আগের পর্বে= ভূতের বাড়ি- স্যালি হাউস
ওয়ারেন হেস্টিংস তার স্কুলের মিত্র ও পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ইম্পের সঙ্গে ষড়যণ্ত্র করে মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। সেদিন কলকাতার মানুষ শিউরে বলে উঠেছিল “ওরে বাপরে! সেদিন কোনো কলকাতাবাসি গঙ্গাস্নান করে পাপ না ধুয়ে ফেলে বাড়ি ফেরেনি্।
ব্রহ্মহত্যার পাপ লাগল মহামান্য হেস্টিংসের গায়ে। তাই সে মরে ভূত হয়ে আলিপুর হেস্টিস হাউসে হানা দিল। জাঁদরেল লর্ড কার্জন আর কটন সাহেব কলকাতার ইতিহাস কাঁপা হাতে বিবরণ লিখে গেছেন, যে দুপুর রাতে বাড়ির সংলগ্ন বাগান মথিত করে চার ঘোড়ার গাড়ি চেপে হেস্টিংসের প্রতাত্মা হাজির হতো। এবার সারা বাড়িতে ছোটাছুটি ও উন্মাদ নৃত্য করত সে। একটা বাক্সের সন্ধানে। ১৭৮৭ সালে ৬ই সেপ্টেন্বর ক্যালকাটা গেজেটে জি জি, অর্থাৎ গভর্নর জেনারেল হারানোপ্রাপ্তি কলমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন যে একটা কাঠের হাতবাক্স হারিয়েছেন দলিল, ও দুটি ছবি, কেউ সন্ধান দিলে উপযুক্ত পুরস্কার পুরস্কার পাবে।
মা বলেন খাঁ খাঁ দূপুর, উষা-ভোর, তিন-সন্ধ্যা হ’ল অশরিরী অতৃপ্ত আত্মাদের জেগে ওঠার প্রহর। মা বলেন এই সময়ে মাঠে ঘাটে যেতে নেই, দাওয়ায় চুল খুলে শুতে নেই। শনিবার প্রেতসিদ্ধ বার। নন্দকুমার অভিযুক্ত হয়েছিলেন শনিবারে , কারায় রুদ্ধ হন শনিবারে , এমনকি ফাঁসিও হয় শনিবারে। ভাদ্র মাস সামলে চলো। আজকের পার্ক স্ট্রিট প্রথমে তার নাম ছিল Burial Ground। আমার ভূত দেখার একটা অবিবেচক ক্ষিদে আছে। সেই খেয়ালে কবরখানায় ঘোরাঘুরি করি, ছবি তুলি, কিন্তু অশরীরির সাক্ষাৎ পাইনি তো !
… সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, আকাশ ঘোলাটে, বেশ জোর বাতাসে মস্ত গাছের পাতায় সাঁই সাঁই আওয়াজে অনেক দিনের দীর্ঘশ্বাস যেন গুমরে উঠছে। এক ঝাঁক কাক যেন কাকাদের ডাক দিয়ে দুরের গাছে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। পরক্ষণেই যেন বিছুটির জ্বালায় ছিটকে ডানা মেলল আকাশে। ক্যামেরা উদ্যত করে সেদিকে পা বাড়াই। এই সময় কে আসছে পিছু পিছু একরাশ শুকনো পাতা মাড়িয়ে প্রায় কবর ফুঁড়ে উঠে? এক দীর্ঘকায় পুরুষ।শুকনো গলায় বলি, ‘আপ?
” – ‘জি ইখানেই থাকি। ই কবরখানায় ।” অজানা মানুষটি বলল। তার মুখের দিকে তাকাবো কী, কলজের জোর পাচ্ছিনা। আজ শনিবার, ভাদ্র মাস, তিন সন্ধ্যা সময়, ভূতপ্রেতের মাহেন্দ্র যোগ। ‘একটা বিড়ী হবে?’ বলে সে। লন্বা লোমশ হাত মেলে ধরে। হাতের তালুতেও লোম তার! সিগারেট এগিয়ে ধরি, মুখের পানে তাকাতে সাহস যাচ্ছেনা। “একালের বাবু, তোমার ভূত দেখার শখ। কামেরা হাতে হামেশা দেখতে পাই। কব্বর লিয়া লিখন কাজ, ভাল কথা, আমাগো লিয়ে সুখ-দুখের দুটি কথা লিখবা ?”
