বাগ্মী হকিং– পর্ব ১, পর্ব ২ , পর্ব ৩
ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
বাগ্মী হকিং-৪- নির্লোম ব্ল্যাক হোল
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ব্ল্যাক হোলে যদি তুমি ঢুকে যাও তাহলে আর বেরিয়ে আসতে পারবে কি?
হ্যাঁ এবং না। কারণ চেনা দুনিয়ায় নিজের চেনা ইতিহাসের সুতোয় বাঁধা পুতুল হয়ে তুমি বেরোবে না আর। বেরোবে হয়ত অন্য কোনো সমান্তরাল বিশ্বে, অন্য কোনো উদ্বর্তনের ইতিহাসের ফসল হয়ে। অন্য চেহারায়।(সম্পাঃ)
(২০১৬ সালে বিবিসির জনপ্রিয় রেইথ লেকচার সিরিজে দ্বিতীয়বার বক্তৃতা দিতে আসেন প্রফেসর স্টিফেন হকিং। তাঁর সেই অসাধারণ বক্তৃতাটির বিষয়ে কিছু কথা)
আগের বক্তৃতায় ব্ল্যাক হোলের রীতি প্রকৃতি নিয়ে মনে হয় শ্রোতাদের একটু দোলাচালে ফেলে দিয়েছিলেন হকিং। কল্পনাতীত ভর বিশিষ্ট এই ব্ল্যাক হোলেরা ভেঙে পড়া তারা থেকে জন্ম নেয়। বিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব বলে, মহাকাশের অসীম সংখ্যক নক্ষত্র থেকে একই আচরণের অসীম সংখ্যক ব্ল্যাক হোল সৃষ্টি হতে পারে। আবার আর একটি তত্ত্ব বলে, জন্ম নেওয়া সেই একই ধরণের ব্ল্যাক হোলের সংখ্যা সীমিত। উত্তর হ্যাঁ ও না এর মধ্যে দোদুল্যমান। সংশয়ের সমাধান হয়, যদি আমরা বুঝে নিই যে, এই জগতের সব কণা ও সব বলের মধ্যে লুকিয়ে আছে আলাদা আলাদা তথ্য, অর্থাৎ ইনফরমেশন।
বিজ্ঞানী জন হুইলার বলেছিলেন – “ব্ল্যাক হোলের লোম নেই।” তিনি আসলে যা বলতে চেয়েছিলেন তা হল— ব্ল্যাক হোলের বাইরে থেকে তার ভর, মোট বিদ্যুতের পরিমাণ ও ঘূর্ণন ছাড়া অন্যান্য ধর্ম বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, ব্ল্যাক হোলের বেশির ভাগ তথ্য সে বাইরের জগত থেকে আড়ালে রেখেছে। যদি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তথ্য তার ভরের সমানুপাতিক হয়, তবে তার একটা নির্দিষ্ট তাপমান থাকা উচিত এবং একটা জ্বলন্ত ধাতবখন্ডের মতো তার আলো বিকিরণ করবার কথা। কিন্তু সে তো অসম্ভব, কারণ ব্ল্যাক হোলের থেকে কোনও কিছুই বাইরে বিচ্ছুরিত হওয়ার কথা নয়।
(মজার প্রশ্নঃ তিনটে পাত্র আছে। তার একটাতে এক কিলো হাইড্রোজেন গ্যাস আছে। আরেকটাতে এক কিলো ওজনের একটা বই আছে। তৃতীয়টাতে এক কিলো ওজনের একটা পাথর আছে। কোনটাতে তথ্য সবচেয়ে বেশি আর কোনটায় তথ্য সবচেয়ে কম আছে?– সম্পাঃ)
১৯৭৪ সালে আমি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্ব প্রয়োগ করে ব্ল্যাক হোলের চারপাশের পদার্থের রীতি প্রকৃতি নিয়ে কিছু কাজ করছিলাম। অঙ্ক কষে দেখলাম, ব্ল্যাক হোল থেকে সমান হারে কণা নির্গত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সেই সময়ের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতো আমিও ভেবেছিলাম, ব্ল্যাক হোল থেকে কোনও কিছুরই নির্গমন সম্ভব নয়। এমত হতবুদ্ধি অবস্থা থেকে বাঁচতে একটু বেশি পরিশ্রম করা শুরু করলাম। মুশকিল হল, যতই এই ভাবনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করি, ততই ব্ল্যাক হোলের বিকিরণের বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। ক্রমশ আমার দৃঢ়মূল ধারণা হতে লাগল, ব্ল্যাক হোল থেকে কণার বিকিরণ হওয়ার ঘটনা, এক রূঢ় বাস্তব। আরও একটু এগিয়ে ভাবতে গিয়ে দেখলাম, বিকিরিত কণাগুলোর বর্ণালী অবিকল তাপীয় ধর্মের (থার্মাল স্পেকট্রাম)। আমার অঙ্ক বলল, অন্যান্য উত্তপ্ত বস্তুর মতো ব্ল্যাক হোলও কণার জন্ম দেয় এবং সে কণা ও রশ্মি দুইই বিকিরণ করে। ঠিক যেমন যে কোনও উত্তপ্ত বস্তুর তাপমাত্রা তার মোট ভরের সাথে ব্যাস্তানুপাতিক ও পৃষ্ঠদেশের মহাকর্ষজ টানের সাথে সমানুপাতিক, ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা হুবহু এক।
