ফ্লাইং ডাচম্যান
বিরুপাক্ষ
মানুষ ভূতের গল্প তো অনেক শুনেছি। জাহাজ ভূতের গল্প শুনলে কেমন হয়? সত্যিসত্যিই কিন্তু একটা জাহাজ ভূত আছে। তাকে নিয়ে অনেক গল্পকথা, অনেক লোকশ্রূতি, এবং বিশ শতকে এসে সিনেমাটিনেমাও তৈরি হয়েছে। তার নাম দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান। এবারে ভূতের আড্ডায় সেই উড়ুক্কু ডাচম্যানের কথা। (হল্যান্ডের লোকদের বলা হয় ডাচ।)
আজ থেকে পাঁচ শতাব্দি আগের কথা। সে সময় ইউরোপের লোকজন সব পালতোলা জাহাজে চেপে হইহই করে বেরিয়ে পড়েছে দুনিয়া জয় করবার জন্যে। সেসব জাহাজে ইঞ্জিন নেই। কাঠের তৈরি হালকাপলকা জাহাজ। পালে হাওয়া লাগিয়ে সমুদ্র পেরোয়। পথে ঝড় উঠল তো আর রক্ষা নেই।
১৬৪১ সালের কথা। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির একটা জাহাজ দেশে ফিরছিল দূর প্রাচ্যে বাণিজ্য সেরে। দূর প্রাচ্য মশলার জন্য বিখ্যাত। ইউরোপে সে মশলার তখন বেজায় কদর। ও দিয়ে মাংস আর খাবারদাবার বহুদিন টিকিয়ে রাখা যায়। সে’সময় তো আর ফ্রিজ ছিল না!
জাহাজের ক্যাপ্টেন ভ্যান ডের ডেকেনের মন তখন একেবারে ফুরফুরে হয়ে আছে। ব্যাবসাবাণিজ্য খুব ভালো হয়েছে। কোম্পানির লাভ হবে ভালো। তার ওপর এতদিন পরে ফের নিজের দেশে ফিরে যাওয়া! তার আনন্দও কম নয়। জাহাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে তখন আফ্রিকার দক্ষিণতম বিন্দুতে উত্তমাশা অন্তরীপের দিকে। অন্তরীপ ঘুরলেই উত্তরমুখো এগোবে জাহাজ তাঁর স্বদেশের পথে।
উত্তমাশা অন্তরীপ পৌঁছোতে চলেছে সেই আনন্দে সে খানাপিনায় এতই মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল জাহাজিরা যে কেউ খেয়াল করেনি কী ভয়ংকর একটা ঝড় ধেয়ে আসছে জাহাজকে তাক করে। খেয়াল যখন হল তখন দেরি হয়ে গেছে। ভয়ংকর সমুদ্রঝড়ের ধাক্কায় ঢেউ উঠেছে পাহাড়প্রমাণ। তীব্র হাওয়ার ধাক্কায় মাস্তুল ভেঙে পড়বার জো হয়েছে।
গেল গেল রব উঠল জাহাজ জুড়ে। ক্যাপ্টেন ছুটে বের হয়ে গিয়ে দাঁড়াল জাহাজের চাকা ধরে। সবাই তখন ভাবছে এইবার ক্যাপ্টেন জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে ঝড়ের এলাকা থেকে দূরে পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করবে বুঝি। যদি তাতে প্রাণটা বাঁচে। কিন্তু ও হরি, দেখা গেল ক্যাপ্টেন সে পথে যেতে মোটেই রাজি নয়। নেশা লেগে গেছে তখন তার। ফুলে ওঠা সমুদ্রের তাথৈ তাথৈ নাচ দেখে ভয় পাবার বদলে নাকের পাটা ফুলিয়ে চোখ লাল করে সে চিৎকার জুড়েছে,”ওরে ব্যাটা সমুদ্র, আমায় ভয় দেখাচ্ছিস? ভেবেছিস লেজ গুটিয়ে পালাব তোর ঢেউ আর হাওয়া দেখে। ভ্যান ডের ডেকেন ওতে ভয় পায় না। আজ তোর সঙ্গে আমার যুদ্ধ। দেখ তোর কী হাল করি।”
সমুদ্র জবাবে আরো বড়ো বড়ো ঢেউ ছুঁড়ে মারতে লাগল জাহাজের গায়ে। মোচার খোলার মত তাকে নিয়ে খেলা করতে লাগল তীব্র সমুদ্র হারিকেন। জাহাজের লোকজন বুঝল পাগলের পাল্লায় পড়ে আজ প্রাণ যেতে পারে। অতএব সবাই মিলে যুক্তি করল পাগলা ক্যাপ্টেনকে আটকে রেখে জাহাজ নিয়ে ঝড়ের হাত থেকে পালাবে।
কিন্তু ক্যাপ্টেনের মাথায় তখন ভূত সওয়ার হয়েছে। জাহাজের লোকজন যখন তাকে ধরতে এল তখন বিনাবাক্যব্যয়ে সে কোমর থেকে পিস্তল টেনে নিয়ে এক গুলিতেই শেষ করে দিল বিদ্রোহীদের নেতাকে। তারপর অসুরের শক্তিতে তাকে ছুঁড়ে ফেলল ফুটন্ত সমুদ্রর বুকে। ঝড়ের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠছে তখন তার অট্টহাসির শব্দ।
