ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রফেসর স্টিফেন হকিং যে এক অসাধারণ বিজ্ঞানী ছিলেন তাই নয়, তিনি একদিকে যেমন সুলেখক ছিলেন, তেমনি অন্যদিকে ছিলেন অসামান্য বাগ্মী। সরস রসিকতা ছিল তাঁর সহজাত। শারীরিক অসুবিধা তাঁর রসিকতার ভাণ্ডারকে এতটুকু মলিন করতে পারেনি। তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর বক্তৃতা শুনতে মানুষের ঢল নামত। নিজের রসিকতা নিয়ে হকিং বিবিসিতে দেওয়া তাঁর এক সাক্ষাতকারে বলেন, “আমার রসবোধ আমাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। একুশ বছর বয়সে আমার অসুখ আমার প্রত্যাশাকে শূন্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আমার স্নায়ুর অসুখের জন্য আমি যেমন দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়েছি, তেমনই জীবনের অন্যদিকগুলিতে ভাগ্য আমার সহায় হয়েছে। আমি ভাগ্যবান, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করার সুবর্ণ যে সুযোগ আমি পেয়েছি, তাতে আমার পঙ্গুত্ব খুব বেশি বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। আমি মনে করি জীবন যতই কঠিন হোক না কেন, রেগে যাওয়া কখনোই উচিত নয়। কারণ, জীবন ও নিজের উপর রসিকতা করতে না পারলে বেঁচে থাকার সব আশাই ব্যর্থ।”
ডক্টর স্টিফেন হকিং-এর চেয়ারটি সাধারণ চেয়ারের থেকে আলাদা ছিল। মাত্র একুশ বছর বয়সে শরীর পঙ্গুদশা প্রাপ্ত হলেও তাঁর আঙুলের পেশী কম্পিউটার মাউসের বোতাম টিপতে সক্ষম ছিল। ডাক্তার ও কলাকুশলীরা তাঁর জন্য বিশেষ হুইলচেয়ার বানিয়ে ফেলেন। হুইলচেয়ারের হাতলের সাথে ট্যাবলেট কম্পিউটার লাগিয়ে দেওয়া হয়। কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে শব্দ চয়ন করে স্ক্রিনে বাক্য রচনা করবার জন্য সফটওয়ার ‘ইকুয়ালাইজার’ এর মাধ্যমে ডক্টর হকিং তাঁর বক্তৃতা তৈরি করে ফেলতেন। শব্দ থেকে বাক্য তৈরি করার পর স্পিচ সিন্থেসাইজার (স্পিচ+) ব্যবহার করে স্পিকারের মাধ্যমে তাঁর বক্তৃতা শোনা যেত।
২০১৬ সালে প্রফেসর হকিং বিবিসি রেইথ লেকচার (বিবিসি -৪ থেকে প্রচারিত হওয়া অনুষ্ঠান। ১৯৪৮ সালে এই অনুষ্ঠানে প্রথম বক্তৃতা দেন প্রখ্যাত দার্শনিক ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, বার্ট্রান্ড রাসেল। সমসাময়িক বিষয়ের উপর বক্তৃতার জন্য বিশ্বখ্যাত মানুষদের আমন্ত্রণ জানানোর উদ্দেশ্য হল মানুষের ভিতরে কৌতূহল জাগিয়ে তুলে স্বাস্থ্যকর আলোচনা ও বিতর্কের সূত্রপাত ঘটানো। বিবিসির ব্রডকাস্টিং এক্সিকিউটিভ জন চার্লস ওইয়ালসাম রেইথের নামে প্রচারিত এই বক্তৃতা আজও জনপ্রিয়) দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন। এখানে তিনি দুটি বক্তৃতা করেন, যার বিষয় ছিল – কৃষ্ণগহ্বর, ‘ব্ল্যাক হোল’ নামে যা খ্যাত। এই দুটি বক্তৃতার সার তাঁর বাগ্মিতার ধরণটিকে যথাসাধ্য বজায় রেখে ভাবানুবাদ করা হল। প্রথম বক্তৃতার শিরোনাম ছিল, “ডু ব্ল্যাক হোল্স হ্যাভ নো হেয়ার?”
