে সোনাতে পরিবর্তিত করার স্বপ্ন দেখত। পরে রসায়নবিদরা দেখিয়েছিলেন যে রাসয়ানিক বিক্রিয়াতে মৌলের পরমাণুর কোনো পরিবর্তন হয় না। তাঁর গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ রাদারফোর্ড ১৯০৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সডিও রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯২১ সালে। বিটা রশ্মি কী? বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর চেষ্টাতে বোঝা গেল বিটা রশ্মি হল ইলেকট্রনের স্রোত। গামা রশ্মির চরিত্র বুঝতে আরো অনেক সময় লেগেছিল। অবশেষে ১৯১৪ সালে রাদারফোর্ড এবং এডওয়ার্ড অ্যান্ড্রেড দেখান যে গামা রশ্মি কোনো তল থেকে প্রতিফলিত হয়। প্রতিফলন হল আলোর ধর্ম, তাই বোঝা গেল যে গামা রশ্মি হল একপ্রকার আলো বা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ।
একটা প্রশ্ন হয়তো তোমাদের মনে এসেছে, ইউরেনিয়াম আর রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার এত পার্থক্য কেন? মেরি ও পিয়ের কুরি বিশ্বাস করতেন যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে সব সময় একই পরিমাণে শক্তি নির্গত হয়। রাদারফোর্ড ও সডি দেখালেন যে তেজস্ক্রিয়ার মান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তেজস্ক্রিয়ার মান অর্ধেক হয়ে যায়। যেমন রেডিয়ামের অর্ধায়ুকাল হল ১৬০০ বছর। আজ যদি আমরা একহাজার রেডিয়াম পরমাণু নিয়ে শুরু করি, ষোলশো বছর পরে থাকবে পাঁচশো পরমাণু, তারও ষোলশো বছর পরে আড়াইশো পরমাণু। এভাবেই তেজস্ক্রিয়াতে পরমাণুর সংখ্যা কমতে কমতে যায়। আমরা এখন জানি প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু কাল হল কয়েকশো কোটি বছর, তার মানে ইউরেনিয়ামের পরমাণু ভাঙে অনেক ধীরে ধীরে। সেইজন্যই একই পরিমাণ ইউরেনিয়াম ও রেডিয়ামের মধ্যে রেডিয়াম অনেক বেশি শক্তিশালী। পোলোনিয়ামের অর্ধায়ু কাল মাত্র ১৩৮ দিন, তাই কুরিরা কখনোই পোলোনিয়ামকে বিসমাথ থেকে আলাদা করতে পারেন নি। সেই সময় রাসয়ানিক পৃথকীকরণ প্রক্রিয়াতে এত সময় লাগত যে তার আগেই পোলোনিয়াম পরমাণুর সংখ্যা খুব কমে যেত।
রেডন আবিষ্কার: এক অপরিচিতার কাহিনি। হ্যারিয়েট ব্রুক্স
তেজস্ক্রিয়তার ফলে যে মৌলিক পদার্থের রূপান্তর ঘটে, রাদারফোর্ড ও সডির সেই প্রকল্পের সূচনাতে ছিল রাদারফোর্ড ও তাঁর এক ছাত্রীর পরীক্ষা। হ্যারিয়েট ব্রুক্স-এর নাম আজ বিশেষ কেউ জানে না, তিনি কানাডার প্রথম মহিলা নিউক্লিয় বিজ্ঞানী। শুধু কানাডা নয়, ইউরোপের বাইরে গোটা পৃথিবীতেই এই সম্মান তাঁর প্রাপ্য। হ্যারিয়েট তিন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড, মেরি কুরি এবং জে জে টমসনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।
