প্রতিবেশী গাছ সব পর্ব একত্রে
গুলঞ্চ
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে বের হয়ে কয়েক পা এগোলেই গ্রামের সদর রাস্তা। এই রাস্তাটি গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গেছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় এলেই রাস্তার দুধারে রয়েছে একটি ফুলের গাছ – আমরা বলি গুলঞ্চ গাছ। সাদা সাদা ফুলে গাছটি ভরে রয়েছে।
সেই শিশু কাল থেকেই এই গাছ দুটিকে দেখে আসছি। বাঁ দিকের গাছের বিশেষ অবস্থানের জন্য এটি মনে পড়ে বেশী করে। রাস্তার বাঁ দিকে ছিল একটি লম্বা মাটির ঘর। এই ঘরটির দরজার ঠিক সামনেই গাছটির অবস্থান। শিশু কালে এই গাছটির মোটা বাঁকানো গুঁড়িতে হেলান দিয়ে কত সময় দাঁড়িয়েছি। সে সব কথা আজ খুব মনে পড়ে। টুপ টুপ করে সুগন্ধযুক্ত ফুলগুলি মাটিতে পড়লে সেগুলি কুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসতাম।
এই মাটির বাড়িতে চার পাশের গ্রাম থেকে ছাত্রেরা পড়তে আসত। পড়াতেন এক বয়স্ক মাস্টারমশায়। উনি আমার মামার বাড়ির সম্পর্কে আত্মীয়। আমার শিশুকালেই ওঁকে দেখেছি বয়স্ক। টকটকে গায়ের রং, মৃদু স্বরে কথা বলতেন। বড়ই অমায়িক মানুষ। সকাল বেলায় দেখতাম ওঁদের বাড়ির দরজায় গরীব মানুষেরা অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতে ওষুধের জন্য। স্নান পূজা পাঠ করে এসে জিজ্ঞাসা করতেন কার কি অসুবিধা বা অসুখ হয়েছে। সেই মত সকলকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিতেন, বিনি পয়সায়। এই সব মানুষদের আজ আর দেখতে পাই না।
গুলঞ্চ গাছ সাধারণভাবে ১৫ – ২০ ফুটের মত লম্বা হয়। গাছের গুঁড়ি অমসৃণ, ঈষৎ বাঁকানো। এই গাছটির আদি বাসস্থান মেক্সিকো বলেই পণ্ডিতরা জানিয়েছেন। ওদেশ থেকে গাছটি আজ পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে এই গাছটি লাগানো হয় সৌন্দর্যবর্ধক গাছ হিসাবে। এই গাছের ফুলটি দেখতে সত্যি সুন্দর। ফুলে পাঁচটি পাপড়ি থাকে। পাপড়ির রং সাদা, ভেলভেটের মত। ফুলের মাঝের অংশের রং হলুদ। সাদা রং ছাড়া অন্য রং-এর ফুল ফোটে এমন গাছও দেখতে পাওয়া যায়। ফুলগুলি সুগন্ধযুক্ত।
গাছের পাতা লম্বা, চকচকে, গাঢ় সবুজ বর্ণের। পাতার বোঁটা লম্বা, বেশ হৃষ্টপুষ্ট। পাতার ফলকগুলি বেশ লম্বা ৮ – ১০ ইঞ্চি বা তার বেশী। গাছের কাণ্ডের ছাল সবুজ আভাযুক্ত ছাই রঙের। গাছের রস সাদা, ঘন এবং আঠালো। এদের তরুক্ষীর বা ল্যাটেক্স বলে।
এই গাছের নানা ভেষজ গুণের কথা গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন। সাধারণ মানুষ ঔষধি হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। ঔষধি গুণের কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলঃ
- নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা মশার কামড়জনিত ক্ষত বা ফুলে যাওয়া স্থানে এই গাছের রস (ল্যাটেক্স) লাগান।
- কর্নাটকের সিমোগ জেলার সাগর তালুকের লোকেরা গুলঞ্চ গাছের কাণ্ডের ছাল বেঁটে সে পেস্ট লাগান কাটা, ছেঁড়া বা আঘাত প্রাপ্ত ত্বকে।
- কান এবং দাঁতের ব্যাথায় এই গাছের ফুল এবং রস ব্যবহার করা হয় মেক্সিকো দেশে।
- মধ্য আন্দামানের কারেন্স উপজাতির মানুষেরা এই গাছের ছাল জিবে ঘষে জিব পরিষ্কার করেন।
- গাছের ছাল, পাতা বা ফুলের ব্যবহার রয়েছে পেটের গণ্ডগোল, পাতলা পায়খানা (ডায়েরিয়া, ডিসেন্ট্রি, ইত্যাদি) জাতীয় সমস্যার ক্ষেত্রে।
বিজ্ঞানীরা এই গাছের নাম রেখেছেন Plumeria rubra। এই গাছটি ‘এপোসায়ানেসি’ পরিবারভুক্ত। এই পরিবারভুক্ত অনেক গাছেদের দেহে তরুক্ষীর পাওয়া যায়। অনেক গাছ আবার বিষাক্ত।