শিরোনামটিকে বাংলা করলে হয়, “সত্যিই কী কৃষ্ণগহ্বরের চুল নেই?” এখানে কিন্তু ‘চুল’ আসলে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৬০ সালে বিজ্ঞানী হুইলার “নো হেয়ার” উপপাদ্য প্রস্তাব করেন, যা বলে, ব্ল্যাক হোল তত্ত্বে আইনস্টাইন ও ম্যাক্স ওয়েলের সমীকরণ শুধু কৃষ্ণগহ্বরের তিনটি ধর্ম – ভর, কৌণিক ভরবেগ ও তড়িৎ ইঙ্গিত করে। তাই কৃষ্ণগহ্বর থেকে বিকিরণের কোনও সম্ভাবনাই নেই। ১৯৭০ সালে ডক্টর স্টিফেন হকিং এই ধারণাকে নস্যাৎ করে বলেন, কৃষ্ণগহ্বর থেকে বিকিরণ সম্ভব। এই বিকিরণের নাম দেওয়া হয় “হকিং রেডিয়েশন”।
***
ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে বলতে গিয়ে গোড়াতেই বলি, কখনো কখনো সত্য ঘটনা উপন্যাসের কাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়। আর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীর থেকেও রোমাঞ্চকর হল কৃষ্ণগহ্বরের কাহিনী। বিজ্ঞানের জগত অনেক দেরিতে বুঝতে পারল, একটা বিরাট তারা কীভাবে তার নিজের অভিকর্ষজ টানে নিজের উপরই ভেঙে পড়তে পারে আর কী-ই বা হতে পারে তার থেকে ছিটকে পড়া বস্তুগুলোর অবস্থা। এমনকি ১৯৩৯ সালে আইনস্টাইন এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে জানিয়ে দিলেন, অভিকর্ষজ টানে কোনও তারাই ভেঙে পড়তে পারে না, কারণ একটি বিশেষ সীমার পর বস্তুকে নাকি আর চাপ দিয়ে সংকুচিত করা যাবে না।
সবাই তাঁর সাথে গলা মেলালেও জন হুইলার বেঁকে বসলেন। তিনি যেন কৃষ্ণগহ্বরের কাহিনির নায়ক ছিলেন। ১৯৫০-৬০ সাল থেকেই তিনি জোরের সাথে বলে চলেছিলেন, “তারাদের অনেকেই একসময়ে ঠিক ভেঙে পড়বে।”
হুইলারের এই ধারণা তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় সমস্যা সৃষ্টি করল। আগ বাড়িয়ে কৃষ্ণগহ্বরের রীতি প্রকৃতি নিয়ে বেশ কিছু ভবিষৎবাণীও করে ফেললেন তিনি। তাঁর ধারণা অনুযায়ী, জীবনকালের একটা বড় সময়ে এইসব তারারা কয়েকশ কোটি বছর ধরে নিজেদের অভিকর্ষজ টানের বিরুদ্ধে তাপচাপ (থার্মাল প্রেশার) সৃষ্টি করে স্থিতাবস্থায় নিজেদের টিঁকিয়ে রাখতে পারবে। এই কাজে ওদের সাহায্য করবে পারমাণবিক বিক্রিয়া। বিক্রিয়ার ফলে হাইড্রোজেন থেকে সৃষ্টি হবে হিলিয়াম। অবশেষে একদিন সব পারমাণবিক জ্বলানি ফুরিয়ে গেলে তারাটি সংকুচিত হবে। কিছু তারা অবশ্য শ্বেত বামন হয়ে নিজেকে ভেঙে পড়ার থেকে বাঁচাতে পারবে।
১৯৩০ সালে সুব্রাহ্মনিয়াণ চন্দ্রশেখর দেখিয়েছিলেন একটা শ্বেত বামন তারার সর্বাপেক্ষা ভর হতে পারে সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ। একই গণনা করেছিলেন সোভিয়েত পদার্থবিদ লেভ ল্যান্ডাও। তার গণনার সেই তারাটি ছিল একটি নিউট্রন দিয়ে তৈরি তারা।
শ্বেত বামন তারার চাইতে বেশি ভরের কোনও তারা যখন তার সমস্ত পারমাণবিক জ্বালানি হারিয়ে ফেলবে তখন কী হবে? বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার ১৯৩৯ সালে দেখিয়েছিলেন এই রকম তারাটি চাপ ধরে রাখতে না পেরে সংকুচিত হতে হতে একটা অসীম ভরের বিন্দুতে পরিণত হবে। এই বিন্দুটিকেই বলা হয় – সিঙ্গুলারিটি।
