প্রতিবেশী গাছ সব পর্ব একত্রে
আমাদের প্রতিবেশি গাছ – বাঁশ
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই
মাগো, আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই?
এই গান শুনে শিশুকাল কেটেছে। এখনও যখনই এই গান শুনি সঙ্গে সঙ্গে বাঁশবাগানের ছবি যেন চোখে ভাসে। বাঁশবাগানে অন্ধকার একটু বেশিই হয়। সেই ঘন অন্ধকারের উপরে উজ্জ্বল চাঁদ চোখের সামনে দেখতে পাই। গ্রামে যারা যান নি তাঁরা এই পরিবেশের কথা ভাবতে পারবেন না।
বাঁশ এমন একটি গাছ যার ব্যবহার বলে শেষ করা যায় না। জীবনের সব ক্ষেত্রেই বাঁশের ব্যবহার রয়েছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম –
A man is born in a bamboo cradle and goes away in a bamboo coffin. Everything in between is possible.
বাঁশ গাছ একে বারে গোল, মসৃণ, ফাঁপা। এমন গাছ আর একটিও নেই। গাছের কাণ্ডের বেড় সাধারণত ৩ থেকে ৬ ইঞ্চি। এর চেয়ে সরু বা মোটা বেড়ের গাছ রয়েছে। পর্ব মধ্য অঞ্চলটি সামান্য মোটা। কাণ্ড থেকে কোন ডালপালা বের হয় না। পাতা গাঢ় সবুজ বর্ণের। ফুলের গোছা দেখা যায়।
বাঁশ গাছ এক সঙ্গে অনেকগুলি গোছা হিসাবে থাকে, এদের বাঁশ ঝাড় বলে। এই গাছ নিঃস্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। এদেশে (বাংলায়) প্রায় সব গ্রামেই বাঁশ গাছ দেখা যায়।
খাদ্য হিসাবে বাঁশ
এদেশে খাদ্য হিসাবে বাঁশ গাছের ব্যবহার বিশেষ দেখা যায় না। তবে চিন, জাপান, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডে বাঁশ গাছের নরম কাণ্ড খাদ্য হিসাবে বহুল প্রচলিত। সেখানের বাজারে নানা ধরণের বাঁশ-খাদ্য পাওয়া যায়, যেমন টিন জাত, টাটকা, শুকনো বা বরফ ঠাণ্ডা। বাঁশ সবজি, ভাজা বা আচার হিসাবে ব্যবহার হয়।
বাঁশ গাছের অন্যান্য ব্যবহার
অন্তত পাঁচ হাজার ধরণের বাঁশের ব্যবহারের কথা জানা যায়। তবে হাজার দেড়েক ব্যবহারের কথা বইয়ে লিপিবদ্ধ করা আছে। এক একটি দেশে এক এক সম্প্রদায়ের মানুষেরা বাঁশ গাছকে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে। এখানে এই সব ব্যবহারের অতি সামান্য কয়েকটির উল্লেখ করা হল।
- কাঠ হিসাবে ব্যবহার – খুঁটি, পোল, বিম, ম্যাট বোর্ড, প্লাই, ইত্যাদি।
- অরণ্য হিসাবে – বাঁশ গাছ মাটিকে ধরে রাখে তাই বর্ষার সময় মাটি আলগা হয়ে ধুয়ে যায় না। বাঁশ গাছ শব্দ নিরোধক। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাঁশ গাছ লাগানো হচ্ছে।
- টেক্সটাইল শিল্পে – বুলেট-প্রুফ পোশাক, মোজা, কম্বল, ম্যাট্রেস, শিশুদের ডায়াপার, পোশাক, তোয়ালে, বালিশ, ইত্যাদি প্রস্তুত করতে বাঁশের ব্যবহার হচ্ছে।
- খাদ্য এবং পানীয় – খাদ্যে বাঁশের ব্যবহারের কথা ইতিমধ্যে বলা হয়েছে। এখানে আরও কয়েক ধরণের ব্যবহারের উল্লেখ করা হল যেমন, ব্যাম্বু ভিনিগার, ব্যাম্বু ওয়াইন, ব্যাম্বু বিয়ার, ব্যাম্বু টি।
- পাল্প এবং কাগজ শিল্পে – কাগজ প্রস্তুতিতে বাঁশের ব্যবহার বিষয়টি অনেক দিন ধরেই জানা। তবে এখন নানা ধরণের কাগজ প্রস্তুতিতে এর ব্যবহার হচ্ছে যেমন, নিউজ প্রিন্ট, টয়লেট পেপার, বণ্ড পেপার, কার্ড বোর্ড, কফি ফিল্মটার, ইত্যাদি।
- ইলেক্ট্রনিক শিল্পে – মাউস, কি বোর্ড, আই ফোন, আই প্যাড, হেড ফোন, স্পিকার, ল্যাপটপ, ইত্যাদি তৈরিতে বাঁশের ব্যবহার হচ্ছে।
- চাষ আবাদ – মৌ চাক নির্ম্মাণে, বেড়া তৈরিতে, ওয়াটার হুইল, গ্রিন হাউস, ঝুড়ি, লাথি, খুঁটি, পাইপ, মাছ ধরার খাঁচা, ইত্যাদিতে।
- অটোমোবাইল শিল্পে – স্টিয়ারিং হুইল নির্ম্মাণে, ড্যাশবোর্ড এবং মোটরের অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরিতে।
- বাদ্যযন্ত্র হিসাবে – সারা বিশ্বে অজস্র বাদ্যযন্ত্রে বাঁশের ব্যবহার রয়েছে।
- এছাড়া – বাইসাইকেলের অংশ, স্কেট বোর্ড, পোলো বল, বেসবল ব্যাট, অজস্র ধরণের আসবাব, বাড়ী, সেতু, খেলনা, দরজা-জানালার ফ্রেম, বাথটাব, ধূপ কাঠি, দেশলাই, ইত্যাদি। ওষধি হিসাবে – বাঁশ গাছের বিভিন্ন অংশ নানা ধরণের রোগে ব্যবহৃত হয়। বাঁশ পাতায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। পেটের গণ্ডগোলে বাঁশ পাতা ব্যবহার করা হয়।
যে বাঁশ গাছের এতো গুণ কীর্তন করা হল এর বৈজ্ঞানিক নাম Bambusa arundinaceae । এই গাছটি গ্রামিনি বা পোয়েসি পরিবারভুক্ত।