ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
প্রকৃতিবিদ ও ভূ–বৈজ্ঞানিক লুই আগাসিজ
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
লুইদের বাড়িটা ছিল ভারি সুন্দর এক জায়গায়। ছোট্ট বাড়িটা দেখে মনে হত যেন পাহাড়ের গায়ে সেই বাড়িটাকে কেউ গেঁথে রেখেছে। সামনে বয়ে যেত গাঢ় নীল রঙের লেক। আকাশে জলেতে সেখানে হাত ধরাধরি করে মেলামেশা। শীতের সময় লেকের জল জমে বরফ হত আর বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল সেখানে স্কেটিং করত। বাড়ির জানালা দিয়ে লেকের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছোট্ট লুই মনে মনে ভাবত সে বড়ো হয়ে একদিন প্রকৃতির অজানা রহস্যের দ্বার খুলে দেবে। জলের মাছ, আকাশের পাখি আর ঘাসের উপরে নিঃশব্দে সবার অলক্ষ্যে চলে বেড়ানো পোকামাকড়ের প্রতি তাঁর স্বাভাবিক কৌতূহলের থেকে জন্ম নেওয়া প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জেরবার হয়ে যেত লুইয়ের মা। কিন্তু ছেলের অপরিসীম কৌতূহল মেটানোর চেষ্টায় তাঁর কোনও ত্রুটি ছিল না।
সুইজারল্যান্ডের মোতিয়ের গ্রামে লুইদের বাড়ির পিছন দিকে ওর বাবা তৈরি করিয়েছিলেন পাথরের এক বিশাল চৌবাচ্চা। লুই আর তার ছোটো ভাই আগস্টার প্রকৃতিপ্রেম দেখে বাবা সেই চৌবাচ্চায় এনে জমিয়েছিলেন রঙবেরঙের মাছ। মাছেদের গতিবিধি দেখতে দেখতে লুই ঠিক করে, বড়ো হয়ে সে মাছেদের নিয়ে পড়াশুনো করবে। একটু বড়ো হতেই দুই ভাই গ্রামে ওস্তাদ মাছমারা বলে বেশ নাম করে ফেলল। লেকের জলে সাঁতার কাটতে গিয়ে দুই ভাই নিপুণ দক্ষতায় খালি হাতে মাছ ধরত; তারপর পরখ করে আবার জলেই তাদের ছেড়ে দিত।
স্কুল ছাড়তেই লুই ভর্তি হল লসেনের এক কলেজে। লুইয়ের বাবার পেশা পৌরহিত্য থেকে সামান্য আয় হত। কাজেই যথেষ্ট অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে শুরু হল লুইয়ের পড়াশুনো। মেধার কারণে সহজেই এই প্রতিভাশালী ছেলেটি মাস্টারমশাইদের নজরে পড়ল।
বিভিন্নমাছ আর অন্যান্য প্রাণীদের পর্যবেক্ষণ করে যে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ হত, অত্যন্ত যত্ন করে লুই সেই তথ্য লিখে রেখে দিত। প্রাণীদের জীবন নিয়ে উৎসাহ লক্ষ করে লুইয়ের এক আত্মীয় তাকে ভর্তি করে দিল জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিজ্ঞানের ক্লাসে। সেখান থেকে পাশ করার পর তার জন্য খুলে গেল ডাক্তারি পড়ার দরজা। তার মনে হল, ডাক্তারি পড়লে মানুষের শরীর সম্বন্ধে জানা যাবে, মন্দ কী? তাই সে ডাক্তারি পড়তে শুরু করল।
এদিকে ডাক্তারি পড়তে অনেক খরচ। সদাশয় এক প্রফেসর লুইয়ের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরি লুইয়ের জন্য খুলে দিলেন। সেখানে বসে মোটা মোটা বই নিজের হাতে লিখে নকল করে রেখে দিত লুই। কারণ, বই কেনার মতো সামর্থ তার ছিল না। ডাক্তারি পাশ করার পর লুই ব্রাজিলে মাছের ফসিলের উপর গবেষণা করে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করেন। কাজের এমন নিষ্ঠার ফলস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় লুইকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। এই গবেষণার ফলে প্রায় ১৭০০ বিভিন্নধরনের মাছের জীবাশ্মের তথ্য সম্বলিত বই প্রকাশ হয় এবং প্রাণীবিজ্ঞানীরা লুইয়ের প্রতিভাকে চিনতে পারেন। ফলত, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে নিউকাটেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হয়ে যোগ দেন লুই আগাসিজ।
