প্রতিবেশী গাছ সব পর্ব একত্রে
গীগার ট্রি
পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়
ফ্লোরিডার ‘কী ওয়েস্ট’ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একদম শেষ বিন্দু। বহুকাল আগে, যখন নৌ বাণিজ্যের স্বর্ণযুগ, সেসময় বহু নৌযানের যাতায়াত ছিল এই পথে। এই প্রণালীর জলতলে রয়েছে কোরাল বা প্রবালের সাম্রাজ্য। এই কারণে, ছোট বড় নৌবহরের তলা প্রায়ই ফেঁসে যেত। সেইসঙ্গে ছিল ‘হারিকেন’ নামক প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ের দাপট। জাহাজগুলো নব্বই কিলোমিটার দূরের হাভানা বন্দরে যাওয়ার পথে দিক হারাত। সপ্তাহে অন্তত একটা না একটা এমন ঘটনা ঘটবেই।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ এই ‘কী ওয়েস্ট’ হয়ে উঠেছিল ‘wrecking capital’। আটকে যাওয়া যাত্রী, পণ্য ইত্যাদি উদ্ধার করার জন্যে থাকতেন দুর্ধর্ষ সব নাবিক, ‘শিপ রেকার’। প্রচুর টাকাপয়সা, ধনদৌলতের গল্প থাকতো এর মাঝে। এমন কি ভাগাভাগির ফয়সালা করার জন্য আইন আদালতে কেসগুলো উঠত।
সেরকম একজন নাবিক ও রেকার ছিলেন ‘ক্যাপ্টেন গীগার’, যাঁর নামে এবারের গাছের গল্প। এই ‘কী ওয়েস্ট’-এ এক বিলাসবহুল বাগানবাড়ির মালিক ছিলেন ক্যাপ্টেন গীগার। সে বাড়ি আজও আছে যদিও তার নাম বদলে হয়েছে “Audubon House”। আর আছে আমেরিকান পাখিবিশারদ James Audubon এর আঁকা বিখ্যাত সেই ছবি। সে কথায় পরে আসছি।
আগে গাছের কথা বলি। এর ডাক নাম গীগার ট্রি, ভালো(বিজ্ঞানসম্মত) নাম Cordia sebestana.খসখসে বালির কাগজের মত সবুজ পাতা আর গাছভরা কমলা ফুলের বাহার। এই কমলা ফুলের ভালো নাম বাংলায় ‘রক্তরাগ’, হিন্দিতে ‘লাল-লসৌড়া’, ‘কমলা-বুহাল’, বুহারি, ভোকার, এইসব। জানুয়ারির পর থেকে ফুটতে শুরু করে, প্রায় বছরভোর থাকে, শীতের দিকে কমে যায়।
এর যে ফল হয় তাকে কাঁচা বা আচার বানিয়ে খাওয়া হয়, বা সবজি হিসেবে রান্নাও হয়। এই গাছের আসল দেশ পেরু। খুব বড় নয়, মাঝারি উচ্চতার চিরসবুজ গাছ। তাই বাগানের জন্যে খুব আদরের। হামিং বার্ডেদের খুব পছন্দের গাছ। ওরা এর ফুলের মধু খেতে আসে।
জার্মান বোটানিস্ট, ফার্মাসিস্ট, ফিজিসিস্ট ছিলেন ‘Euricious Cordus’, কৃষক পিতার তেরোতম সন্তান। সবচেয়ে ছোটো বলে cordus বা late one। তাঁর নামে এ গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম। তাহলে গীগার ট্রি নাম হল কী করে, সেটা এক জম্পেশ গল্প।
১৮২০ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ এই ভাঙাচোরা জাহাজ আর ধনরত্ন উদ্ধার করে ক্যাপ্টেন আইনি বে-আইনি নানান উপায়ে প্রচুর ধনদৌলত করেছেন। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৬ সালের মধ্যে সাতান্নটা কোর্ট কেস শুধু এঁর নামেই উঠেছিল। কী ওয়েস্টে খুব সুন্দর তাঁর বাগানওয়ালা বাড়ি বানিয়েছেন, বিবাহ করেছেন এবং সেই সূত্রে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে অনেকরকম গাছ এনে বাগানে লাগিয়েছেন। তারই একটি হল এই গীগার ট্রি।
এদিকে ক্যাপ্টেনের প্রতিবেশী ডাক্তার Stroeble এর বাড়িতে এসে উঠলেন ‘Birds of America’ খ্যাত Audubon সাহেব। লোকে অবশ্য বদনামও রটায়। বলে পাখির ছবি আঁকার জন্যে তিনি নাকি পাখি মেরেছেনও প্রচুর। সেসময় সম্ভবত কোনো ভাগ্যবিড়ম্বনায় তাঁর ব্যাবসা বন্ধ হওয়ায় তিনি নানা জায়গা ঘুরতেন পরিবারের সকলকে নিয়ে। আর পাখির নেশা ছিল। মাংসের লোভে পাখি শিকার করতে গিয়ে হয়ে উঠলেন পক্ষীবিদ। অনেকটা আমাদের দেশের বার্ডম্যান সালিম আলির গল্পের মতই।
এই Audubon একদিন দেখতে পেলেন উল্টোদিকের বাগানে এক অপূর্ব ফুলগাছ। স্থানীয় চেনা ফুল নয়। মুগ্ধ পাখিবিশারদ ভাবলেন গাছটিকে অমর করে রাখবেন। তাই তার ডালে বসা দুই ‘হোয়াইট ক্রাউনড পিজিয়ন’ এঁকে ফেললেন তিনি। বাগানটি ছিল ক্যাপ্টেন গীগার এর। এই বাগানে তিনি বহু পাখি দেখেন ও লিপিবদ্ধ করেন। এই ছবিটা আঁকার পর তিনি যেহেতু গাছটির নাম জানেন না, তাই নাম দেন গীগার ট্রি।
ক্যপ্টেন গীগারের শেষ বংশধর ছিলেন William Bradford.তিনিও নাবিক। কিন্ত বড্ড ঘরকুনো। । বাড়ি ছেড়ে বেরোতেনই না। খাবারটাও ব্যাগে করে তুলে নিতেন। তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ি বিক্রি হয়। পরবর্তীকালে এই বাড়ি কেনেন Mitchell Wolpon এর ফ্যামিলি। সংরক্ষণ করেন আর Audubon এর স্মৃতিতে মিউজিয়াম বানান। কিন্ত, লোকে বলে ক্যাপ্টেনের আত্মা আজও দেখা যায় দোতলার বারান্দায়, ঝুঁকে দেখছেন কী ওয়েস্টে আবার কোনো জাহাজডুবির খবর এলো কি না, কিম্বা লুকোনো ধনরত্ন আগলানোর জন্যে।
কলকাতায় আলিপুর হর্টিকালচারের বাগানে, সল্টলেক স্টেডিয়ামের আশেপাশে এই গাছ দেখতে পাবে।
ছবি: লেখক
কত অজানা তথ্য! এই নামটাও জানতাম না। হয়ত’ ফুলের বাহার দেখেছি কখনো কোথাও!
আঁকা ছবিটা নিশ্চিত ভালো তবে গাছ আর তার ডাল পাতা ফুল এর কিছু ফোটোগ্রাফ থাকলে ভাল হোত!
LikeLike