সংক্ষেপে হ্যারিয়েটের জীবনকথা তোমাদের বলি। তাঁর জন্ম ১৮৭৬ সালের ২ জুলাই কানাডার অন্টারিও প্রদেশের এক্সেটারে। হ্যারিয়েট ছিলেন নয় ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। ১৮৯৪ সালে হ্যারিয়েট মন্ট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। পড়াশোনাতে ভালো ছিলেন বলে বৃত্তি পেয়েছিলেন, না হলে হয়তো তাঁর লেখাপড়াতে ছেদ পড়ত, কারণ তাঁর পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল না। ১৮৯৮ সালে বিজ্ঞান ও অঙ্ক নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক হয়েছিলেন হ্যারিয়েট। গণিতে তাঁর কৃতিত্বের জন্য তিনি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। সে সময় রাদারফোর্ড কেমব্রিজ থেকে ম্যাকগিলে যোগ দিয়েছেন, তিনি সহকারী হিসাবে বেছে নেন হ্যারিয়েটকে। একই সঙ্গে হ্যারিয়েট ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়্যাল ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াতেন। ১৯০১ সালে হ্যারিয়েট তড়িৎ ও চুম্বকক্ষেত্রেও বিষয়ে তাঁর গবেষণার জন্য মাস্টার্স ডিগ্রি পান। তিনি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে প্রথম মহিলা এমএ। রাদারফোর্ডের সঙ্গে তাঁর তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণার কথায় আমরা পরে আসছি। একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, রাদারফোর্ড প্রথমেই ব্রুক্সকে এমএ ডিগ্রির জন্য তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণা করার কথা বলেননি, কারণ তিনি কোনো ছাত্রকে প্রথমেই খুব দুরূহ বিষয়ে ঠেলে দিতেন না। আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য তাকে অপেক্ষাকৃত সহজ বিষয়ে কাজ করতে বলতেন, এবং সেই বিষয়ে তার সাফল্যকে বার বার প্রশংসা করতে ভুলতেন না।
এমএ ডিগ্রির পরে হ্যারিয়েট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার ব্রাইন মার কলেজে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য বৃত্তি পেয়েছিলেন। সেখানে কাজ করতে করতেই কলেজের থেকে ইউরোপে গবেষণার জন্য অন্য একটা বৃত্তি পেলেন। চলে গেলেন কেমব্রিজে জে জে টমসনের ল্যাবরেটরিতে, সেখানে এক বছর কাটালেন। কিন্তু রাদারফোর্ডের মতো সাহায্য তাঁকে সেখানে কেউ করেন নি। ফলে মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙে পড়েছিলেন হ্যারিয়েট, ভেবেছিলেন ডক্টরেট ডিগ্রির তিনি অনুপযুক্ত। রাদারফোর্ডকে এক চিঠিতে তিনি সেই কথাই লিখেছিলেন, “আমার মনে হচ্ছে গবেষণাতে আমি একেবারেই আনাড়ি। এই বিষয়টা এত আকর্ষক, কিন্তু আমি প্রায় এগোতেই পারছি না, ভুলও করছি। আমার মনে হচ্ছে এই বছরটা কেটে গেলে আমাকেও কাজ ছেড়ে দিতে হবে। অনেক লোক আছে যারা কাজটা অনেক ভালোভাবে এবং অনেক তাড়াতাড়ি করতে পারবে। আমার মনে হয় না আমি গবেষণা ছেড়ে দিলে কারোর কিছু আসবে যাবে।” অথচ আমরা দেখব সেই সময়েই তিনি একটা অসাধারণ কাজ করেছিলেন। ব্রুক্স-এর কৃতিত্ব যে শুধু রাদারফোর্ডই স্বীকার করতেন তা নয়, ম্যাকগিলের অপর এক পদার্ত্থবিজ্ঞানী এ এস ইভ ১৯০৬ সালে লিখেছিলেন যে তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণাতে ব্রুক্স সবচেয়ে সফল ও পরিশ্রমীদের মধ্যে পড়বেন। সেই যুগে নারী বিজ্ঞানীদের অনেকের মধ্যেই এই ধরনের চিন্তা আসত।