স্কুলে ছাত্রাবস্থা থেকেই লুই পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসতেন। আল্পস পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে ছিল তাঁর সছন্দ চলাফেরা। অনেকধরনের প্রাণী সংগ্রহ করাও তাঁর শখ ছিল। সেই শখ ক্রমশ পেশাদারী পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গড়ে তুলেছিল এক পেশাদার জীবাশ্ম-বিজ্ঞানী এবং ভূতাত্ত্বিককে। আল্পস পর্বতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎই লুই আবিষ্কার করেন ভূ-তত্ত্বের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা—তুষার যুগের অস্তিত্ব। ঘুরে ফিরে পৃথিবীর বুকে এসেছিল তুষার যুগ। শেষ তুষার যুগের প্রমাণ সংগ্রহ করে ফেললেন লুই আগাসিজ।
সুইজারল্যান্ডের চাষিরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে জানত, আল্পস পর্বতের হিমবাহ আগে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তারা লক্ষ করেছিল, বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই হিমবাহে আটকে দূর থেকে বয়ে এসেছিল তাদের চাষের জমিতে। আল্পস পর্বতে চাষিদের সঙ্গে আলোচনা করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন আগাসিজ। প্রচণ্ড ভারী হিমবাহ পৃথিবীর বুকে তাপমাত্রা বেড়ে যাবার কারণে দূরে সরে যাওয়ার সময় কোথাও কোথাও পাথরের বুকে যেন আঁচড়ে দিয়ে গিয়েছিল, যার নিদর্শন আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। এইসব নিদর্শন প্রমাণ করে পৃথিবীতে তুষার যুগ এসেছে বারবার।
১৮৩৭ সালে সুইস সোসাইটি অফ ন্যাচরাল সায়েন্সের অধিবেশন শুরু হয় বেজায় হট্টগোল দিয়ে। অ্যাসোসিয়েশনের তরুণ অধ্যক্ষ লুই আগাসিজের বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল জীবাশ্মর উপর তার নতুন গবেষণার ফলাফল নিয়ে। কিন্তু তিনি সুইজারল্যান্ডের জুরা পর্বতের লক্ষ্যভ্রষ্ট পাথর (erratic stone) নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। জানালেন, জুরা পর্বতের পাদদেশে চাষের জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরগুলো আসলে বহুবছর আগে হিমবাহ বাহিত হয়ে এসেছিল। ব্যস, বেধে গেল তর্ক। জীববিজ্ঞানী যদি তাঁর নিজের বিষয় ছেড়েছুড়ে ভূ-তত্ত্বের কথা শোনাতে যান, তাহলে বিজ্ঞানীরা শুনবেন কেন? এদিকে আগাসিজও নাছোড়বান্দা, তিনি স্ব-আবিষ্কৃত তুষারযুগের তত্ত্ব নিয়ে বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। লোকে একবারেরই তাঁর কথা পাতে দেবার মতো বলে মনে করল না।
তুষার যুগের কথা এর আগেও যে বিজ্ঞানীরা বলেননি, তা কিন্তু নয়। তবে তাঁদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। আগাসিজ তাদের কর্ণ ধরে সেই গল্প শোনাতে চাইলেন। তিনি বললেন, বড়ো বড়ো গ্রানাইট পাথরের চাঁই জুরা পর্বতে বয়ে আনল কে? এগুলো তো থাকার কথা মঁ ব্লাঁ পর্বতে। আসলে এরা হিমবাহের শক্ত বরফে আটকে ছিল। তারপর যেই না বরফ গলতে শুরু করল, পাথরের চাঁইগুলো খসে পড়ল যত্রতত্র। বিজ্ঞানীরা যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই পাথরগুলোর নাম দিয়েছেন ইর্যাটিক স্টোন। বাংলায় বললে, লক্ষ্যভ্রষ্ট পাথর। আগাসিজ যুক্তি দিলেন, লক্ষ্যভ্রষ্ট পাথর দেখে বোঝা যাচ্ছে, হিমবাহ একসময়ে জুরা পর্বতের অনেক নিচে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বসেছিল। হিমবাহ যদি পাহাড়ের পাদদেশে একসময় থেকে থাকবে, তবে নিশ্চয়ই বাইবেলে বর্ণিত বন্যার গল্প সত্যি হলেও হতে পারে। কিন্তু জল জমে বরফ হয়ে গেল কী করে? জলমগ্ন পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েই বরফ জমে গিয়েছিল?