আমার পা নড়ছেনা, কথা সরছেনা। আর্তস্বরে বলি, “আপনাকে লিয়ে ?” – এবার অজানা সেই না-মানুষ(?) বলে, ” অ আপনার জাত যাত যাবে তাতে ? আপনার সাহেব ভূতে শখ বেশি বটে। কীই বা লিখবা আমাগো লিয়া, আমাদের নসিব ফতে হয়ে গেছে লবাবের সনে। মুর্শীদাবাদের সিরাজ আইলেন কলাত্তায়, আমার বাবজানরা তার ও নানা আাইল সাথে। মস্ত লড়াই হইল। সাহেব, মেমসাহেব পলাইল ফলতায়। আমাগো ডেরা পড়ল লালদিঘির ধারে হোগলা পাতার ছাওনিতে।” বোঝা গেল এ মুর্শিদাবাদের নবাববাড়ির নাতিপো।
– “কীন্তু খোদাতাল্লা নারাজ, সাহেব সুবারা ফিরি আইল এই শহরে। আমার লোকেরা গায়েব হইয়ে গেলেন। আমি এখন ইখানে। _ আমাগো বাড়ি? সাহেবদের কাগজে লিখেছিল দু কুড়ি এক বছর আগে লাট সাহেবের লগে লাল মুখো সাহেবরা আমাগো বাড়ি টপ কইরা লিয়া গেছে। ফিন একদিন ইখানে আইস, বলব তুমায় পুরানো কব্বরেরকথা।”
আর তাকাইনি ফিরে তার পানে। মা বলতেন পিছনে কে আসছে তার দিকে ফিরে তাকানো অলুক্ষণে কাজ। কবরস্থানের লোহার গেট ক্যাঁচ করে খুলে ছুটে পালিয়ে চলি ফুটপাথ ধরে। কিন্তু শরীরে পেছন থেকে একটা হ্যাঁচকা টান, এবার বাধ্য হয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। বয়স্ক শীর্ণ একটি লোক যেন নিয়মিত Nux Vomica খাওয়া খিটখিটে মেজাজে খেঁকিয়ে বলল, “এত তাড়া কিসে , ভূতে পেয়েছে নাকি ?”
তার ছাতার ব্যাকানো বাট দিয়ে আমার কাঁধ আটকে ধরেছে।…
কয়েকদিন পরে ভূতের নাকি সুরে কথাগুলো সত্যি-মিথ্যা যাচাই করতে ‘দ্য স্টেট্সম্যান’ কাগজের দপ্তরে পুরানো সংবাদের কবর খোঁড়াখুড়ি শুরু করে দিলাম। নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো। দু’কুড়ি এক বছর আগে ১৯১৫ সালের হলদেপানা জীর্ণ কাগজের বান্ডিল নিয়তির টানে যেন ওল্টানো শুরু হল। কয়েকদিন চলল কাগজে চাল বাছবার কাজ। ১৯১৫ সালে ২৪শে অক্টোবরের বিবর্ণ কাগজের পাতা হাতে আসতেই জোর ঘেমে উঠেছি। পেছন থেকে কাঁধের ওপর দিয়ে কে যেন গলা বাড়িয়ে দেখছে কাগজের দিকে। আমি পড়লাম কলকাতায় ক্লাইভ স্ট্রিটে পুরানো রয়েল এক্সচে্ঞ্জের ভিত খনন করতে গিয়ে দু’খানা কুয়ো বেরিয়ে পড়েছে, প্রতিটি কুয়ো প্রায় কুড়ি ফুট গভীর। অনুমানিক প্রায় দেড়শো বছর পুরানো। এইখানে একসময় একটা বস্তি ছিল। পরে রয়েল এক্সচেঞ্জের বাড়িতে হেস্টিংস ও ক্লাইভ মর্যাদাভরে বাস করে গেছেন।
খবরটা পড়তে গিয়ে যেন ঘরে বিদ্যুতের আলো নিভু নিভু, ফ্যানের পাখা থেমে আসছে, ঘরের মানুষগুলো যেন ফটো নেগেটিভ হয়ে যাচ্ছে। খবরে সত্যের সামনে পড়ে এবার প্রায় ছুটে বেড়িয়ে আসি কাগজের দপ্তর থেকে । “একটা বিড়ি হবে ?”- কে যেন কাছ থেকে ডেকে বলে। বহু পুরানো কবরে চাপা থাকা মাটির গন্ধ নাকে এল। ছুটে একটা চলন্ত ট্রামে চেপে বসি। এখন অফিস পাড়া, তবু যেন ভিড়ের মাঝে আমি একা। অতি দীর্ঘ পুরানো কালের ব্যাবধান অতিক্রম করে মুর্শিদাবাদের রাজবাড়ির নাতিপো আমাকে পেতে চাইছে।
(ঋণ স্বীকার : ‘কলকাতা’ – শ্রীপান্থ)
জয়ঢাকি ভূতের আড্ডা