তাই ১৯০৩ সালে ম্যাকগিলে ফিরে যান ব্রুক্স। সেখানে আবার রাদারফোর্ডের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। একই সঙ্গে রয়্যাল ভিক্টোরিয়া কলেজ পড়ানোও আবার শুরু হল। ১৯০৪ সালে চলে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। সেখানে তিনি হলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের কলেজ বার্নার্ডের টিউটর। ১৯০৬ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পদার্থবিজ্ঞানীর সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা স্থির হয়। বার্নার্ড কলেজের ডিন লরা ড্রেক ড্রিল হ্যারিয়েটকে তাঁকে বলেন বিয়ের পরে কোনো মহিলা কলেজে পড়াতে পারবেন না, গৃহকর্মই তাঁর আসল কর্তব্য। হ্যারিয়েট বিয়ের সম্পর্ক ভেঙে দেন, একই সঙ্গে ক্ষোভে বার্নার্ড কলেজ থেকেও পদত্যাগ করেন। লরা ড্রিলকে তিনি লিখেছিলেন, “আমি দেখাতে চাই যে মহিলাদের পছন্দমতো কাজ করার করার অধিকার আছে, কেবল বিবাহের জন্য তাদেরকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। এটা আমার পেশা ও সমগ্র নারীসমাজের প্রতি আমার দায়িত্ব। যে মহিলা কলেজ নারীদের পেশাতে প্রবেশকে উৎসাহিত করে, সেই কলেজই কেমনভাবে এই বঞ্চনাকে সমর্থন করে, তা আমার বুদ্ধির অতীত।”
আবার ইউরোপ, নিউ ইয়র্ক থেকে ইতালি যাওয়ার পথে তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির সঙ্গী হয়েছিলেন। সেখান থেকে প্যারিস, মাদাম কুরির গবেষণাগার। সেখান থেকে তিনি কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন নি, কিন্তু সহযোগী গবেষকরা তাঁর করা কাজের উল্লেখ করেছেন। ১৯০৭ সালে মাদাম কুরি তাঁকে আরো একবছর কাজ করার কথা বলেছিলেন, কিন্তু ব্রুক্স-এর জীবন অন্য দিকে মোড় নেয়। সেই বছরই রাদারফোর্ড ম্যানচেস্টারে ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান, তিনি দেখানে হ্যারিয়েটের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। হ্যারিয়েট মাদাম কুরির অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে রাদারফোর্ডের সঙ্গে যোগ দেবেন স্থির করেন, কিন্তু তার পরেই তিনি রাদারফোর্ডকে জানান যে তিনি বিয়ে করছেন এবং বিজ্ঞানের জগতে আর থাকতে চান না। ম্যাকগিলে তাঁর শিক্ষক ফ্রাঙ্ক হেনরি পিচার তাঁর পাণিপ্রার্থনা করেছেন, ছ’মাস ধরে ভেবে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন। রাদারফোর্ড এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে তাঁর কাছে ব্রুক্স-এর এই আকস্মিক মত পরিবর্তন ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাত, আজও এর কারণ আমরা নিশ্চিত ভাবে জানি না। নবদম্পতি প্রথমে লন্ডনে থাকতেন, পরে কানাডাতে ফিরে আসেন। সেখানেই ১৭ এপ্রিল ১৯৩৩ হ্যারিয়েটের মৃত্যু হয়। প্রথম যুগে তেজস্ক্রিয়তা যে শরীরের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল না। মেরি বা তাঁর মেয়ে আইরিনের মৃত্যু হয়েছিল রক্তের তেজস্ক্রিয়তাজনিত ক্যান্সারে, অনুমান করা হয় হ্যারিয়েটও হয়েছিলেন একই রোগের শিকার। তাঁর গবেষণার একশো বছর পরে ২০০২ সালে কানাডার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং হল অফ ফেমে তাঁকে স্থান করে দেওয়া হয়েছে।