এইসব কথা যখন জানা গেল, ঠিক সেই সময়ে বিশ্বযুদ্ধ বাগড়া বাধাল। রবার্ট ওপেনহাইমার সহ তাবড় তাবড় পদার্থবিদ পারমাণবিক গবেষণার দিকে ঝুঁকলেন, আর অভিকর্ষজ ভাঙন মুলতুবি রয়ে গেল। যখন কোয়াসার (কৃষ্ণগহ্বরের চারিদিকে ঘুরতে থাকা বস্তু বলয়কে বলা হয় কোয়াসার) আবিষ্কার হল, তখন আবার সবাই তারাদের খোঁজ খবর নিতে উদ্দীপিত হয়ে উঠল। প্রথম কোয়াসার (৩সি২৭৩) আবিষ্কার হল ১৯৬৩ তে। দেখা গেল, পৃথিবী থেকে অনেক দূরের এই অতিকায় বস্তুটির চেহারা বেশ ঝকঝকে। এরপর আরও অনেক কোয়াসার আবিষ্কৃত হল। মুশকিল হল, কোয়াসার থেকে নির্গত মোট শক্তির পরিমাপ করা গেল না, কারণ তাদের স্থির ভরের নিহিত শক্তির অতি সামান্য অংশই নির্গত হয়ে থাকে। কিন্তু অভিকর্ষজ টানে ভেঙে পড়লে যে শক্তি নির্গত হয় তাই দিয়ে কোয়াসার থেকে নির্গত শক্তির ব্যাখ্যা করা হল। একটি তারা ভেঙে পড়লে যে অসীম ঘনত্বের সিঙ্গুলারিটি সৃষ্ট হয়, সেখানে কিন্তু আইনস্টাইনের সমীকরণ খাটবে না। তার অর্থ হল, এই বিন্দুতে ভবিষ্যৎ অনুমান করাও যাবে না।
জন হুইলার ১৯৬৭ সালে ভেঙে পড়া তারার নামকরণ করলেন ‘ব্ল্যাক হোল’। এর আগে তার নাম ছিল ফ্রজেন স্টার। নবলব্ধ নামের এই বস্তুটিকে ঘিরে এক অন্ধকার রহস্যের সৃষ্টি করল। বাইরে থেকে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই, এর ভিতরে কী আছে। টেলিভিশন সেট, হিরের আংটি থেকে শুরু করে তোমার সবচাইতে বড় শত্রুটিকেও এর ভিতরে ফেলে দিতে পার। কৃষ্ণগহ্বর বস্তুর প্রকার ভুলে শুধু তার মোট ভর ও ঘূর্ণনের তথ্যটিকেই ধরে রাখতে পারবে।
কৃষ্ণগহ্বরের একটা সীমানা আছে, যাকে বলা হয় বা ঘটনা দিগন্ত (ইভেন্ট হরাইজন)। এই জায়গায় অভিকর্ষজ টান এতই প্রবল, যে আলোকে গিলে ফেলতে পারে। গিলে ফেলা আলো ফেরত পাবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। যদি সূর্যের চাইতে কয়েক গুণ বড় কোনও কৃষ্ণগহ্বরে নিচের দিশায় পা রেখে পড়ে যাও, তাহলে টানের প্রকোপে তোমার শরীর ছিঁড়ে যাবে, কারণ পায়ের দিকে টান মাথার দিকের টানের চাইতে অনেক বেশি হবে। আর যদি সূর্যের চাইতে কয়েক লক্ষ গুণ বড় কোনও কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে যাও, তাহলে ঘটনা দিগন্ত অনায়াসে পার করে যেতে পারবে। তাহলে বুঝতে পারছ, যদি কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাপারে বেশি অনুসন্ধিৎসু হও, তবে বড়সড় একটা গহ্বর খুঁজে নিও।
কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে যে ব্যক্তি পড়ে যাবে, সে নিজে কিছু টের না পেলেও, বাইরে থেকে যে তার পড়ে যাওয়া দেখবে, সে কিন্তু লোকটাকে ঘটনা দিগন্ত পার হয়ে যেতে দেখবে না। সে শুধু দেখতে পাবে গর্তে পড়ে যাওয়া লোকটার প্রতিচ্ছবি ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে গেল। বাইরের দুনিয়ায় দুর্ভাগা লোকটা নিখোঁজ হয়ে যাবে চিরতরে।