এই গণনাগুলো থেকে প্রথমবার টের পাওয়া গেল, ব্ল্যাক হোল শুধুই একমুখী পথ নয়। তার থেকে এই যে বিকীরণের কথা বললেন হকিং, সে বিকীরণোকে তাঁরই নামে নামদেয়া হয়েছে “হকিং বিকীরণ।”
এর পর থেকে, ব্ল্যাক হোল থেকে তাপ বিকিরণের আরও নানান গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন একাধিক বিজ্ঞানী।
ব্ল্যাক হোল থেকে বিকীরণের একখানা ব্যাখ্যা এইরকমঃ
কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী, শূন্য শুধু শূন্য নয়। এই তত্ত্বের ‘অনিশ্চয়তার’ নীতি বলে, মহাশূন্যের যেকোনো স্থান কালে, খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও বস্তুকণার সৃষ্টি হবার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। এই কণারা সবসময় জোড় বেঁধে আসে। একটা বস্তুকণা(তার পেটে পজিটিভ বিদ্যুতের প্রোটন আর চারপাশে নেগেটিভ বিদ্যুতের ইলেকট্রন) আর অন্যটা হল তার উলটো ধর্মের প্রতিবস্তুকণা( পেটে নেগেটিভ বিদ্যুতওলা অ্যান্টি প্রোটন আর চারধারে পজিটিভ বিদ্যুতওয়ালা পজিট্রন)। প্রতিমুহূর্তেই এই ভার্চুয়াল কণাদের (অলীক, কারণ এরা কেবল একটা সম্ভাবনা। এদের যন্ত্র দিয়ে সরাসরি মাপা যায় না, তবে তাদের উপস্থিতির বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়।) কিছু কিছু জুটির সৃষ্টির সেই সম্ভাবনাটা পূর্ণমান ( বা ১০০ শতাংশ) ছুঁতেই তারা বাস্তব বিশ্বে এসে জন্ম নিচ্ছে আর তারপর একে অন্যকে ছুঁয়ে ফেলতেই ফের শক্তি ছড়িয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গোটা জগতসংসারই ভারচুয়াল ও এন্টি-পার্টিক্ল–এর জুটি দিয়ে তৈরি।
এইবারে ধরো একটা ব্ল্যাক হোলের একেবারে কিনারায় যে ভার্চুয়ালরা রিয়েল পার্টিকল হয়ে জুটি বেঁধে জন্ম নিলো, একে অন্যকে ছুঁয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার আগেই যদি তাদের একটাকে ব্ল্যাক হোল খপ করে ধরে ফেলে তখন অন্যটা আর ধ্বংস হতে পারবে না। সে বেচারা তখন ব্ল্যাক হোলের গর্তে পড়ে যেতেও পারে, আবার না পড়ে অসীমের দিকে সে ছুটেও যেতে পারে। তাই তাকে দেখে মনে হতে পারে থেকে সে যেন ব্ল্যাক হোল থেকে বেরিয়ে আসছে।
সূর্যের ভরের সমান ভরের কোনও ব্ল্যাক হোল থেকে যদি কোনও কণা বিকিরিত হয়, তার বিকিরণের হার এতই কম হবে যে যন্ত্রের মাধ্যমে সেই ঘটনাকে আবিষ্কার করা অসম্ভব। এবার ধরা যাক একটা পাহাড়ের মাপের ছোট্ট কৃষ্ণগহ্বর পাওয়া গেল। সেখান থেকে নির্গত হবে এক কোটি মেগাওয়াট শক্তির এক্স-রে ও গামা-রে। এইটুকু শক্তি কিন্তু সারা পৃথিবীর প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ শক্তি জোটানোর ক্ষমতা রাখে। মুশকিল হচ্ছে বিপুল এই শক্তি কোনও তড়িৎকোষে বা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ধরে রাখা যাবে না। তবে, যদি এই ছোট্ট ব্ল্যাক হোলটি পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়, তাহলে অবশ্য সব সমাধানের রাস্তা খুলে যায়। পৃথিবীর কাছাকাছি এমন ভরের ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার করার জন্য বিজ্ঞানীরা কম চেষ্টা করেনি। তবে তেমনটা খুঁজে পাওয়া গেলে এতদিনে আমার নোবেল পুরস্কার পাওয়া কী কেউ আটকাতে পারত?
