প্রতিবেশী গাছ সব পর্ব একত্রে
বাওবাবের গল্প
পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়
ঈশ্বর পৃথিবীতে তখন প্রাণী তৈরি করেছেন, আর প্রতিটি প্রাণীর সঙ্গে একটা করে গাছও পাঠাবেন ঠিক করলেন। সবাই লাইন দিয়ে গাছ নিয়ে চলে গেল। লাইনের সকলের শেষে ছিল এক হায়না। তার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। এদিকে গাছও সব শেষ। শুধু পড়ে আছে যেটা, সেটা দেখে হায়নার একটুও পছন্দ হল না। কিন্তু কীই বা করে! রাগে দুঃখে গাছটা নিয়ে পৃথিবীতে এসে সে দিল উলটো করে পুঁতে। ব্যস, তেমনি হল বাওবাবের চেহারা। সুদূর আফ্রিকার সাভানার বুকে যখন মাথায় ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকে তখন দেখলে মনে হয় যেন একটা শিকড়সমেত গাছকে কেউ উলটো করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তাই বাওবাবের অন্য নাম ‘আপ-সাইড ডাউন ট্রি’।
বাওবাব আফ্রিকার ট্রি অফ লাইফ। বাংলায় বলে কল্পবৃক্ষ। জড়িয়ে ধরে যা চাইবে তাই পাবে। আসলে একথার মানে অন্য। নামটা হয়েছে এই কারণে যে এই গাছের সব অংশই উপকারী। জড়িয়ে যে ধরবে তার মোটেই উপায় নেই, ২৬ থেকে ৩৬ ফুট এই গাছকে হাতে বেড় দিতে মহাভারতের শালপ্রাংশু বীরদের ডেকে আনতে হবে। আর লম্বা জানো? ১৬ থেকে ৯৮ ফুট লম্বা হয় বাওবাব। প্রবাদ বলে, উইজডম ইজ লাইক আ বাওবাব ট্রি, নো ওয়ান ক্যান এমব্রেস ইট। আর এই চওড়া গুঁড়িতে সে ভরে রাখতে পারে ১ লক্ষ লিটার পর্যন্ত জল। কারণ, সাভানা যে মরুপ্রায় অঞ্চল। শুধু ঘাস। প্রয়োজনে গাছের ছাল, পাতা খেয়েই পশুরা জলের চাহিদা মেটাতে পারে।
কতকিছুর আশ্রয়দাতা এই বাওবাব! নানারকমের পাখি বাসা বাঁধে এর ডালে, বিশেষত মটল্ড স্পাইন টেল আর চাররকমের উইভার। মস্ত চওড়া গুঁড়িতে অনেকসময় থাকে মস্ত কোটর যাতে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন মানুষ ঢুকে পড়তে পারে। বাওবাব সম্বন্ধে এমন অনেক মিথ তৈরি হয়ে গেছে যার কারণ বাওবাবের বিশালত্ব। সত্যিই নামিবিয়ায় এরকম এক বাওবাবের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল।
বড়ো বড়ো সাদা পাপড়িওয়ালা ফুল হয় এর। আর এই ফুলে আসে ফ্রুট-ব্যাট। রাত্তিরবেলা পরাগযোগ ঘটায়। আর ফুল থেকে যখন ফল হয়, তখন সে এক মজার দৃশ্য। যেন রাশি রাশি মরা ইঁদুর ঝুলছে গাছে। ফলের আকারটি ওরকম। ডেড র্যাট ট্রিও বাওবাবের অন্য নাম।
বাওবাবের ফল পৃথিবীর একমাত্র ফল যা গাছেই শুকিয়ে যাওয়ার পর পেড়ে আনা হয়। সেই শুকনো ফলের বাইরের খোলসটা ভেলভেটের মতো, আর ওজন প্রায় দেড় কিলো। ভেতরের শাঁস গুঁড়ো করে বানানো হয় লজেন্স, জ্যাম বা সস। টক স্বাদের এই চূর্ণ তরকারির গ্রেভি বানাতে, ফলের জুসে মানুষ খুব পছন্দ করে। ‘জিলাদো ডি মাক্কা’ নামে এক আইসক্রিম বানানো হয় সাউথ আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলায়।
আরেকটা মজার ব্যাপার হল, শিশু বাওবাবের চেহারার সঙ্গে একটি পূর্ণবয়স্ক বাওবাবের কোনও মিল নেই। তাই কালাহারি বুশ-ম্যানদের মধ্যে একটা প্রবাদ আছে এই যে, বাওবাব জন্মায় না, মাটি ফুঁড়ে ওঠে অমন মস্ত আকারে। আর এই গাছের শেষদিনটাও আসে অদ্ভুতভাবে। ভেতরে ভেতরে সে কখন নিঃশেষ হয়ে আসে কেউ জানতে পারে না। হঠাৎ একদিন সবাই দেখে জায়গাটা ফাঁকা, বদলে পড়ে আছে কিছু ফাইবারের (জীর্ণ ডাল-পাতা) স্তূপ।
অলঙ্করণঃ লেখক