রাদারফোর্ডের গবেষণার কথা এই লেখাতে বারবার আসছে, কিন্তু তার বাইরে তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা আমাদের আলোচনাতে প্রাসঙ্গিক। আমরা আগে জেনেছি উইলিয়াম ব্র্যাগ, লরেন্স ব্র্যাগ ও জন ডেসমন্ড বার্নাল ব্রিটেনে কেলাস বিজ্ঞানে মহিলাদের জায়গা করে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। রাদারফোর্ডও নিউক্লিয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একই রকম চেষ্টা করেছিলেন। কানাডাতে গিয়ে প্রথমেই তিনি এক ছাত্রীকে সহকারী বেছে নিয়েছিলেন। সঙ্গের ছবিতে দেখ, রাদারফোর্ডের সহযোগীদের মধ্যে দুজন ছাত্রী মার্গারেট হোয়াইট ও মে লেসলিকে দেখা যাচ্ছে। রাদারফোর্ডের বেশ কয়েকজন ছাত্রীর কথা আমাদের লেখাতে আসবে। ১৯২০ সালে রাদারফোর্ড কেমব্রিজে গবেষণা করতেন, সেই সময় লন্ডনের টাইমস সংবাদপত্রে এক চিঠিতে তিনি ও রসায়নের অধ্যাপক উইলিয়াম পোপ উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণাতে মহিলাদের অংশগ্রহণের সমর্থনে জোর সওয়াল করেছিলেন। নিউজিল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজের বিখ্যাত ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে পড়তে এসেছিলেন রাদারফোর্ড, সেই বছরই ক্যাভেন্ডিস প্রথম কেমব্রিজের বাইরের ছাত্রদের জন্য দরজা খোলে। ব্রিটেনের উপনিবেশ থেকে আসার জন্য তিনি প্রথমদিকে অবজ্ঞা ও উপহাসের পাত্র হয়েছিলেন – হয়তো সেই কারণেই শুধু মহিলা নয়, রাদারফোর্ড যে সব বিজ্ঞানী আধুনিক সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাঁদের জন্যও চিন্তা করতেন। ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার তিনি ছিলেন অন্যতম সমর্থক। তাঁর কাছে গবেষণা করেছেন তিন ভারতীয় ছাত্র — নাজির আহমেদ, দৌলত সিং কোঠারি এবং রফি মহম্মদ চৌধুরি। ইউরোপ আমেরিকার বাইরে বিজ্ঞানে প্রথম নোবেলজয়ীর নাম চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন, সেই রমনের নোবেল পুরস্কারের জন্য যাঁরা সুপারিশ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রাদারফোর্ড অন্যতম।
রাদারফোর্ড ম্যাকগিলের তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি ও রবার্ট আওয়েন্স দেখলেন যে থোরিয়াম থেকে কিছু একটা নিঃসরণ হচ্ছে, যা তেজস্ক্রিয়তাতে যে আলফা বা বিটা কণা বেরোয়, তার থেকে আলাদা। সেটা গ্যাসের মতো, বায়ুর প্রবাহ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁরা তার নামও দিয়েছিলেন থোরন। কুরিরা এই নিঃসরণের কথা আগেই বলেছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন যে রেডিয়াম তার কাছাকাছি বায়ুকে তেজস্ক্রিয় করে দেয়, কিন্তু তা নিয়ে তাঁরা আর এগোননি। আমরা দেখেছি যে আলফা কণা হল হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস যার ভরসংখ্যা হল চার। বিটা কণা হল ইলেকট্রন, তার ভরসংখ্যা শূন্য। ভরসংখ্যা হল মৌলের নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা, এ সম্পর্কে আরো জানতে গেলে এই লেখার পরিশিষ্ট দেখ। মনে করা হচ্ছিল এই থোরন হয়তো থোরিয়ামেরই গ্যাসীয় রূপ। রাদারফোর্ড ও হ্যারিয়েট ব্রুক্স দেখালেন যে এই নতুন নিঃসরণ হল একটা তেজস্ক্রিয় গ্যাস যার ভরসংখ্যা থোরিয়ামের থেকে অনেক কম। সেই প্রথম কোনো তেজস্ক্রিয় গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেল। রাদারফোর্ড