এদেশে আদা ব্যবহার করেন না এমন কোন পরিবারই নেই। আদার সর্বত্র অবাধ গতি। শীতের সকালে চায়ে আদার রস না মেশালে ঠিক জমে না। গ্রামাঞ্চলে নবজাতকের মুখে মধু দেওয়ার রীতি। এর পরই যে মিশ্রণটির স্বাদ পায় সে সেটি হচ্ছে আদা-মধু-তুলসিপাতার। আধুনিক কালে শত শত জীবনদায়ী ওষুধ আবিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও আজও মায়েরা উপরোক্ত ভেষজ মিশ্রণের উপর বেশি ভরসা করেন। তবে ঠাণ্ডা লাগলে অথবা সর্দিকাশি,গলা খুস খুস এই জাতীয় উপসর্গে এক চামচ আদা-মধু -তুলসিপাতার রস আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই আজও ব্যবহার করেন এবং শত শত বছর ধরে সাধারণ মানুষ তা করে চলেছেন। তাই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে আদার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিশ্বভেষজ’ বা ‘বিশ্বঔষধি’। সার্থক এই নাম।
বড়ো দিদির সঙ্গে আমার বয়সের অনেক তফাৎ। বড়ো জামাইবাবু আমার পিতৃতুল্য। ওঁর ছেলেবেলার গল্প শুনতে বড়োই পছন্দ করতাম। উনি যখন স্কুলে পড়তেন,সেই সময় গ্রামাঞ্চলে ভোজ কাজ (বিয়ে,পৈতে ইত্যাদির জন্য) সারাবছরে দু’একবার হত। বর্তমানকালের মত বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি গ্রামাঞ্চলে একেবারেই অমিল ছিল বললেই চলে। তাই অল্পবয়সীদের কাছে কোন ভোজ কাজের আকর্ষণ যে কী ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিকেল হতে না হতেই খিদে বাড়ানোর জন্য আদা ব্যবহার করা হত। ভোজবাড়িতে মাংস,রসগোল্লা এবং বোঁদে খাওয়ার কম্পিটিশন তা না হলে কীভাবে করা হবে!!
আদা গাছ একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই গাছটি তিন ফুটের মত লম্বা হয়। কাণ্ড থেকে মাটির নীচে আনুভূমিক তল বরাবর শিকড়ের মত লম্বা লম্বা রাইজোম বের হয়। এই রাইজোমগুলি(ভূমিনিম্নস্থ উদ্গত কাণ্ড) আমরা আদা হিসাবে ব্যবহার করি। সরু লম্বা কাণ্ডের দুই পাশ থেকে সবুজ পাতা বের হয় যা ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি লম্বা। একটি পাতার ঠিক ওপরদিকে সামান্য উপরে আর একটি পাতা বের হয়। পাতার গোড়ার দিকের অংশ কাণ্ডকে বেষ্টন করে থাকে। ফুলগুলি শঙ্কুর আকারে স্তরে স্তরে সজ্জিত থাকে যা ২ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা। ফুলগুলি ছোটো আকারের এবং সবুজ-হলুদ বর্ণের পাপড়িযুক্ত।
ভারতবর্ষ এবং চীনদেশে বিগত ২৫০০ বছর ধরে ঔষধি হিসাবে আদার ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাচীন ভেষজ পুস্তক এবং পুঁথিতে এর উল্লেখ রয়েছে। মাথা ধরা,গা-বমি,ঠাণ্ডা লাগা,রিউম্যাটিজম,ক্ষুধামান্দ্য,গ্যাস,শরীরে মোচড় দেওয়া,পেট খারাপ সহ অন্যান্য পেটের অসুখের প্রতিকারে আদা ব্যবহার করা হয়েছে। আয়ুর্বেদশাস্ত্রের বিভিন্ন ওষুধ তৈয়ারীতে আদা ব্যবহৃত হয়। খৃস্টজন্মের প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে চীনদেশের খ্যাতনামা দার্শনিক কনফুসিয়াস লিখেছেন যে তিনি কখনও আদা ছাড়া খেতে বসতেন না।
ঔষধি ছাড়া সারা পৃথিবীতে খাবারের স্বাদ ও গন্ধের জন্য আদা ব্যবহৃত হয়। আদাউৎপাদনকারীদের মধ্যে ভারতবর্ষের স্থান সবচেয়ে উপরে। ভারতবর্ষ ছাড়া আরও অনেক দেশে আদার চাষ হয় যেমন চীন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ সমূহ,মেক্সিকো,ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
এদেশে কয়েক ধরণের (ভ্যারাইটি) আদার চাষ করা হয়। এদের মধ্যে কোচিন, কালিকট,কোলকাতা উল্লেখযোগ্য। কোলকাতা ভ্যারাইটির আদা ছাই ছাই বাদামী থেকে নীলচে বাদামীবর্ণের। অপরদিকে কোচিনের রং হলদেটে বা হাল্কা বাদামী। কালিকট আদার বর্ণ কমলা বা লালচে বাদামী।
আদা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Zingiber officinale । মজার কথা জিঞ্জিবার (Zingiber) কথাটি এসেছে সংস্কৃত থেকে যার অর্থ ‘শিং’-এর ন্যায়।
বিজ্ঞানীরা আদার মধ্যে এক ধরণের উৎসেচকের উপস্থিতি লক্ষ করেছেন। প্রোটিনভঙ্গকারী এই উৎসেচকের নাম দিয়েছেন জিঞ্জিবেন বা জিঞ্জিপেন। এই উৎসেচকের সংস্পর্শে দুধ কেটে যায়। পেঁপের উৎসেচক প্যাপেনের মত এই উৎসেচক মাংসের তন্তুকে নরম করে দেয়।
আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা আদার অশেষ গুণকীর্তন করেছেন। এর কয়েকটি হচ্ছে
- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক বৃদ্ধি প্রতিরোধী
- যকৃৎ-কে রক্ষা করে
- হজমশক্তি বৃদ্ধিকারী
- খাদ্য শোষণে সাহায্য করে
- হৃৎপিণ্ড রক্ষাকারী
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী
- রক্ত সংবহনে সাহায্য করে
- রক্ত তঞ্চনরোধী
- বমনরোধী
- অ্যান্টিসেপ্টিক
- ক্ষুধা বৃদ্ধিকারী
- কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়
- জ্বর কমাতে সাহায্য করে
- ঘর্ম উৎপাদনকারী
- আলসার সৃষ্টিরোধী
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
এবার লিখি আদার সাহায্যে উৎপাদিত খাদ্য,পানীয় ও অন্য পদার্থ -এর নাম
- জিঞ্জার টি
- জিঞ্জার বিয়ার
- জিঞ্জার জ্যাম
- জিঞ্জার কেক
- জিঞ্জার কুকিস
- জিঞ্জার বিস্কুট
- জিঞ্জার সস
- জিঞ্জার পাউডার
- জিঞ্জার পেস্ট
- জিঞ্জার ক্যান্ডি
- শুকনো আদার লবণাক্ত টুকরো
- শুকনো আদা
আদা সহজেই ছোটো টব বা ট্রেতে চাষ করা যায়। রাইজোমের একটি টুকরো ট্রেতে ১ – ২ইঞ্চি মাটির আস্তরণের উপর রেখে হাল্কা মাটি ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। জল দিয়ে মাটি ভেজানোর প্রয়োজন। আদা গাছ ঘরের মধ্যে অল্প রোদে রাখা সম্ভব।