যাই হোক, এমন মাইক্রো-ব্ল্যাকহোল কিন্তু চার মাত্রিক জগতে নয়, স্থান-কালের অন্য মাত্রায় (ডাইমেনশন) পাওয়া যেতে পারে। আমরা যে ব্রহ্মাণ্ড দেখতে পাই, সেটি কিন্তু চারমাত্রিক। দশ বা এগারো মাত্রার মধ্যে মাত্র চারটি মাত্রা দেখতে পাওয়া যায়, কারণ আলো কেবলমাত্র চারমাত্রার মধ্যেই চলাফেরা করতে পারে। আমাদের চেনা জানা চার মাত্রা ছাড়া অন্য মাত্রাগুলোতে মাধ্যাকর্ষণ তার প্রতিপত্তি দেখাতে পারে এবং সেখানে তার শক্তি আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের থেকে অনেকগুণ বেশি শক্তিশালী হতেও পারে। সুইজারল্যান্ডের সার্ন ল্যাবরেটরিতে রাখা লার্জ হাইড্রন কোলাইডারে কৃত্রিম উপায়ে ব্ল্যাক হোল সৃষ্টি করবার চেষ্টা চলছে। সেই যন্ত্রটিতে দুটি বিপরীত দিশায় কণা স্রোতকে প্রচণ্ড বেগে ঘুরিয়ে, পরস্পর সংঘাতের মধ্যে দিয়ে মাইক্রো-ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পাওয়ার আশায় আছেন বিজ্ঞানীরা। যদি সব ঠিকঠাক থাকে তবে এমন কিছু কণা নির্গত হবে, যাদের সহজেই সনাক্ত করা যাবে। সেক্ষেত্রে আমার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ব্ল্যাক হোল থেকে ক্রমাগত কণা নির্গত হতে থাকলে সে একসময়ে ক্রমশ ছোট হতে থাকবে এবং তার ভর কমতে থাকবে। যত ভর কমবে, ততই দ্রুত তার থেকে কণা নির্গমন হবে। তাহলে ব্ল্যাক হোলের মধ্যে অসাবধানে যে নভশ্চর বা কণাগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছিল তাদের কী হবে? ব্ল্যাক হোল বিলীন হয়ে গেলে, তার ভিতরে বন্দী নভশ্চর বাইরে বেরিয়ে আসবে, এমনটা কিন্তু আদৌ হবে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে ব্ল্যাক হোলের ভিতরে যা কিছু পড়ে গিয়ে আটকে গিয়েছিল, তাদের সব তথ্য হারিয়ে যাবে, কিছুই ফিরে পাওয়া যাবে না। এই তথ্য হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বৈজ্ঞানিক যুক্তির বিরোধী।
২০০ বছরের পুরনো বৈজ্ঞানিক ধারণা আমাদের শিখিয়েছে, বিজ্ঞানের সব সূত্রগুলোই হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডের আসল চালিকা শক্তি। পিয়েরে সাইমন লাপ্লাস বলেছিলেন, “যদি কোনও একটা সময়বিন্দুতে ব্রহ্মাণ্ডের দশা জানা যায়, তবে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো ভবিষ্যৎ ও অতীতে ব্রহ্মাণ্ডের অবস্থাও ব্যাখ্যা করতে পারবে।” নেপলিয়ান লাপ্লাসকে প্রশ্ন করেছিলেন — “তাহলে সেক্ষেত্রে ভগবানের ভূমিকাটা কোথায় বলতে পারেন?” লাপ্লাস উত্তর দিয়েছিলেন — “আমার অন্তত এই ব্যাপারে ভগবানকে বসানোর প্রয়োজন হয়নি।” মনে হয় না লাপ্লাস ভগবানের অস্তিত্ত্ব সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ ছিলেন। বরং হয়তো ভেবেছিলেন যে, ভগবান বিজ্ঞানের সূত্রে হস্তক্ষেপ করা পছন্দ করেন না। সত্যি কথা বলতে কী, ভগবানের হস্তক্ষেপ থাকলে বিজ্ঞানের কোনও সূত্রই আর সূত্র থাকে না।