অদ্ভুত এই ঘটনার গাণিতিক ব্যাখ্যা দেওয়া হল ১৯৭০ সালে। জানা গেল যখন গহ্বরটি বস্তু বা শক্তি গিলে ফেলে, তখন তার ঘটনা দিগন্ত আকারে বেড়ে যায়। আকারের বৃদ্ধির সাথে নিউটনের গতিবিদ্যার মিল দেখা গেল। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র বলে এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলা সময়ের সাথে বেড়ে যায়। ঘটনা দিগন্তের বিস্তার আর এন্ট্রপির সাথে যোগসূত্রের প্রথম হদিস পাওয়া গেল। এনট্রপি ও ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফলের মধ্যে সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া গেলেও জানা গেল না, কৃষ্ণগহ্বরের এন্ট্রপি। ১৯৭২ সালে জেকব বেকেন্সটাইন বললেন অভিকর্ষজ টানে তারা ভেঙে পড়ে যে কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হয়, তার তিনটি বিশেষ ধর্ম – ভর, কৌণিক ভরবেগ ও তড়িৎ তার প্রকৃতি নির্ধারণ করে। এই সূত্রানুযায়ী অভিকর্ষজ পতনের ফলে তথ্যের একটা বড় অংশ হারিয়ে যায়। এর অর্থ হচ্ছে পতনের ফলে যে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়, পতনের আগে তার পদার্থের ধর্ম সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে একই ভর, কৌণিক ভরবেগ ও তড়িৎযুক্ত কৃষ্ণগহ্বরের আদি পদার্থ ভিন্ন হতে কোনও বাধা নেই। অর্থাৎ কোয়ান্টাম বলবিদ্যা মেনে নিলে, একই ধরনের কৃষ্ণগহ্বর অনির্দিষ্ট সংখ্যক বিভিন্ন তারাজাত হতে পারে। কিন্তু সত্যিই কী তারাদের সেই সংখ্যা অসীম হতে পারে? অন্যদিকে অনিশ্চয়তা সুত্র মেনে নিলে বস্তুকণার তরঙ্গ দৈর্ঘ তার সৃষ্ট কৃষ্ণগহ্বরের বস্তুকণার তরঙ্গ দৈর্ঘের চাইতে ছোট হতে হবে। তাহলে তরঙ্গ দৈর্ঘের অসীম হয়ে ওঠা প্রমাণ করা গেল না। জেকব বেকেন্সটাইন বললেন, সীমিত এই সংখ্যা থেকে কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপি মাপা যাবে। আর সেটা করতে পারলে পতনের সময় যে তথ্য হারিয়ে গিয়েছিল, তার পরিমাপ জানা যাবে। বেকেন্সটাইনের এই মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কৃষ্ণগহ্বরের নির্দিষ্ট এনট্রপি তার ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফলের সাথে সমান। আবার এর একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আছে, যা তার মাধ্যাকর্ষণের সাথে সমানুপাতিক। এর ফলে কৃষ্ণগহ্বরের ক্রমাগত বিকিরণ হয়ে তার সুস্থিতি বজায় থাকবে। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বর সর্বগ্রাসী, তার থেকে কোনও রশ্মি বিকিরণ হওয়া অসম্ভব। কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে এমন ধারণা একটা কূটাভাসের সৃষ্টি করেছে। তাই কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।
মূল বক্তৃতাটি শোনার জন্য লিংক – https://www.bbc.co.uk/programmes/b06pttqf