ও ব্রুক্স রেডিয়াম থেকেও এই গ্যাস নির্গত হওয়ার চিহ্ন খুঁজে পান। কয়েক বছর পরে ১৯০২ সালে ব্রুক্স এর অর্ধায়ুকালও মাপেন, যার থেকে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া যায় এটি একটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল। এই কাজটা তিনি করেছেন কেমব্রিজে বসে রাদারফোর্ডের সাহায্য ছাড়াই, অথচ আগেই বলেছি যে সেই সময়েই তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, ভাবছিলেন তিনি গবেষণার উপযুক্ত নন। রেডিয়াম থেকে নির্গত এই নতুন গ্যাসের নাম দেওয়া হল রেডন (Rn)। পরবর্তীকালে দেখা গেছে এর পারমাণবিক সংখ্যা হল ৮৬। কানাডাতে ফিরে পরবর্তী গবেষণাতে ইউরেনিয়াম বা থোরিয়াম থেকে নির্গত বিকিরণের হ্রাস বৃদ্ধি থেকে ব্রুক্স দেখিয়েছিলেন যে তার একটা নির্দিষ্ট ক্রম আছে, অর্থাৎ কোনটা আগে বেরোবে আরে কোনটা পরে, তা নির্দিষ্ট। এর থেকেই রাদারফোর্ড এবং সডি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে তেজস্ক্রিয়াতে এক মৌল অন্য মৌলে পরিবর্তিত হচ্ছে। ধরা যাক ইউরেনিয়াম থেকে একটা বিকিরণ বেরিয়ে নতুন একটি মৌল তৈরি হল, তখন তার থেকে যে বিকিরণ বেরোবে তা ইউরেনিয়াম নয়, নতুন মৌলটির ধর্ম। বুঝতেই পারছ রাদারফোর্ড ও সডির যুগান্তকারী গবেষণার পিছনে আছে ব্রুক্স-এর অবদান। রাদারফোর্ড সে কথা একাধিকবার লিখেছেন।
আবার কুরি দম্পতি
রেডন আবিষ্কারের ইতিহাস কিন্তু সোজা পথে এগোয়নি। রাদারফোর্ডই প্রথম রেডনকে নতুন মৌল বলেছিলে, আজকাল অনেক জায়গায় তাঁকে রেডনের আবিষ্কর্তার সম্মান দেওয়া হয়। রাদারফোর্ড কিন্তু কুরিদের রেডন আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, তার কারণ তাঁরাই প্রথম রেডিয়াম থেকে এই নিঃসরণ দেখেছিলেন। অপরদিকে মাদাম কুরি রাদারফোর্ডের মতের বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন এ রেডিয়ামেরই গ্যাসীয় রূপ। রাদারফোর্ড ও সডি নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখান যে রেডন সত্যিই গ্যাস, তার রাসয়ানিক ধর্ম হিলিয়াম নিয়ন ইত্যাদি অন্যান্য নিষ্ক্রিয় গ্যাসের অনুরূপ। মাদাম কুরি তখন তা মেনে নেন। আমরা এখন জানি ব্রুক্স রেডনের ভরসংখ্যা ঠিকঠাক মাপতে পারেন নি। তার ভরসংখ্যা আসলে থোরিয়ামের থেকে সামান্যই কম। তাই যে পরীক্ষা থেকে রেডনকে মৌল বলে অনুমান করা গিয়েছিল, তা ছিল ভুল। অবশ্য দু’বছরের মধ্যেই রেডনের অর্ধায়ুকালও ব্রুক্স মেপেছিলেন, তার থেকে বোঝা গিয়েছিল যে সেটি থোরিয়াম থেকে আলাদা এবং খুব সম্ভব একটি নতুন মৌল। সম্ভবত বলছি, কারণ একই মৌলের বিভিন্ন আইসটোপের বিভিন্ন অর্ধায়ুকাল হয়। (আইসোটোপ কাকে বলে তা পরিশিষ্টে দেওয়া আছে।) যেমন ইউরেনিয়াম-২৩৮ আইসটোপের অর্ধায়ুকাল সাড়ে চারশো কোটি বছর, আবার ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপের অর্ধায়ুকাল হল সত্তর কোটি বছর। তাই অর্ধায়ুকাল আলাদা হলেই যে সেটা নতুন মৌল কিনা তা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু তখন আইসোটোপ সম্পর্কে কেউ কিছু জানতেন না। রেডনের অর্ধায়ুকাল হল পঞ্চান্ন সেকেন্ড, ব্রুক্স-এর মাপা মান ছিল এক মিনিট, অর্থাৎ বর্তমান