আগের পর্বঃ ব্যাঙ ও লাওস, নেপালি বাদুর
ইথিওপিয়ার সিংহ
অংশুমান দাশ
‘আমরা কিন্তু সিংহ, মানে আমাদের পূর্বপুরুষ সিংহ ছিলেন’ – তিরিংগো আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল। আর বাঁ দিক থেকে আলেমায়ু খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে সেই তথ্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছিল। ওমনি এসে হাজির হল এক থালা গোমাংস – কাঁচা – আর ইথিওপিয়ান সিংহ-এর দল তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এবার গন্তব্য ইথিওপিয়া। আফ্রিকার ম্যাপের উপরে ডানদিকে যে শিং-এর মত জায়গাটা তার কাছাকাছি। কয়েকদিন আদ্দিস আবাবা, আর কয়েকদিন গ্রামেগঞ্জে চাষবাস দেখতে বুঝতে। আফ্রিকায় এই প্রথম এসেছি, অবশ্য ভারতের থেকে খুব তফাত কিছু বুঝছিনা। মানুষ জনের মাথার চুল কোঁকড়া, এছাড়া গায়ের রঙ কিন্তু আমার মত – গড়পড়তা শ্যামলা ভারতীয়। আদ্দিস আবাবা শহরটা একটা মস্ত কন্সট্রাকশন সাইট মনে হচ্ছিল, চতুর্দিকে প্রচুর বহুতল বাড়ি উঠছে, মেট্রো রেল হচ্ছে – সব চীনাদের টাকায়। বুঝলাম – একদিন চীনে নেবে তারে। আমাদের দেশে নেড়ি কুকুর যেরকম ঘুরে বেড়ায় – আদ্দিসে সেরকম নেড়ি গাধা। বস্তির পাশেই বহুতল হোটেল আশ্বস্ত করে যে অনেকটা সময় ধরে এলেও, আসলে বেশি দূর আসিনি।
ইথিওপিয়ার খাবার দাবার বেশ মশলাদার। আর খাবারের অনেকখানি জুড়ে মাংস, নানারকম মাংস। ‘টেফ’ নামের একরকম ছোটদানার শস্যের আটা দিয়ে তৈরি গামছার মাপের সরুচাকলির মত রুটি এদের প্রধান খাদ্য। ‘ইঞ্জেরা’ যার নাম। প্রায় দু ফুট ব্যাস। রাতের বেঁচে যাওয়া বাসি ইঞ্জেরাও দিব্বি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে একটু মাখনে ভেজে সকালে চালিয়ে দেওয়া হয় জলখাবারে। হোটেলে আছি, তাই আন্তর্জাতিক খাবার, পৃথিবীর সব দেশে যেরকম পাওয়া যায়, অতি বিরক্তিকর।
মুক্তি মিলল পরদিন কাকভোরে। বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে চললুম মফস্বল শহরে। যাওয়ার পথে থামা হল বিশ্ববিদ্যালয়ে। গর্বভরে তাঁরা বললেন সব দেশি গরু নাকি তারা বিদেশি করে ফেলবেন, আসবে উন্নত ফসল – ইথিওপিয়ার সবই খারাপ, সব ঝাঁ চকচকে হয়ে যাবে ! তাহলে এই যে আসার পথে গ্রামে সবাই কী চমৎকার ইঞ্জেরা দিয়ে দেশি ঢ্যাঁড়শ ভাজা আর নানারকম ডাল খাওয়ালেন? একটা বিশাল থালায়, আমরা ১০জন দশ দিকে বসে হাতে করে রুটি – থুড়ি ইঞ্জেরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেলুম – সে বুঝি খারাপ?
আর এই যে মহিলারা আমরা খাওয়ার সময় হাততালি দিয়ে গান গাইছিলেন – বুঝি না বুঝি, দিব্বি লাগছিল – এ সব কি বদলে যাবে? কে জানে বাবা – নিজের দেশের সব কিছু আমাদের এত খারাপ লাগে কেন? শুনলাম হাজার হাজার কিলোমিটার জুড়ে বিদেশিরা চাষের জমি কিনে ব্যাবসা শুরু করেছেন। তার মধ্যে সব থেকে বড় জমি একজন ভারতীয়র। তিনি গোলাপ ফুলের চাষ করে ইয়োরোপে রপ্তানি করেন! বোঝো ঠ্যালা! দেশের জমি আলো জল হাওয়া, আর ফসল যাবে বিদেশে, রোজগার করা টাকাও। আর ওই জমিতে যে খাবার হত তার ঘাটতি মিটবে কোথা থেকে?
