ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
রসায়নের পথপ্রদর্শক রবার্ট বয়েল
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
স্কুল পড়ুয়াদের সবার পরিচিত নাম রবার্ট বয়েল। নীচু ক্লাসে বিখ্যাত ‘বয়েলস ল’ পড়েনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই রবার্ট বয়েলকে নিয়েই বর্তমান প্রবন্ধ।
আয়ারল্যান্ডের একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি ছিলেন রবার্টের বাবা রিচার্ড বয়েল। তিনি আয়ারল্যান্ডের সম্মানিত ‘আর্ল অফ কর্ক’ উপাধি পান ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে। রাজনিতিক রিচার্ড বয়েল আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনের লড়াইতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে থেকে ব্রিটেনের মহামান্য রানিকে সাহায্য করেন। এর ফলে তিনি বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে যান। আয়ারল্যান্ডে প্রচুর কৃষিজমির মালিক হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বড়লোক হয়ে পড়েন রিচার্ড।
রিচার্ড বয়েলের চোদ্দ নম্বর সন্তান ছিলেন রবার্ট বয়েল। আয়ারল্যান্ডে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে রবার্টের জন্ম হয়। মাত্র আট বছর বয়সেই তাঁর মেধার পরিচয় পেয়েছিলেন শিক্ষকেরা। গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বুদ্ধিমান রবার্টকে বিদেশ ভ্রমণে পাঠিয়ে দেন তাঁর বাবা চার্লস। উদ্দেশ্য, জ্ঞানার্জন এবং অভিজ্ঞতা লাভ। আয়ারল্যান্ড তখন গৃহযুদ্ধে উত্তাল। যুদ্ধের কারণ ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিরোধ। রবার্ট ছোটবেলা থেকেই তাই ঝুঁকলেন ধর্মের দিকে। কিন্তু পড়াশুনো শেষ করার জন্য তিনি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বসবাস করতে থাকেন।
সতেরো বছর বয়সে রবার্ট লন্ডনে ফিরে এসে পৈতৃক খামারবাড়িতে থাকতে শুরু করেন। তাঁর জীবন কিন্তু বিজ্ঞানচর্চা দিয়ে শুরু হয়নি। লন্ডনে ফিরে এসে তিনি প্রথমেই ধর্মতত্ত্বের দিকে ঝোঁকেন এবং সাহিত্যিক গুণ সম্বলিত ধর্মের বই লিখতে থাকেন। জানা যায়, এক প্রবল ঝড় বৃষ্টির রাতে ঘুম ভেঙে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কার তৈরি? কেন প্রকৃতি এত ভিন্ন ভিন্ন রূপে নানা জায়গায় দেখা দেয়?
মনে উদয় হওয়া প্রশ্নের খোঁজে শুরু হল রবার্টের বিজ্ঞানচর্চা। প্রথমে তিনি দর্শনের সাহায্য নিলেন প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া রহস্য উদ্ঘাটনে। তারপর তাঁর যুক্তিবাদী মন বলল, একমাত্র পর্যবেক্ষণের সাহায্যেই খুলে যাবে প্রকৃতির রহস্যের দ্বার।
মজার ব্যাপার হল, যাকে পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা রসায়নবিদ্যার অন্যতম জনক বলে আখ্যা দিয়েছেন, তিনি জীবনের প্রথম পরীক্ষা করেছিলেন মানুষের মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে। এরপর এল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে ডাক। সেখানে যোগ দিয়ে রবার্ট একটি সংস্থা খুলে ফেললেন ‘এক্সপেরিমেন্টাল ফিলসফি ক্লাব’। সেখানে দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য করা হতে লাগল চমকপ্রদ সব পরীক্ষানিরীক্ষা। এই কাজে তিনি শিষ্য পেলেন রবার্ট হুককে, যিনি পরবর্তীকালে তাঁর থিওরি অফ ইলাস্টিসিটির জন্য বিশ্ববিখ্যাত হন।