মাপের খুবই কাছাকাছি। রাদারফোর্ড নিজে সবসময়েই রেডন বিষয়ে গবেষণা প্রসঙ্গে ব্রুক্স-এর কথা বলেছেন। রাদারফোর্ড ও ব্রুক্স প্রথমে রেডন বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র ছাপান। পরে রাদারফোর্ড একাই এই বিষয়ে নেচার পত্রিকাতে একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন, তার ভিতরেও তিনি ব্রুক্স-এর অবদানের কথা লিখেছিলেন। কিন্তু সে কথা বিশেষ প্রচার পায়নি, ফলে হ্যারিয়েট ব্রুক্স অপরিচিতই রয়ে গিয়েছেন। রেডনের আবিষ্কারে পিয়ের ও মেরি কুরি, রাদারফোর্ড, আওয়েন্স, ব্রুক্স এবং সডি – সকলেরই অবদান আছে।
অবদান যাঁর বিশেষ নেই তাঁর নামই কিন্তু রসায়নের প্রামাণিক বইতে সাধারণত রেডনের আবিষ্কর্তা হিসাবে থাকে — তিনি জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিয়েডরিশ আর্ন্স্ট ডর্ন। ডর্ন শুধুমাত্র রাদারফোর্ডরা থোরিয়ামে যে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন, তা রেডিয়ামের উপরে করেছিলেন। কুরিরা রেডিয়ামে এই ধরনের কাজ আগেই করেছিলেন। ডর্ন কোনো নতুন মৌলের কথা বলেনও নি। তাঁর গবেষণাপত্রটি একটি অপেক্ষাকৃত অপরিচিত গবেষণাপত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল, ফলে সেটি বিশেষ কেউ পড়ার সুযোগ পান নি। পরের এক সুপরিচিত প্রবন্ধে নতুন মৌলের প্রস্তাবকের কথা লিখতে গিয়ে ভুলক্রমে রাদারফোর্ড আওয়েন্স ও ব্রুক্স-এর পরিবর্তে ডর্নের গবেষণাপত্রটিকে উল্লেখ করা হয়েছিল। ডর্নের মূল লেখাটি না পাওয়ায় পরবর্তীকালে প্রায় সবাই ওই প্রবন্ধটি অনুসরণ করে ডর্নকেই রেডন আবিষ্কারের সম্মান দিয়েছেন। হিসাব করে দেখা গেছে ইন্টারনেটে নব্বই শতাংশ জায়গায় ডর্নকেই রেডনের আবিষ্কর্তা বলা হয়েছে।
হ্যারিয়েট ব্রুক্স-এর পরবর্তী গবেষণা: প্রতিক্ষেপ ক্রিয়া
১০৯০৪ সালেই হ্যারিয়েট অপর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন, কিন্তু তার স্বীকৃতি থেকেও তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। ধরা যাক কোনো বস্তু নিলাম যার উপরিতলে একটা তেজস্ক্রিয় পদার্থ আছে। হ্যারিয়েট দেখালেন যদি অন্য একটি বস্তুকে প্রথমটার খুব কাছাকাছি কিছুক্ষণ রাখা যায়, দেখা যায় কিছুটা তেজস্ক্রিয়তা দ্বিতীয় বস্তুটির উপরের তলে চলে যাচ্ছে। কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ সে কথায় পরে আসছি, কিন্তু আধুনিক কালে আমরা সহজেই এভাবে তেজস্ক্রিয়া স্থানান্তরের কারণ বুঝে নিতে পারি। কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে যখন তীব্র বেগে আলফা কণা বেরিয়ে আসে, তখন বলবিদ্যাতে নিউটনের বিখ্যাত তৃতীয় সূত্র মেনে অবশিষ্ট নতুন নিউক্লিয়াসটি উলটো দিকে যায়। খুব কাছে যদি অন্য কোনো বস্তু আসে, তখন এই নতুন নিউক্লিয়াস সেই বস্তুর উপরে গিয়ে পড়তে পারে। এই নতুন নিউক্লিয়াসটিও সাধারণত তেজস্ক্রিয়, তাই দ্বিতীয় বস্তুটিতে তেজস্ক্রিয়তা খুঁজে পাওয়া যায়। এটাকে বলা হয় প্রতিক্ষেপ ক্রিয়া (recoil effect)। আবারও মনে রাখতে হবে যে নিউক্লিয়াস তখনো আবিষ্কার হয়নি।