এদিকে আগাসিজের হাত ধরে বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামাতে লাগলেন তুষার যুগের সত্যতা নিয়ে। ফল মিলল হাতেনাতে। পরীক্ষা করে পাওয়া গেল ভূ-তাত্ত্বিক নিদর্শন। মিলে গেল আগাসিজের কথা। পৃথিবীর অন্য জায়গাতেও সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ের উপত্যকায় মিলল ছড়ানো ছেটানো এমন অনেক পাথর, যাদের থাকার কথা অনেক অনেক দূরে। বন্যার জলে এই ভারী ভারী পাথর ভেসে আসা অসম্ভব। একমাত্র জল জমে বরফ হয়ে হিমবাহে পরিবর্তন হলে তবেই সম্ভব পাথরের স্থানান্তরণ। ভূতাত্ত্বিকেরা এর নাম দিয়েছেন, ড্রিফট থিওরি। লুই আগাসিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ড্রিফট থিওরির জন্ম দিল।
লক্ষ্যভ্রষ্ট পাথর
১৮৪৫ সালে নিজের সঞ্চয় থেকে খরচ করে ফসিলের উপর নতুন গবেষণা ও সেই বিষয়ে বই লিখতে গিয়ে প্রফেসর লুই আগাসিজ প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন। তখন তাঁর বয়স আটত্রিশ। বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ অ্যালেক্সান্ডার ভন হ্যাম্বোল্টের সহায়তায় বোস্টনে লয়েল ইন্সটিটিউটে বক্তৃতা দেওয়ার কাজ পেয়ে যান লুই আগাসিজ। এরপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রফেসর পদে নিযুক্ত করে। ডাক্তারি পাশ করেও কোনওদিন চিকিৎসা করেননি লুই। প্রকৃতির জীবজগত নিয়ে নিত্যনতুন পরীক্ষা এবং প্রাণী সংরক্ষণ করে বিভিন্ন মিউজিয়াম তৈরিতে বেশি আনন্দ পেতেন তিনি। কাজেই সেই সময়ের সবচাইতে জনপ্রিয় একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বৈজ্ঞানিক সংস্থাতে নিযুক্ত ছিল তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রী।
কর্মজীবনের প্রায় শেষভাগে এসে একটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন লুই আগাসিজ। চার্লস ডারউইন ছিলেন তাঁর সমসাময়িক। দু’জনেই পরস্পরের কাজে যথেষ্ট শ্রদ্ধা রাখতেন। কিন্তু আগাসিজ ডারউইন প্রবর্তিত ‘প্রিন্সিপল অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ তত্ত্ব মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, “ভগবান তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে রেখে আর হস্তক্ষেপ করেননি।”
লুই তাঁর এই বক্তব্যের জন্য বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ট নিন্দে কুড়িয়েছেন, কিন্তু নিজের তত্ত্বে অবিচলিত থেকে অস্বীকার করে গেছেন জীবজগতের বিবর্তনের প্রমাণকে। ডারউইনের ‘থিওরি অফ ইভোলিউশন’ তখন সারা পৃথিবীতে এমনভাবে সাড়া জাগিয়েছে যে, সেই প্রেক্ষাপটে লুইয়ের মন্তব্য ছিল একেবারে অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির। কিন্তু লুই আগাসিজ ধর্মান্ধ বৈজ্ঞানিক ছিলেন, এমন কথা তাঁর শত্রুও বলত না। বিজ্ঞানী মহলে তাঁর জনপ্রিয়তা যথারীতি অক্ষুণ্ণ ছিল।
১৮৬০ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে লুই আগাসিজ কর্মবিরতি নিয়ে তাঁর প্রথম জীবনের প্রিয় বিষয় ব্রাজিলের মাছেদের জীবাশ্ম নিয়ে আবার গবেষণা শুরু করেন। ব্রাজিলে নিজের দলবল নিয়ে অভিযান চালান। ঘরে ফিরে তিনি একটি বিশদ বই প্রকাশ করেন তাঁর গবেষণা নিয়ে। ১৮৭১ সালে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে আবার দক্ষিণ আমেরিকা যাত্রা করেন। কিন্তু পরিশ্রম ততদিনে লুইয়ের শরীরকে ভেঙে দিয়েছে। ১৮৭৩ সালে পরলোক গমন করেন এই কঠোর পরিশ্রমী প্রকৃতিবিদ ও ভূ-বৈজ্ঞানিক।
আমেরিকা সরকার লুই আগাসিজের মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে উত্তর আমেরিকার একটি হিমবাহ হ্রদের নামকরণ করে ‘লেক আগাসিজ’। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, মাছি, কচ্ছপের বৈজ্ঞানিক নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় আগাসিজের নাম। তুষার যুগের অস্তিত্ব আবিষ্কারের জন্য চিরকাল লুই আগাসিজের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে।
Excellent. Khub Bhalo laglo. Anek Kichu janlam. Dhanyabad
LikeLike