প্রশ্ন উঠল, আবহাওয়া মণ্ডলে যে বাতাস আছে, তার চাপ আছে কি নেই, বা থাকলেও তার রূপ কী? গুরু-শিষ্য মিলে বানিয়ে ফেললেন একটা ইংরেজি ‘জে’ আকৃতির টিউব। টিউবের একটা দিক বন্ধ মুখ, আর একটা দিক খোলা (নিচের ছবির মতো)। সাধারণ কারণেই টিউব ছিল বাতাসভর্তি। এবার টিউবের খোলা মুখ দিয়ে কিছুটা পারদ (মার্কারি ধাতু) ঢেলে দেওয়া হল। পারদ টিউবের বাতাসে চাপ সৃষ্টি করল। তাই বন্ধ মুখের দিকে কিছুটা পর্যন্ত উঠতে পারল পারদের লেভেল। এবার আরও পারদ ঢালা হলে, টিউবের বদ্ধ বাতাসে চাপ পড়ল এবং পারদের লেভেল একটু উঠে গেল। রবার্ট বয়েল টিউবের দুই বাহুর মধ্যের তফাতকে মেপে নিয়ে বললেন, এইটা হল পারদের চাপের সমান। আর টিউবের বন্ধ মুখের খালি অংশের দৈর্ঘ্য হল বাতাসের আয়তন। বিভিন্ন মাত্রার পারদ ভরে চাপ বাড়িয়ে ও কমিয়ে, বাতাসের বিভিন্ন আয়তন মাপা হলে একটা গ্রাফ আঁকা হল (নিচে দেওয়া আছে)। রবার্ট ও হুক দেখলেন, চাপের সঙ্গে আয়তন ব্যাস্তানুপাতিক, মানে চাপ বাড়লে বাতাসের আয়তন কমে, আর চাপ কমলে তা বাড়ে। একটা সমীকরণ লিখে ফেললেন তাঁরা। , p =চাপ, V=আয়তন,k = ধ্রুবক।
যদি p-এর সঙ্গে V-এর গ্রাফ টানা হয়, তবে গ্রাফটা হবে হাইপারবলিক; আর যদি p–এর সঙ্গে 1/V -এর গ্রাফ টানা হয়, তবে সেটি হবে সরলরৈখিক।
একটু বড়ো ক্লাসের পড়ুয়া হলে বলবে, এ আর এমন কী কাজ? এই সহজ কাজটা করে লোকটা বিখ্যাত হয়ে গেল?
তখন কিন্তু কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। তখনও অ্যারিস্টটলের দর্শন বিজ্ঞানের জগতকে অন্ধ করে রেখেছিল। অনুমানের ভিত্তিতে বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ করা হত। এই ধারণার মূলে আঘাত করেন রবার্ট বয়েল। অ্যারিস্টটলিয় ধারণা ছিল, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড গড়ে উঠেছে চারটি জিনিস দিয়ে—মাটি, জল, আগুন ও বাতাস। রবার্ট বললেন, বিশ্ব গড়ে উঠেছে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদার্থ দিয়ে। অবশ্য তিনি অণু-পরমাণুর কল্পনা করেননি।
বাতাস যে প্রাণীদের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেকথাও বলেছিলেন রবার্ট। বাতাসের সংস্পর্শেই যেকোনও জিনিস পুড়ে যেতে পারে, শব্দ বহন করতেও বাতাস লাগে—সেকথাও তিনিই জানিয়েছিলেন।
মধ্যযুগে গোটা উইরোপ জুড়ে বিজ্ঞানি-অবিজ্ঞানীর দল উঠে পড়ে লেগেছিলেন কয়েকটি অকাজে। কীভাবে তিন-চারটে ধাতুর বিক্রিয়া ঘটিয়ে তৈরি করা যায় সোনা বা কীভাবে বানানো যায় এমন একটা আরক, যাতে মানুষ অমরত্ব লাভ করতে পারে কিম্বা রোগভোগের বালাই থাকে না তার। রবার্টও এর ব্যতিক্রমী ছিলেন না। তিনিও এই কাজে খুব সময় দিয়েছিলেন। ব্যাপারটা প্রায় পাগলামোর পর্যায়ে চলে যায়। এই শাস্ত্রটাকে বলা হত অ্যালকেমি। কেমিস্ট্রি বা রসায়নশাস্ত্র তখনও বিকশিত হয়নি। রবার্ট বয়েলের সঙ্গে আইজ্যাক নিউটনের খুব বন্ধুত্ব ছিল। নিউটনও সবার দেখাদেখি জীবনের অনেকটা সময় জুড়ে অ্যালকেমি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। নিউটন তাঁর সব গবেষণা গোপন রাখতেন। বেজায় সন্দেহবাতিক ছিল তাঁর। রবার্ট এই ব্যাপারটায় আরও ইন্ধন যোগান। তিনি নিউটনকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, খবরদার, তোমার পরীক্ষানিরীক্ষা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করবে না। তাহলে কিন্তু সোনা অন্য কেউ তৈরি করে ফেলবে, আর তোমার কপালে কিছুই জুটবে না।
যাই হোক, এক আদ্যোপান্ত ঈশ্বর বিশ্বাসী খ্যাপাটে বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল কিন্তু নিজের অজান্তেই কেমিস্ট্রি বা রসায়নশাস্ত্রের দরজা খুলে দিলেন। কেটে গেল অ্যালকেমিস্টদের জটিল রাসায়নিক তরলের বদ গন্ধ। বয়েলের সূত্র চিরস্মরণীয় হয়ে গেল বিজ্ঞানের পাতায়।