লাপ্লাসের কথা মেনে নিলে আমাদের যে কোনও বস্তুর অবস্থান ও গতি জানতে হবে। ১৯২৩ সালে ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ অনিশ্চয়তার যে তত্ত্ব জানিয়েছিলেন, সেটি কিন্তু এর বিপরীত কথাই বলে। এটিই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গোড়ার কথা। যতই আমরা একটি বস্তুর অবস্থান সঠিক ভাবে জানতে পারব, ততই তার গতি সঠিক ভাবে মাপা যাবে না। অর্থাৎ একই সময়ে বস্তুর আবস্থান ও গতি দুটিই একসাথে সঠিক ভাবে জানবার আর উপায় থাকল না। তাহলে কীভাবে সঠিক ভবিষ্যতবাণী করা যাবে? এর উত্তর হল — যদিও বস্তুর অবস্থান ও গতির সঠিক পরিমাপ একই সময়ে সম্ভব নয়, তবু তার কোয়ান্টাম অবস্থান জানা যাবে। কোয়ান্টাম অবস্থা জানলে বস্তুর অবস্থান ও গতি কিছুটা পর্যন্ত সঠিক জানা যাবে, সম্পূর্ণ ভাবে নয়। যদি আমরা বর্তমান ব্রহ্মাণ্ডের কোয়ান্টাম অবস্থা জানতে পারি, তবে বিজ্ঞানের সূত্র অবশ্যই আমাদের ভবিষ্যৎ ব্রহ্মাণ্ডের অবস্থা সম্পর্কে জানাতে পারবে।
যদি ব্ল্যাক হোলে গ্রাস হয়ে সব তথ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে জগত সংসার নিয়ে ভবিষ্যতবাণীও করা যাবে না। ব্ল্যাক হোলের সেই গভীর অতল গহ্বর থেকে অনেক কণা বিকিরিত হতে পারে, তা একটা দামি টেলিভিশন সেটই হোক, কিম্বা সেক্সপিয়ারের রচনা সমগ্র — সব কিছুই উদ্ধার হওয়া সম্ভব, তবে আগের অবস্থায় সেসব ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা বড়ই কম। মজার ব্যাপার হল, ব্ল্যাক হোল থেকে কী কী নির্গত হতে পারে আর না পারে, সে নিয়ে আগেভাগে মাথা ঘামিয়ে বিশেষ লাভ নেই, কারণ এখনো পর্যন্ত আমরা ধারেকাছে কোনও ব্ল্যাক হোলের দেখা পাইনি।
একটা নীতিগত প্রশ্ন হল — যদি ব্রহ্মাণ্ডের ভবিষৎবাণীর বিষয়টা ব্ল্যাক হোলের কাছে এসে ভেঙে পড়ে, তবে অন্য কোনও অবস্থাতেও সেরকম ঘটতে পারে। তার চাইতেও বড় বিপদ হল সেক্ষেত্রে আমাদের অতীতটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এমন হলে ইতিহাস বইগুলোও ফেলে দেওয়া উচিত, কারণ সেক্ষেত্রে আমাদের অতীত হয়ে উঠবে এক বিভ্রম। আমাদের নিজেদের অস্তিত্ত্ব হবে বিপন্ন।
তাই কৃষ্ণগহ্বরের তথ্য হারিয়ে যায় কিনা এবং সেই তথ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব কিনা, তা জানা অত্যন্ত জরুরি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তথ্য হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা একেবারেই ঠিক নয়। কিন্তু কেউ সেই তথ্য উদ্ধারের রাস্তাটাও তো বাতলে দিতে পারছে না। বছরের পর বছর বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই নিয়ে বচসা ক্রমাগত চলে এসেছে। অবশেষে আমি একটা রাস্তা বোধহয় খুঁজে পেয়েছি। এই সমস্যার সমাধানে রিচার্ড ফেইনম্যানের তত্ত্ব মেনে নিতে হবে, যার মূল কথা হল — ব্রহ্মাণ্ডের একটা নয়, অনেকগুলো সম্ভাব্য ইতিহাস আছে। প্রতিটি ইতিহাসের ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা আলাদা আলাদা। হয়তো একটা ইতিহাসে একটা ব্ল্যাক হোল আছে। তাহলে তার মধ্যে একটা বস্তু পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। আবার আর একটা ইতিহাসে কোনও ব্ল্যাক হোল নেই। তার গর্তে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। মানে ব্যাপারটা হল, বাইরে থেকে কেউ তো আর একটা ইতিহাসে ব্ল্যাক হোল আছে কী না, তা বলতে পারবে না। তাই জগতের কোনও একটি ইতিহাসে ব্ল্যাক হোল নেই, এই ঘটনাটা ঘটবার সম্ভাবনাও প্রবল। এই সম্ভাবনাটাই তথ্য যত্ন করে জমিয়ে রাখবার জন্য যথেষ্ট, তবে সেটা কাজের তথ্য হবে কিনা, কেউ বলতে পারে না। বুঝিয়ে বলতে গেলে, ধরা যাক এনসাইক্লোপিডিয়ার একটা খণ্ড পুড়িয়ে ফেলা হল। তারপর তার ছাই আর ধোঁয়া সংগ্রহ করে রাখা হল। এবার কিন্তু বইটাতে কী লেখা ছিল, তা আর পড়া যাবে না। ব্ল্যাক হোলে সব তথ্য হারিয়ে যেতে পারে কী না, সে নিয়ে আমি পদার্থবিদ জন পার্স্কিলের সাথে বাজি ধরেছিলাম। আমি বলেছিলাম ব্ল্যাক হোলে হারিয়ে যাওয়া বস্তুর সব তথ্য হারিয়ে যাবে। পার্স্কিল বলেছিল, কিছুই হারিয়ে যাবে না। পরে যখন আমি আবিষ্কার করলাম কীভাবে ব্ল্যাক হোলে তথ্য সঞ্চয় হতে পারে, তখন আমি বাজি হেরে গেলাম। বাজি ধরার শর্ত অনুযায়ী পার্স্কিলকে একটা এনসাইক্লোপিডিয়া কিনে দিতে হয়েছিল। সত্যি বলতে কী, তাকে আমার দেওয়া উচিত ছিল একমুঠো ছাই — এনসাইক্লোপিডিয়াটা পুড়িয়ে দিয়ে যা পাওয়া যেত। রসিকতা সরিয়ে রেখে বলি, আমার কাজটাতে বিশদে ব্যাখ্যা করেছিলাম কীভাবে ব্ল্যাক হোল থেকে তথ্য ফিরে পাওয়া সম্ভব। নিজস্ব ইভেন্ট হরাইজনে ব্ল্যাক হোল তার সব তথ্য সাঙ্কেতিক উপায়ে ধরে রাখে।
আমার এই আবিষ্কার ব্ল্যাক হোলের কবলে পড়া কল্পিত মানুষকে অন্য ব্রহ্মাণ্ডে চলে যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিয়েছে। তবে একটা কথা বলে রাখি — অন্য ব্রহ্মাণ্ডে পা রাখতে হলে একটা বড়সড় ব্ল্যাক হোল বেছে নিতে হবে। আর যদি সেই ব্ল্যাক হোলটি ঘূর্ণায়মান হয়, তবে অন্য ব্রহ্মাণ্ডে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অসুবিধা হচ্ছে অন্য জগতে পাড়ি দিলে আমাদের এই প্রিয় জগতে কিন্তু আর ফিরে আসা যাবে না। তাই আমি নিজে যদিও মহাকাশ পাড়ি দিতে যথেষ্ট আগ্রহী হলেও ব্ল্যাক হোলে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার কোনোরকম ইচ্ছেই আমার নেই।
আমার এই বক্তৃতার উদ্দেশ্য, এটাই বোঝানো যে — ব্ল্যাক হোল কিন্তু অতটা কালোও নয়, যতটা বাইরে থেকে তাকে মনে হয়। অনন্তকালের কারাগার সেটি আদৌ নয়, আগে আমাদের যেমন ধারণা ছিল। ব্ল্যাক হোলের খপ্পরে পড়েও তার থেকে বেরিয়ে আসবার উপায় আছে, আছে অন্য ব্রহ্মাণ্ডে পৌঁছানোর রাস্তা। যদি তোমরা ভুল করেও এমন কালো গর্তে পড়ে যাও, চিন্তা নেই, নিষ্ক্রমণের রাস্তাও বলে দিয়ে গেলাম।
তথ্যসূত্রঃ Transcript of Stephen Hawking’s second BBC Reith lecture broadcast on 02.02.2016