যাই হোক – বুধ আর শুক্র এদের নিরামিষ। ইঞ্জেরা দিয়ে ঘন ডালের স্যুপ গণহারে খাওয়া হয় সেদিন। অনেক লম্বা সফর করে এসেছি তাই উপরি পাওনা কী-একটা-নাম-ভুলে-গেছি গাছের শিকড় শুকিয়ে সিদ্ধ করা স্যুপ, নাম তার ‘বুল্যা’ – সেটা খেয়ে আমি আরও ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। ভাগ্যিস ছোটবেলায় অরণ্যদেব পড়েছিলাম আর ধারণা ছিল আফ্রিকা আমাকে অবাক করতে পারে – তাই সেই স্যুপ, টক ইঞ্জেরা খেয়ে অবাক হলেও স্তব্ধ হইনি।
তবে পুষিয়ে দিয়েছে হেডলাইটের আলো জ্বেলে নাচ-গান। দেশটা গরিব হলেও গ্রামের মানুষের হৃদয় গরিব নয়। তবে শহরে রোজগারের জন্য আত্মসম্মানবোধের বিসর্জন বিরক্তির উদ্রেক করেছে বটে। সে-কথা অন্য কোথাও হবে।
কফির কথা না বললে ইথিওপিয়ার কথা শেষ হবে না। কফিপানের উৎপত্তি ইথিওপিয়ায়। কালদি নামের এক রাখাল বালক একদিন দ্যাখে কী যেন একটা লাল ফল খেয়ে তার ছাগলের দল মহা উৎসাহে লাফালাফি শুরু করেছে। কালদি নিজেও সেই ফল খেয়ে দ্যাখে এবং তাতে তারও একই অবস্থা হয়। সেই লাল ফলই কফি, তবে আজকের কফি অবধি আসতে তার অনেক সময় লেগেছে।
কফি চাষ, রপ্তানি, গবেষণা ইথিওপিয়ার অর্থনীতির অনেকখানি জুড়ে আছে। তবে এক আপ্যায়নে কফি নিয়ে যা হল, সে আর বলার নয় ! জাপানে যেমন চা-পান সংস্কৃতির অঙ্গ, এখানে কফি। সেদিন ঘুরতে ঘুরতে বেলা দুটো – এক সরকারি অফিসে কফি খেয়ে আমরা যাব লাঞ্চ খেতে। খিদেয় মাথা ঘুরছে – ভাবলুম, এক কাপ কফি বই তো নয় – এক্ষুনি হয়ে যাবে। ও বাবা ! যে ইথিওপিয়ান সহচরী আমাদের সঙ্গে সব দেখাচ্ছিলেন, দিব্বি জিনস-টিনস পরা – কোথা থেকে সাদা ইথিওপিয়ান পোশাক পরে এসে কফি বীজ, মাটির কায়দা করা পুরনো দিনের কেটলি (পরে বুঝেছি সব কেটলিই ওইরকম – নতুন বা পুরনো – নাম জেবেনা), খড়, আগুন এইসব জড় করছে।
হাওয়া ভালো নয়। আমাদের সামনে সে কফি বীজ রোস্ট করল, সেই ধোঁয়ার গন্ধ ঘুরে ঘুরে সবাইকে শোঁকাল, গুঁড়ো করল, কফি ভিজিয়ে বানাল – তারপর ছোট ছোট কাপে আমাদের দিল। সঙ্গে রাশি রাশি ভুট্টার খই। সব মিলিয়ে একঘণ্টা। কফি এখানে চিনি, নুন, মশলাপাতি – সব দিয়ে খায়, রীতিমত রান্না করে। কতরকম যে কফি হয় তা শিখেছি এখানেই – তবে সম্পূর্ণ শিখতে পারিনি- কী কফি খাবে জিজ্ঞেস করলেই আমি আড়চোখে দেখে নিই অন্যেরা কী খাচ্ছে – তারপর বলি – ওই যে ওইটা।
আদ্দিসে ফিরে এসে হোটেলে থাকা, তাই চমক শেষ। বাঙালি খাদ্য-অ্যাডভেঞ্চারের অভাবে ভেঙে পড়ে। তবে একটা ঘটনা না বললেই নয়। দুদিন আমাদের আলোচনা ছিল ইথিওপিয়ার ইউনাইটেড নেশনস-এ। ২০ জনের দল, দুপুরের খাবার ওখানেই। যতগুলি দল এসেছে সকলের আলাদা ও এলাহি খাবার ব্যবস্থা ট্র্যাডিশনাল নয়, আন্তর্জাতিক। ফলে চমক নেই। যা খাবার তার অর্ধেকও খেতে পারলাম না আমরা। চমকটা এল তার পরে। যা যা খেতে পারলাম না, সোজা ডাস্টবিন। আমরা হাঁ হাঁ করে উঠলাম, আরে এতো এঁটো নয়, অন্যদের দিয়ে দাও, না হয়ত রাস্তায় ভিখিরিদের দাও।
না। তা হবার নিয়ম নেই। ইউনাইটেড নেশনস থেকে কোন খাবার বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই। সে কী! আমরা আফ্রিকায় বসে – সামান্য দূরে সোমালিয়া – তবুও তোমরা এরকম ঝুড়ি ঝুড়ি খাবার রোজ ফেলে দেবে?