মৃত নাবিকের শরীরটা জল ছুঁতেই একটা অদ্ভুত ব্যাআর ঘটল। ডেকের ওপর কোথা থেকে আবির্ভূত হল একটা ছায়ার মত মূর্তি। তার চোখমুখ সবই ঘন অন্ধকারে ঢাকা। ক্যাপ্টেনের দিকে আঙুল তুলে সে বলল, “গোঁয়ার্তুমি কোরো না। যদি শান্তিতে জাহাজ বাইতে চাও তাহলে-”
জাহাজের বাকি লোকেরা তখন ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। পাগল ক্যাপ্টেনের অবশ্য বিশেষ হেলদোল হল না। সদ্য একবিদ্রোহীকে মেরে তার তখন রক্তে যুদ্ধের উন্মাদনা আরো বেরে গেছে। খলখল করে হেসে সে বলল, “কে বলল তোকে আমি শান্তিতে জাহাজ বাইতে চাই, অ্যাঁ? আমি লড়ব। তোর সমুদ্রের সাথে, তার ঝড়ের সাথে, গোটা দুনিয়ার সাথে। যে আমায় বাধা দেবে তাকে এইপিস্তলের মুখে উড়িয়ে দেব। ভালো চাস তো যে নরক থেকে এসেছিস সেইখানেই ফিরে যা শয়তানের দূত।
বলতেবলতেই হাতের পিস্তলটা ছায়ামূর্তির দিকে তাক করে তার ঘোড়া টিপে দিয়েছে সে। এবারে কিন্তু আর গুলি বের হল না তা থেকে। দূরে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা নাবিকেরা দেখল, ক্যাপ্টেনের হাতেই বিকট শব্দ করে ফেটে গেল তার পিস্তল।
ছায়ামূর্তি একচুলও নড়ল না তার জায়গা থেকে। এইবার যখন সে কথা বলল, তখন তার গলায় যেন প্রলয়ের মেঘের গুরুগুরু শব্দ—“ঔদ্ধ্বত্বের শাস্তি তুমি পাবে তুচ্ছ মানুষ। এই জাহাজ আর তার প্রেত নাবিকদের নিয়ে অনন্তকাল ধরে তুমি ঝড়ের সমুদ্রে ভেসে চলবে। এক মুহূর্তের শান্তি জুটবে না তোমার কপালে। একদিনের জন্যও তোমার জাহাজ ভিড়বে না মাটির পৃথিবীর কোন বন্দরে। সমুদ্রে ভাসমান সমস্ত জাহাজের চোখে তুমি হবে সাক্ষাত মৃত্যুর দূত। যে তোমায় নিজের চোখে দেখবে সমুদ্রের বুকেই তার চিরশয্যা পাতা হবে।”
ক্যাপ্টেনের তখন বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে। উদ্দাম ঝড়ের ধাক্কায় প্রলয়নাচন নাচতে থাকা সমুদ্রের বুকে দুলন্ত জাহাজের বুকে তখন তাকে ঘিরে একে একে লুটিয়ে পড়ছে তার সমস্ত মানুষ সঙ্গীর দল। ঘনঘন বিদ্যুতের আঘাত নেমে আসছে তাকে ঘিরে মেঘের বুক থেকে। সেই আলোতে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলোর দিকে দেখতে দেখতে হঠাৎ খলখল করে হেসে উঠল ক্যাপ্টেন। তারপর আকাশের দিকে দুহাত তুলে চিৎকার করে উঠল, “আমেন।”(খৃস্টানরা তাদের প্রার্থনায় এই শব্দটা বলে। ওর মানে , “তবে তাই হোক হে ঈশ্বর।”)
তারপর সেই ঝড়ের সমুদ্রের অন্ধকারে তার অভিশপ্ত জাহাজকে নিয়ে মিলিয়ে গেল সে। একা।
শতাব্দির পর শতাব্দি কেটে গেছে তার পরে। সভ্যতা বদলেছে। পালের জাহাজের জায়গা নিয়েছে বাষ্পীয় পোত। তারপর আরও আধুনিক জাহাজের দল এসে বাষ্পীয় পোতদেরও ইতিহাসের পাতায় ঠেলে দিয়েছে। তবু সব যুগেই কোনো না কোন জাহাজ হঠাৎ হঠাৎ করেই মাঝসমুদ্রে দেখা পেয়ে যায় সেই ডাচ জাহাজের। তুমুল ঝড়ের ধাকায় সে ছুটে চলেছে তার ছেঁড়া পাল, ভাঙা মাস্তুল নিয়ে। তার চকায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকা অভিশপ্ত ক্যাপ্টেন আকাশের দিকে মুখ তুলে আকুল প্রার্থনা করে চলেছেন যেন এইবার তাঁর অভিশাপের শান্তি হয়, যেন এইবার তিনি ফিরতে পারেন কোন শান্তির বন্দরে, আর তাঁকে ঘিরে অজস্র কঙ্কাল নাবিক বারংবার ঝড়ের হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে নতুন নতুন পাল।
সে জাহাজ যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সমুদ্রে প্রাণ দিয়েছেন। সমুদ্রযাত্রী নাবিকদের জনশ্রুতিতে তার নাম দা ফ্লাইং ডাচম্যান। কোন অজানা সমুদ্রে ঝড়ে মুখে অভিশপ্ত ক্যাপ্টেন আজও ভেসে বেড়াচ্ছে হয়ত। প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে পাঁচ শতাব্দি আগে করে ফেলা কোন পাপের।