মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
প্রাচীন ভারতের পুরাণ ও মহাকাব্যগুলিতে এমন কিছু কাহিনি আছে যেগুলি নিছক আষাঢ়ে গল্প বলে মনে হয়। কিন্তু গল্পগুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এগুলি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক নানা ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত। এইসব কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাতে নির্মল আকাশে যে সকল জ্যোতিষ্ক দেখা যায় তাদের নানা ঘটনার কথা। মহাকাশের উজ্জ্বল, অনুজ্জ্বল নক্ষত্রগুলির জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য অবলম্বন করেই এই কাহিনিগুলির উদ্ভব। অনুমান করা হয় যে প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার অভিপ্রায়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গাণিতিক কাঠিন্যে সরস মোড়ক দেওয়া হয়েছে। রূপকের সাহায্যে বর্ণিত এই কাহিনিগুলি যেমন বিচিত্র, তেমন রোমাঞ্চকর।
বৈদিক ঋষি অগস্ত্যকে নিয়ে যেসব পৌরাণিক কাহিনি লেখা হয়েছে তাদের অন্যতম অগস্ত্য-বাতাপি উপাখ্যান। ঋগ্বেদ অনুসারে, অগস্ত্য মিত্রবরুণের পুত্র। সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হবার দিন তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন এক মহা-ঋষি। ঋগ্বেদের কিছু সূক্তেরও রচয়িতা তিনি। একদিন বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তিনি দূর থেকে ভেসে আসা কান্নার শব্দ শুনতে পান। কারা কাঁদছে এবং কেনই বা কাঁদছে তা জানার জন্য যেদিক থেকে কান্না ভেসে আসছিল সেদিকে তিনি এগোতে থাকেন। কিছু সময় পরে তিনি একটি গভীর গর্তের সামন্যে এসে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের দেখতে পান। এই অবস্থায় পূর্বপুরুষদের দেখে তিনি বিচলিত হয়ে তাঁদের দুর্গতির কারণ জানতে চান। তাঁরা তখন সমস্বরে বলে ওঠেন যে অগস্ত্য বিবাহ না করায় তাঁদের বংশরক্ষা হল না। তাই তাঁদের এই দুর্গতি। পিতৃপুরুষদের এই দুরবস্থার হাত থেকে মুক্তি দেবার জন্য তিনি বিবাহ করে বংশরক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কিন্তু কন্যা পাবেন কোথায়? বিভিন্ন রাজ্য ঘুরেও অগস্ত্য তাঁর উপযুক্ত কন্যার সন্ধান পেলেন না। ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে তিনি একদিন বিদর্ভরাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন। বিদর্ভরাজকন্যা লোপামুদ্রাকে দেখে তাঁর পছন্দ হল। তিনি তখন বিদর্ভরাজের কাছে তাঁর কন্যার পাণিগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেন। রাজারানির তো মাথায় হাত। বনে বনে ঘুরে বেড়ানো এক ঋষির সঙ্গে কী করে রাজকন্যার বিয়ে দেন? আবার অগস্ত্যর মতো মহামুনিকে না বলারও সাহস নেই। রাজারানি যখন উভয়সংকটে তখন লোপামুদ্রা নিজে এই বিবাহে সম্মতি জানিয়ে বাবা-মাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করেন।
বিবাহের পর নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে অগস্ত্য গঙ্গার তীরে বসবাস শুরু করলেন। একদিন তিনি লোপামুদ্রাকে তাঁর পূর্বপুরুষদের দুর্দশার কথা জানিয়ে বললেন যে তিনি তাঁর বংশরক্ষা করতে চান। একথা শুনে লোপামুদ্রা বিনয়ের সঙ্গে তাঁর স্বামীকে বললেন যে সন্তান প্রতিপালনের জন্য অর্থের প্রয়োজন। অর্থের সংস্থান না করে একজন ঋষির পক্ষে কি সন্তান পালন করা সম্ভব?
