প্রতিবেশী গাছ সব পর্ব একত্রে
মামার বাড়ি কে না যেতে চায়। তখন স্কুলে পড়ি, বছরে অন্তত দুবার মামার বাড়ি যাওয়া ছিল বাঁধা। কালীপুজোর সময় একবার আর শীতকালে ধান ওঠার সময় আর একবার। তবে শীতকালে ওখানে থাকার মেয়াদ ছিল বেশি দিনের। কখনও কখনও এক মাস। জানুয়ারি মাসে নতুন ক্লাসের পড়া সবে শুরু হত। তাই পড়ার চাপ কমই থাকত। সকাল বিকেল দুবেলা ক্যাম্বিসের বলে ক্রিকেট খেলা, ভুরভুরে গন্ধযুক্ত খেজুরের গুড়, দুপুরে পুকুরে চান। তা আবার পুকুরে নামলে জল ছেড়ে ওঠার নাম নেই। আর কী চাই।
মামা বাড়ির পাশেই খামার। আর খামারের পাশে আগাছার জঙ্গল। বহু আগে সেখানে কিছু ফলের গাছ লাগানো হয়েছিল, সেগুলির দু চারটি আজও টিকে রয়েছে। তবে জায়গায়টা আগাছায় ভরে গেছে। বেড়ে উঠেছে অনেকগুলি লতানে গাছ। লতানে গাছগুলির মধ্যে একটি গাছ চোখে পড়ত বেশি। ছোট পটলের মাপের সবুজ ফলগুলির মধ্যে দু একটি টকটকে লাল ফল অসাধারণ দেখতে লাগত। বড়দের জিজ্ঞেস করে নাম জেনেছিলাম, তেলাকুচি। তবে তাঁরা সাবধান করে দিয়েছিলেন এই গাছটি সম্বন্ধে। জানিয়েছিলেন, এটি বিষাক্ত গাছ। গোরুতেও খায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং ওদিকে আর নয়। দূর থেকেই টকটকে লাল ফলের দিকে সম্ভ্রম নিয়ে তাকিয়ে থেকেছি। অনেক পরে ভেষজ নিয়ে যখন আলোচনা হয়েছে, তেলাকুচার প্রসঙ্গ উঠেছ। এর ঔষধিগুনের কথা জানতে পেরেছি। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য মশায়ের চিরঞ্জীব বনৌষধি উলটে পালটে দেখেছি। তখন এই আগাছা সম্বন্ধে ধারণা অনেকটাই পালটেছে। ভেবেছি, এতোদিন যে গাছটাকে অবজ্ঞা করেছি তার এতো গুণ!!
শিবকালীবাবু এই গাছের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এই ভাবে, “অযত্নসম্ভূত লতাগাছ, বাগানের বেড়ায় অথবা কোন গাছকে আশ্রয় করে জন্মে থাকে – বাংলা কেন, ভারতের প্রায় সবত্রই হয়। পাতার আকার পাঁচকোণা, ব্যাস ৪/৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে দেখা যায় এবং তার কিনারা (ধার) করাতের ছোট দাঁতের মত কাটা; পাতার বোঁটা আন্দাজ এক ইঞ্চি, প্রায় বারোমাসই এই লতাগাছে ফুল হয়, তবে শীতকালে বিশেষ হতে দেখা যায় না, আর সব ফুলেই ফল হয় না। এই সব ফুলের বোঁটা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা, আর যে সব ফুলে ফল হয় তার বোঁটা আধ ইঞ্চির মত লম্বা হয়। ফলগুলি লম্বায় ১১/২ /২ ইঞ্চির বেশি হতে দেখা যায় না। ফলগুলি আমড়া ঝাঁটি পটোলের মত দেখতে হলেও আকারটা যেন পটোলের মত। কিন্তু ফলের উপরটা মসৃণ (তেলা), কাঁচায় সবুজ রং, গায়ে সাদা ডোরা দাগ, পাকলে লাল হয়। কাঁচা বা পাকা, কোন অবস্থাতেই খাওয়া যায় না, কারণ ফলের শাঁস তিতো (তিক্ত), এবং বমির উদ্রেক হয়।”
আয়ুর্বেদাচার্য এই গাছটির লোকায়তিক ব্যবহারের কথা বিশদভাবে জানিয়েছেন। ব্যবহার হয় বহু রোগে, যেমন
১) সর্দিতে
২) অধোগত রক্তপিত্তে
৩) আমাশয়ে
৪) পাণ্ডুরোগে
৫) শ্লেষ্মা জনিত রোগে
৬) হাঁপানি জাতীয় কষ্টে
৭) জ্বরভাবে
8) বমনের প্রয়োজনে
৯) অরুচিতে
১০) ডায়াবেটিসে, এবং
১১) স্তন্যহীনতায়
এই গাছটিকে ওড়িয়ারা বলেন বনকুঁদরি, সংস্কৃতে বিম্বিকা এবং ইংরেজিতে Ivy Gourd. শিবকালী ভট্টাচার্য মশাই এই গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম লিখেছেন Coccinia cordifolia. বিজ্ঞানীরা এখন এর নামকরণ করেছেন Coccinia grandis.
তেলাকুচা গাছের পাতার রস ডায়াবেটিস রোগের প্রতিষেধক, এমনটাই দাবি করেছেন অনেক বিজ্ঞানী। জার্মানির তিনজন বিজ্ঞানী এই গাছটির জিনোম পরীক্ষা করে যে তথ্য পেয়েছেন তা বেশ চিত্তাকর্ষক। তাঁরা জানিয়েছেন এই গাছটি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছে প্রায় ৩০ লক্ষ বছর আগে অর্থাৎ আধুনিক মানব আসার (দেড় থেকে দু লক্ষ বছর) অনেক আগে। আরও জানা গেছে, পুরুষ এবং স্ত্রী গাছের জিনোমের আয়তনের (ডি এন এ-র পরিমান) প্রভেদ এতোটাই যা কয়েকটি গাছের জিনোমের সমান (Genlisea margaretae)।