মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
মহাবিশ্ব সৃষ্টির গোড়ার কথা
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
মানুষের জ্ঞানের উন্মেষের কাল থেকে মহাবিশ্ব ও তার উৎপত্তি নিয়ে জিজ্ঞাসার অন্ত নেই। প্রথম দিকে মানুষ এই সব জিজ্ঞাসার সম্ভাব্য উত্তর খুঁজেছে দর্শনের সাহায্যে যা লিপিবদ্ধ আছে পুরাণের বিভিন্ন গ্রন্থে। পৌরাণিক ধারণা অনুযায়ী মহাবিশ্ব তথা ব্রহ্মাণ্ড যা কিছু সবই প্রজাপতি ব্রহ্মার সৃষ্টি। প্রজাপতির সৃষ্টি আপনা থেকেই। তাঁকে কেউ সৃষ্টি করেনি। তাই তাঁর আর এক নাম ‘সয়ম্ভূ’।
গ্রিক পুরাণ মতে, অন্ধকার থেকে ক্যায়োস দেবতার জন্ম। তাঁর কন্যা ইউরিনোমে জন্মের পর দেখলেন আকাশ ও সমুদ্র একত্রে থাকায় তাঁর থাকার মতো কোনো জায়গা নেই। তাই তিনি তখন আকাশকে সমুদ্র থেকে পৃথক করলেন। এরপরে তিনি সমুদ্রের তরঙ্গের উপর নৃত্য করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে ক্যায়োস ও অন্ধকার মিলে সৃষ্টি করল রাত্রি দিন ও বাতাস। এরপরে ইউরিনোমে যখন নাচতে নাচতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলেন তখন তাঁর পিছু নিল বাতাস। বাতাসের দূরন্ত গতি তাঁর নৃত্যের ছন্দপতন ঘটাচ্ছিল। তাই তিনি বাতাসের গতিকে নির্ধারণ করে দিলেন। এরপরে তিনি অগ্রসর হলেন উত্তরের দিকে। সেখানে তাঁর দেখা হল ক্যায়োস থেকে উৎপন্ন ওফিয়োন নামের এক বিশাল সাপের সঙ্গে। ইউরিনোমেকে ওফিয়োনের ভালো লেগে যায়। সে তার কুণ্ডলী দিয়ে ইউরিনোমেকে আকর্ষণ করে। এরপরে ইউরিনোমে ঘুঘুর রূপ ধরে ডিম প্রসব করলে ওফিয়োন সাতটি পাকে কুণ্ডলি তৈরি করে উক্ত ডিমকে তা দিতে থাকেন। অবশেষে এই ডিম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হল মহাবিশ্ব।
এ তো গেল পুরাণের কথা।। এবারে দেখা যাক, এই মহাবিশ্ব বা ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি রহস্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? প্রাচীনকাল থেকেই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য খুঁজে পেতে বিজ্ঞানীদের চিন্তার শেষ ছিল না। বর্তমানে আমাদের সমস্ত ভাবনা বিগ ব্যাং-কে ঘিরে। এই তত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরা মনে করেন, এখন আমরা মহাকাশে তাকালে যা দেখতে পাই এক সময় এ সব কিছুই ছিল না। চারিদিকে ছিল শুধু অন্ধকার, আর ছিল এক জমাট বাঁধা শক্তি। যার আকৃতি কণার মতো, আর আয়তন শূন্য। ‘শূন্য’ মানে কিছুই না। আশ্চর্যের কথা, এই শূন্য থেকেই জন্ম হয়েছিল মহাবিশ্বের। শূন্য আয়তনের এই অতি ক্ষুদ্র কণা বা বীজের মধ্যেই ছিল ছিল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির যাবতীয় উপাদান। আর ছিল অকল্পনীয় উত্তাপ। এই কণা বা বীজকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘মহাডিম্ব’ বা ‘কসমিক এগ’। এই মহাডিম্বের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছিল, এত শক্তি কোথা থেকে এসেছিল এবং তা এক জায়গায় জড়োই বা হল কেন, এ সব প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর এখনও পর্যন্ত আমাদের জানা নেই।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাশূন্যে ঘটেছিল এক মহাবিস্ফোরণ। মহাডিম্বের এই বিস্ফোরণ থেকেই শুরু হয়েছিল মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়া। এই বিস্ফোরণকেই বলা হয় ‘বিগ ব্যাং’।
ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির এই তত্ত্বটির প্রবর্তক বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো। অধিকাংশ বিজ্ঞানী এই তত্ত্বটি মেনে নিলেও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। যাই হোক, বিশ্বসৃষ্টির মুহূর্তে আদি বিস্ফোরণের এক সেকেন্ডের ১০০ ভাগ সময় পার হলে উষ্ণতা হয়েছিল কয়েক হাজার কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই উষ্ণতায় কোনো পদার্থের অস্তিত্ব অসম্ভব, কেন-না এই অবস্থায় কোনো পরমাণু কেন্দ্রীণ সৃষ্টি হতে