কী করব? নিয়ম নেই। নিয়ম নেই নিয়ম নেই শুনে শুনে ক্লান্ত আমরা দরখাস্ত করলুম, জমা দিলুম। উচ্চপদস্থ কর্মচারী বললেন, নিয়ম তো নেই, কিন্তু দেখি।
জানি না তারপর কী হয়েছে! আমরা বেশ কিছুদিন ইউনাইটেড নেশনস-এ লেখালেখি ফলোআপের পর ক্ষান্ত দিয়েছি।
দিন ফুরিয়ে আসছে, কলিগের বাড়িতে খাওয়া দাওয়ায় পাওয়া গেল ‘টারটারে’ – মিহি করে বাটা কাঁচা মাংস, তাতে ‘কিবে’ নামের ঘি আর ‘মিটমিটা’ নামের মশলা দেওয়া – মুখে দিলে মিলিয়ে যায়। অনেকটা আমাদের গালউটি কাবাবের কাঁচা ভাই। এটা খেতে হয় সবুজ শাকসবজি সেদ্ধ দিয়ে।
আমাদের চিকেন রোল-এর মত চটজলদি খাবার হল ‘তিবস’। রাস্তায় পাওয়া যায় মোড়ে মোড়ে। ছোট ছোট গরুর মাংসের টুকরো হালকা মাখন-এ সাঁতলানো, একটু পেঁয়াজ, রসুন আর গোলমরিচ দেওয়া – প্রায় আধকাঁচা বলাই ভাল, তাই দুজন মিলে একবার ভাগাভাগি করে খেয়েছি। মন্দ নয়।
তবে একদম কাঁচা মাংস এল ফিরে আসার আগের দিন এক রেস্তরাঁয়। একরাশ আধপাকা-আধকাঁচা তুমুল মশলাদার খাবারের সঙ্গে। ‘আমরা কিন্তু সিংহ’ – তিরিংগো আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল – ‘তাই আমরা কাঁচা খাই – কাঁচাতেই তো আসল স্বাদ’। পিস পিস মাংস, আর ছোট ছোট ছুরি – তুমি ইচ্ছে মত কেটে কেটে খাও। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না।
কিন্তু সিংহরা কিনা মানুষও খায় সেই ভয়ে কাষ্ঠ হাসি হেসে হেসে সেই ঠাণ্ডা ও কাঁচা গোমাংস ভক্ষণ করলাম। তিরিংগোকে বলার সাহস পেলাম না যে এর থেকে কলকাতার বিফভুনায় আমি দিব্বি স্বাদ পাই। খাবার শেষ হল মধু দিয়ে তৈরি তেজ মদিরা দিয়ে, খেতে মিষ্টি হলেও বেশ তেজ।
তারপর সোজা এক উড়ানে কলকাতা। আর কাঁচা নয়, দিব্বি কষা মাংস, ভুনা, কাবাব ও নিহারি খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত।
ছবিঃ কফি বানাবার ছবিঃ লেখক। ইঞ্জেরা, টারটারে আর তিব্স্-এর ছবি ইনটারনেট থেকে সংগৃহীত।
bah,darun,kancha mangso,ore baba.amader kosha e bhalo
LikeLike