লোপামুদ্রার অকাট্য যুক্তি খণ্ডন করতে না পেরে অগস্ত্য অর্থের সন্ধানে বের হলেন। পরপর তিনি একাধিক রাজার কাছে গেলেন। ঋষির প্রতি আতিথেয়তায় তাঁদের দিক থেকে কোনও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু অর্থ প্রদানে সকলেই তাঁকে নিরাশ করলেন। রাজকোষের ঘাটতি দেখিয়ে সকলেই মহর্ষির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
ঘুরতে ঘুরতে এবার অগস্ত্য উপস্থিত হলেন দৈত্যপুরী মণিমতীপুরে। এখানে বাস করত ইল্বল নামে এক দৈত্য ও তার ভাই বাতাপি। ইল্বল যেমন ধনবান ছিল, তেমন দানধ্যানেও তার সুনাম ছিল। তার কাছে কেউ ধনদৌলত প্রার্থনা করলে খালি হাতে ফিরতে হত না। কিন্তু ব্রাহ্মণদের প্রতি তার অসম্ভব রাগ ছিল। কথিত, কোনও এক সময় এক ব্রাহ্মণ তার কাছে ধনদৌলত প্রার্থনা করেন। ইল্বল তাঁকে যথাযথ আপ্যায়ন করে তাঁর প্রার্থনা পূরণ করে তাঁর কাছে এমন কিছু চায় যা একমাত্র ব্রাহ্মণদেরই দেবার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণ ইল্বলের প্রার্থনা পূরণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। সেই থেকে তার রাজ্যে কোনও ব্রাহ্মণ এলে তাঁকে যথাযথ আপ্যায়নের পর মেরে ফেলা হত। আর সেই কাজে বাতাপি তাকে সাহায্য করত। বাতাপি মায়াবলে ছাগরূপ ধারণ করতে পারত। কোনও ব্রাহ্মণ মণিমতীপুরে এলে তাঁকে আপ্যায়ন করার জন্য ইল্বল মায়াবলে ছাগে রূপান্তরিত বাতাপির মাংস রান্না করে ভোজনের আয়োজন করত। ভোজনের পর ব্রাহ্মণ যখন বিশ্রাম করতেন তখন সে মায়াবলে মৃত ছাগকে জীবিত করে ভাইয়ের নাম ধরে আস্তে আস্তে ডাকত। সেই ডাক শুনে বাতাপি ব্রাহ্মণের পেট চিরে বেরিয়ে আসত। ইল্বল এইভাবে ব্রাহ্মণ-সংহার করত। অগস্ত্যর ক্ষেত্রেও ইল্বল একই পথ অনুসরণ করেছিল। কিন্তু অগস্ত্য ছাগ-মাংস হজম করে ফেলায় ইল্বলের ডাকে বাতাপি অগস্ত্যর দেহ চিরে আর বেরিয়ে আসতে পারল না। এতে ইল্বল ভয় পেয়ে গেল। অগস্ত্যকে সন্তুষ্ট করার জন্য সে তখন প্রচুর ধনরত্ন তাঁকে দিল। সেই ধনসম্পদ নিয়ে অগস্ত্য লোপামুদ্রার কাছে ফিরে এলেন এবং একটি পুত্রসন্তান লাভ করলেন। ওঁদের পুত্রের নাম দৃঢ়স্যু।
এ তো গেল পৌরাণিক উপাখ্যান। এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে এই রূপকথার কী সম্পর্ক আছে সেটা খুঁজে দেখাই আমাদের উদ্দেশ্য।
অগস্ত্য ছিলেন মিত্রাবরুণের পুত্র। কারা এই মিত্রাবরুণ? এরা আর কেউ নয়, এরা হল দুই আদিত্য। সূর্যের যে শক্তি ঋতু পরিবর্তনের কারণ তাকেই বলা হয় আদিত্য। মিত্র হল গ্রীষ্ম ঋতুর আদিত্যের নাম, আর বরুণ হল বর্ষা ঋতুর আদিত্য। এরা যে সময়ে মিলিত হয় সেই সময় এদের বলা হয় মিত্রাবরুণ। তাই মিত্রাবরুণ হল গ্রীষ্মের শেষ এবং বর্ষার শুরুর সন্ধিক্ষণ। এই দিনটি হল ২২ জুন, অর্থাৎ রবির দক্ষিণায়ন শুরুর দিন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে অগস্ত্যের বাস মনুষ্যলোকে নয়, মহাকাশে। দক্ষিণ আকাশের ক্যারিনা (Carina) মণ্ডলে অবস্থিত উজ্জ্বল, স্নিগ্ধ একটি তারার নাম অগস্ত্য। পাশ্চাত্য নাম ক্যানোপাস (Canopus)। এটি মহাকাশে সর্বোজ্জ্বল তারকাদের মধ্যে দ্বিতীয়। অগস্ত্যের খুব কাছেই একটি তারা আছে। এই তারাটিকেই অগস্ত্যের পত্নী লোপামুদ্রা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। ওই একই মণ্ডলে অগস্ত্যের ঠিক পূর্বদিকে এর অবস্থান। লোপামুদ্রা শব্দের অর্থ যিনি স্ত্রীলোকের রূপাভিমান ম্লান বা লুপ্ত করে হর্ষোৎপাদনে সমর্থা। ঔজ্জ্বল্যের বিচারে এটি একটি পঞ্চম মাত্রার তারা অর্থাৎ ম্লান ঔজ্জ্বল্যবিশিষ্ট। সেদিক থেকে এই তারাটির লোপামুদ্রা নামকরণ অযৌক্তিক নয়।