পারে না। অর্থাৎ নিউট্রন ও প্রোটন একসঙ্গে জমাট বেঁধে থাকা সম্ভব নয়। মিনিট তিনেক পরে যখন উষ্ণতা নেমে দাঁড়াল ১০০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তখন প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে তৈরি হল পরমাণুর কেন্দ্রীণ। এর পরে ইলেকট্রন বাঁধা পড়ে প্রথমে তৈরি হল হাইড্রোজেন পরমাণু। পরে হিলিয়াম, লিথিয়াম ও অন্যান্য হাল্কা মৌলিক পদার্থের পরমাণু। উষ্ণতা আরও কমলে তৈরি হয় ভারী মৌলিক পদার্থের পরমাণু। তবে এরা সবাই তখন গ্যাসীয় অবস্থায় ছিল। মহাবিশ্ব আরও ঠাণ্ডা হলে এই ভারী মৌলিক পদার্থগুলি এক জায়গায় জড়ো হয়ে কঠিন বস্তুর ধুলোকণা তৈরি করে। এইভাবে তৈরি হয় গ্যাস ও ধুলোর মেঘ। আকাশে যেমন মেঘ ভেসে বেড়ায়, এরাও সেইরকম ভেসে বেড়াতে লাগল মহাকাশে। ধীরে ধীরে এদের মধ্যে শুরু হল ঘূর্ণন। কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দৈর্ঘ্যের এই গ্যাসীয় মেঘমালাগুলি নিজের নিজের অক্ষের চারপাশে ঘুরতে শুরু করল। সেই সঙ্গে বেড়ে চলল এদের আয়তন ও ঘনত্ব। এইভাবেই সৃষ্টি হল নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রমণ্ডল ইত্যাদি।
অনেকে মনে করেন মহাবিশ্বের সৃষ্টি লগ্নে বস্তুকণা (matter) ও বিপরীত কণা (anti-matter) একই সঙ্গে সমান সংখ্যায় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তারা পাশাপাশি থাকতে পারেনি। একে অপরের থেকে দূরে সরে গিয়ে দুটি পৃথক অঞ্চলে জড়ো হয়েছিল। এই দুটি অঞ্চলের মধ্যে ব্যবধান এতটাই বেশি যে পরস্পর সঙ্ঘর্ষের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমরা বাস করি বস্তুকণা দিয়ে গঠিত মহাবিশ্বে।
মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে বিগ ব্যাং তত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁদের মতে মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটা ভীষণ ঘন ও উষ্ণ দশা থেকে। সেই সময় থেকেই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হয়ে চলেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে এক ধরনের রহস্যময় স্ব-বিকর্ষীয় শক্তি, যার নাম অদৃশ্য শক্তি (Dark Energy)। এই শক্তিই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কারণ। এখন প্রশ্ন হল, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ কি অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে? কোনো বিজ্ঞানীর মতে মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে হতে এক সময় থেমে যাবে। এই অবস্থায় মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকবে। এর পরেই শুরু হবে সঙ্কোচন, অর্থাৎ মহাবিশ্বের আয়তন আবার কমতে শুরু করবে। এই সময় কোনো বুদ্ধিমান জীবের বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। এই অবস্থাকে বলা হয়েছে ‘বিগ ক্রাঞ্চ’ (Big crunch)।
মহাবিশ্ব দেখতে কেমন? গোল না কাগজের পৃষ্ঠার মতো? এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা বিতর্ক চলছে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত মার্কিন গবেষক জেফ উইকসের গবেষণা পত্রের উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে মহাবিশ্বের আকৃতি অনেকটা পঞ্চভুজের মতো। তবে তার হাতগুলো বাঁকানো। এর পারিভাষিক নাম ‘ডুডেকাহেড্রাল’। বিগ ব্যাং-এর পরে যে সব অতিহ্রস্ব তরঙ্গ মহাবিশ্বে রয়ে গেছে, কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে ওই রশ্মি বিশ্লেষণ করে যে মানচিত্র পাওয়া গেছে তা থেকেই ওই পঞ্চভুজের ধারণা করেছেন মার্কিন বিজ্ঞানী জেফ।
তথ্য সূত্রঃ
- The Universe – Iain Nicolson, 1996 Horus Editions.
- The Rough Guid to the Universe – John Scalzi, 2003 Rough Guides Ltd.
- Website https://www.space.com › 13352-universe-history-future-cosmos-special-re… https://www.scientificamerican.com › article › the-evolution-of-the-universe