প্রতিক্ষেপ ক্রিয়ার সাহায্যে নতুন নিউক্লিয়াস বা পরমাণুটাকে অন্য পরমাণুদের থেকে আলাদা করে নেওয়া যায়। কুরিরা, রাদারফোর্ড বা অন্য সবাই এতদিন নতুন পরমাণুটাকে আলাদা করার জন্য রাসয়ানিক উপায় ব্যবহার করছিলেন। এ হল সম্পূর্ণ নতুন এক পদ্ধতি। বেশ কয়েক বছর পরে ১৯০৯ সালে জার্মানিতে অটো হান দাবি করেন যে তিনিই প্রতিক্ষেপ ক্রিয়া আবিষ্কার করেন। হান ও লিজে মাইটনার এই পদ্ধতি ব্যবহার করে নতুন এক মৌল আবিষ্কার করবেন, সেই গল্পে আমরা পরে আসব। রাদারফোর্ড হানকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন যে তিনি যেন হ্যারিয়েট ব্রুক্স-এর কৃতিত্বকে স্বীকার করে নেন, কিন্তু হান সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। আমাদের কাহিনিতে হানের একই ধরনের আচরণের কথা আবার আসবে। তবে হানের সমর্থনে একটা কথা বলতেই হয়, তিনিই প্রথম প্রতিক্ষেপ ক্রিয়ার সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। হ্যারিয়েট অবশ্য তখন আর গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নেই।
হ্যারিয়েটের কৃতিত্ব যে সমকালে বিশেষ স্বীকৃতি পায়নি, তার পিছনে একাধিক কারণ বর্তমান। মহিলাদের সাফল্যকে মেনে নিতে সমাজ ও বিজ্ঞানীমহলে যে কুণ্ঠা ছিল, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অটো হান চিরকালই অন্য কারো সঙ্গে কৃতিত্ব ভাগ করে নিতে চাননি। রাদারফোর্ডের মতো দিকপাল বিজ্ঞানীর সঙ্গে কাজ করার ফলে হ্যারিয়েটের নাম ঢাকা পড়ে গেছে। রেডন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ঘটনাচক্রে অন্য একজনের নাম উঠে এসেছে। রেডন বিষয়ে রাদারফোর্ড ও ব্রুক্স-এর কাজ বেরিয়েছিল ট্রানস্যাকশনস অফ দি রয়্যাল সোসাইটি অফ কানাডা পত্রিকাতে। আগেই বলেছি যে পরে রাদারফোর্ড বিখ্যাত নেচার পত্রিকাতে এককভাবে এই বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সুপরিচিত পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল বলে প্রবন্ধটি অনেক বেশি বিজ্ঞানীর চোখে পড়েছিল। কিন্তু লেখার ভিতরে রাদারফোর্ড ব্রুক্স-এর ভূমিকার কথা যে স্বীকার করেছিলেন, তা তাঁদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। সর্বোপরি নিউক্লিয় বিজ্ঞান যখন শুরু হচ্ছে, তখন বিজ্ঞানের জগৎ থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনের জন্য তাঁর নাম পাদপ্রদীপের আড়ালে চলে গিয়েছিল।
কানাডাতে রাদারফোর্ড ও ব্রুক্স-এর সঙ্গেই নাম আসে অপর এক বিজ্ঞানীর, ফ্যানি কুক গেটস( ২৬ এপ্রিল ১৮৭২- ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১)। ১৮৯৫ সালে গেটস হ্যারিয়েট ব্রুক্স-এর মতোই ব্রায়ান মার কলেজ থেকে বৃত্তি নিয়ে ইউরোপে পড়তে গিয়েছিলেন। তিনি ১৯০২ থেকে ১৯০৩ সালে ম্যাকগিলে রাদারফোর্ড ও ব্রুক্স-এর সঙ্গে গবেষণা করেছিলেন। এক গবেষণাতে তাঁরা তিনজন দেখেছিলেন যে তেজস্ক্রিয়তার উপরে তাপমাত্রার কোনো প্রভাব নেই। গেটস ১৯০৫ সালে কেমব্রিজে জে জে টমসনের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন।