মহাভারতে আছে, বিবাহের পর অগস্ত্য গঙ্গাতীরে এসে অনুকূলা পত্নীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ঘোর তপস্যা শুরু করেন। এখানে গঙ্গা বলতে বোঝানো হয়েছে মহাকাশে উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বরাবর বিস্তৃত ছায়াপথকে (মিল্কি ওয়ে)। ছায়াপথের অনেকগুলি নাম আছে। এর মধ্যে সোমধারা, আকাশগঙ্গা নাম উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীতে বসে আমরা যাকে আকাশগঙ্গা নামে উল্লেখ করি মহাকাশের সাপেক্ষে শুধু গঙ্গা নামই যুক্তিযুক্ত, আকাশ শব্দ তখন নিরর্থক। দক্ষিণ আকাশে মেরু সন্নিহিত অঞ্চলে আকাশগঙ্গার অর্থাৎ ছায়াপথের পার্শ্বভাগে অগস্ত্যের ও লোপামুদ্রার অবস্থান। গঙ্গাতীরে অগস্ত্যের পত্নীর সঙ্গে মিলিত হওয়া উক্তিটি সম্বন্ধে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা অসংগত নয়।
মহাকাশে ইল্বল ও বাতাপির অবস্থান খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে কালপুরুষ নক্ষত্রে। মৃগশিরার শিরে যে পাঁচটি তারা আছে তাদের নিয়েই এই নক্ষত্রের কল্পনা। শিরস্থ এই পঞ্চ তারকাকেই একত্রে বলা হয় ‘ইল্বলা’। এ প্রসঙ্গে অমরকোষে যা বলা হয়েছে তা হল,
মৃগশীর্ষে মৃগশিরস্তস্মিন্নেবাগ্রহায়ণী।
ইল্বলাস্তচ্ছিরোদেশে তারকা নিবসন্তি যাঃ।।
কালপুরুষের কটিস্থিত এই পাঁচটি তারার মধ্যে ৩টি বড়ো ও ২টি ছোটো।
এবারে আসি বাতাপির কথায়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কালপুরুষকে মৃগ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। স্বয়ং প্রজাপতি ‘ঋশ্য’ নামে যে ছাগরূপ ধারণ করেছিলেন তাই হল এই মৃগ বা কালপুরুষ নক্ষত্র।
প্রায় ৪২০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে কালপুরুষ নক্ষত্র ছিল মহাবিষুব দিনে। এই সময় ঝড়বৃষ্টির সূচনা। রাত্রি ও দিন থাকে সমান। এর ঠিক পাঁচ মাস পরে শুরু হয় শরৎকাল। সূর্য তখন দক্ষিণায়নের পথে। আর তখনই দক্ষিণ-আকাশে অনেক তারার সঙ্গে উদিত হয় অগস্ত্য তারা। এই সময় রাতের অন্ধকারে দক্ষিণ আকাশে কালপুরুষ মণ্ডলও উদয় হয়। তাই পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে ইল্বল, বাতাপি ও অগস্ত্যর একসাথে অবস্থান অবান্তর নয়। এছাড়াও এই সময় মধ্যপ্রদেশ অর্থাৎ বিদর্ভ থেকে অগস্ত্য ও লোপামুদ্রা তারাদ্বয়কে পরিষ্কার দেখা যায়। মনে হয়, পৌরাণিক উপাখ্যানে বিদর্ভরাজকন্যা লোপামুদ্রার সঙ্গে অগস্ত্যের পরিণয়ের কাহিনির উৎপত্তি এখান থেকেই।
শরৎ ঋতুর আগমনের ফলে বর্ষার বিদায় অর্থাৎ অগস্ত্যের আবির্ভাবের সাথে সাথে ঝড়, ঝঞ্ঝা বা বাত্যার অবসান। ঋগ্বেদে ‘বাত’ কথার অর্থ ‘ঘূর্ণিঝড়’। সুতরাং অগস্ত্যের ‘বাতাপি বধ’ কাহিনির ভিতর দিয়ে প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিদরা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে অগস্ত্যের উদয়ের সাথে বর্ষাকাল শেষ। তাই অগস্ত্য তারাকে ঋতু নির্দেশক তারা বললে অত্যুক্তি হবে না।
রূপক আকারে লেখা হলেও মহাকাশ উপাখ্যানে পুরাণের এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই আশ্চর্য সমন্বয় প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিদদের উন্নত চিন্তার সাক্ষ্য বহন করে। তারা যে উচ্চমানের কাহিনিকার ছিলেন তার প্রমাণ হল এইসব নাক্ষত্রিক কাহিনিগুলি, যেগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বাস্তব ঘটনাবলী থেকে কল্পিত ও সুবিন্যস্ত। তাই বলা যায়, পুরাণে বর্ণিত উপাখ্যানগুলি আদৌ কোনও আষাঢ়ে গল্প নয়, এগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে কাহিনির উপস্থাপনা।
তথ্যসূত্রঃ
- প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান, অরূপরতন ভট্টাচার্য; কলিকাতা বিশ্বিবিদ্যালয়, ১৯৭৫।
- আকাশ ও পৃথিবী, শ্রী মৃত্যুঞ্জয় প্রসাদ গুহ; ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেদ পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিঃ।
- পৌরাণিক উপাখ্যান, যোগেশচন্দ্র রায়; কলিকাতা, ১৩৬১।
- ঋগ্বেদ-সঙ্ঘিতা, রমেশচন্দ্র দত্ত; কলিকাতা, ১২৯২।
- হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যা, সুকুমাররঞ্জন দাশ বিস্ববিদ্যাসংগ্রহ; কলিকাতা, ১৩৫৩।
ক্রমশ