পরমাণু থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় বিকিরণের এই বিপুল পরিমাণ শক্তির উৎস কী? অণু পরমাণু থেকে যে আলো বেরোয় তার শক্তির তুলনায় এই শক্তি কয়েক লক্ষ গুণ বেশি। মেরি ও পিয়ের কুরি ভেবেছিলেন তেজস্ক্রিয় পরমাণুরা পরিবেশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে পারে। রাদারফোর্ড মনে করতেন পরমাণুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে শক্তির ভাণ্ডার। উত্তর যে এই দ্বিতীয় পথেই আসবে তা বোঝা গেল ১৯০৫ সালে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে সেই বছরটা এক দিকচিহ্নের কাজ করে। সুইজারল্যান্ডের বার্নের পেটেন্ট অফিসের জনৈক কেরানি, তাঁর নাম আলবার্ট আইনস্টাইন, কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশের মাধ্যমে বিজ্ঞানের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দেন, তাদের মধ্যে দুটি ছিল বিশেষ আপেক্ষিকতা সম্পর্কিত। সে বিষয়ে আলোচনার সুযোগ এই লেখাতে নেই, ইচ্ছা করলে এখানে পড়ে দেখতে পারো। সেই গবেষণার একটা বিশেষ সূত্রের কথা তোমরা সবাই জানো। আইনস্টাইন দেখালেন যে ভর ও শক্তি অভেদ, তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সেই বিখ্যাত E=mc2 সূত্রের কথা তোমরা সবাই শুনেছ। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন তেজস্ক্রিয় বিকিরণে কিছুটা ভর শক্তি হিসাবে মুক্ত হচ্ছে। পরমাণুর গঠন সম্পর্কে না জানলে এর বেশি এগোনো সম্ভব নয়। নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের কৃতিত্ব রাদারফোর্ডের। সেই কথার আলোচনা দিয়ে পরের পর্ব শুরু হবে।
পরিশিষ্ট
ভরসংখ্যা ও আইসোটোপ
আজ আমরা জানি ভরসংখ্যা হল কোনো পরমাণুতে প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা। যেমন হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস হল একটা প্রোটন, তাই তার ভরসংখ্যা এক। প্রথম যুগে অবশ্য প্রোটন, নিউট্রন, নিউক্লিয়াস — কারোর সম্পর্কেই জানা ছিল না। কোনো পরমাণু হাইড্রোজেনের পরমাণুর থেকে যত ভারি, সেই সংখ্যাটাকে ভরসংখ্যা ধরা হত। পারমাণবিক গুরুত্বের সঙ্গে ভরসংখ্যার তফাত কী? কোনো নির্দিষ্ট মৌলের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা নির্দিষ্ট, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা আলাদা আলাদা হতে পারে। তাদের বলে মৌলের আইসোটোপ। যেমন ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসে আছে ৯২টা প্রোটন। ইউরেনিয়াম-২৩৮ আইসোটোপের নিউক্লিয়াসে আছে ১৪৬টা নিউট্রন আর ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপের নিউক্লিয়াসে আছে ১৪৩টা নিউট্রন। মৌলিক পদার্থের রাসয়ানিক ধর্ম প্রোটনের সংখ্যার উপর নির্ভর করে, তাই একই মৌলের সমস্ত আইসোটোপের রাসয়ানিক ধর্মে কোনো তফাত নেই।
পারমাণবিক গুরুত্ব হল প্রকৃতিতে মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপের ভরসংখ্যার গড়। যেমন প্রকৃতিতে ক্লোরিনের দুটি আইসোটোপ আছে। দুটিতেই প্রোটনের সংখ্যা ১৭, নিউট্রনের সংখ্যা একটিতে আঠারো, অন্যটিতে কুড়ি। যে আইসোটোপের ভর সংখ্যা ৩৫, প্রকৃতিতে তার পরিমাণ হল ৭৫ শতাংশ, ভরসংখ্যা ২০ আইসোটোপ আছে পঁচিশ শতাংশ। তাহলে পারমাণবিক গুরুত্ব হল
(৩৫ ×৭৫ + ৩৭ ×২৫)/১০০=৩৫.৫।
সে সময় অবশ্য আইসোটোপের কথাও কেউ জানত না। এই সমস্ত বিষয় আমাদের আলোচনাতে আসবে।
এরপর আগামী সংখ্যায়