আগের পর্বঃ ব্যাঙ ও লাওস
নেপালি বাদুড়
অংশুমান দাশ
স্যার, খাবে?
আমি নিমরাজি হয়ে বললুম – বেশ ।
তাহলে আপনি হোটেলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে আমি গিয়ে সব তৈরি করে রাখছি ।
তারপর আমরা পাঁচজন নামা শুরু করলাম । এই রাস্তা বেয়ে আজ ভোরবেলা উঠে এসেছি, পা আর চলছে না । খিদেয় পেট চুই চুই । নেপাল একটা ছোট্ট দেশ, তবু কী তার ঐশ্বর্য । ওদিকে ওই উঁচু হিমালয় তো এদিকে গণ্ডার ভর্তি তরাই । পশ্চিমদিক শুকনো খটখটে । আমি এসেছি নেপালের শক্তিখোর আর সিধধিতে চাষবাস দেখতে, শিখতে – আর আমি যতটুকু জানি – শেখাতে । পাহাড়ের গায়ে গায়ে মাথায় মাথায় চাষ । হরেক কিসিমের চাষ । যা চাষ করে – তাই খায় । বাজার কোথায় ? অনেক দূরে । সেই ভোরে বেরিয়ে তিন ঘণ্টা ধরে হেঁটে আমরা যতটা রাস্তা এসেছি, তত দূরে । সুতরাং সপ্তাহে একদিন বাজার । যাওয়ার সময় দেখলাম রামবাহাদুর চেপাং বগলে একটি মুরগি নিয়ে চলেছে ।
তিমি কহাঁ জাদে ছউ?
রামবাহাদুর বগলের মুরগি দেখিয়ে বলল – যাই, বাজারে বেচে আসি, পয়সার দরকার ।
মুরগি এদের কাছে এ টি এম -র মত । পয়সা দরকার ? মুরগি বেচ – পয়সা রেডি । আমরা ফিরতে ফিরতে রামবাহাদুর মুরগি বেচে ঘরে ফিরে এল !
গেলে আর এলে – এতটা রাস্তা ? বাপরে !
রামবাহাদুর একগাল হাসে । ওর মেয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করছিল – স্যার, খাবজাআমার উত্তর শুনেই সে দৌড় দিল পাহাড়ি পথে । বাজারের একটি হোটেলে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে । মেয়েটি সেখানে গিয়ে দিয়ে এসেছে – বাদুড় । বাদুড় মারা নিষিদ্ধ । কারণ বাদুড় জঙ্গল বাঁচায়, ফল-পাকুর খেয়ে পটি করলেই সেই বীজ ছড়ায় । আর একটি ভীষণ জরুরি গাছ আছে – নেপালি নাম যার চিউরি – সেই গাছের পরাগমিলনেও বাদুড় বিশেষজ্ঞ । কিন্তু আর কোনও দেশে বাদুড় খাওয়ার সৌভাগ্য হবে না ভেবে আমি নিমরাজি হয়েছি ।
ভাত ডাল আর দুর্দান্ত রাই শাক ভাজা আর সেদ্ধ টমেটো – এই হল মেনু । আর এক্সট্রা সেই বাদুড় । কড়কড়ে করে ভাজা, দিব্বি – কাঁটাছাড়া রুইমাছ, একটু বেশি ভাজা হয়ে গেছে বলে চালিয়ে দেওয়া যায় । এইটুকু মাংস – বেশ মন খারাপ হল রাজি হয়েছি ভেবে । ঠিক করলাম আর কখনও খাব না ।
খেয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধে। যে সরাইখানায় আছি, সেটা একটা পাহাড়ের কোলে, সন্ধ্যে সাতটা বাজতে বাজতে শুনশান । ঘরের কোণে খাবার ঢাকা দেওয়া – ওই ডাল আর ভাত, সঙ্গে তিল আর বাদাম দিয়ে চাটনি । মশা কামড়ায়, লম্বা রাত, তুমুল ঠাণ্ডা । কাল যেতে হবে শহরে । আবার হাঁটা । ডাল ভাত খেয়ে যে নেপালিরা এত হাঁটে কী করে কে জানে । আমরাও তো ডালভাত। তবু বাজার যেতে রিকশা চাপি । হৃষীকেশকে জিজ্ঞেস করতে বলল, কাল শহরে ঘঙ্গি খাওয়াব তোমাকে । সে আবার কী ! নাম শুনেই সন্দেহ ছিল – খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রহস্য অনুসন্ধান করতে করতে বুঝলাম শামুক জাতীয় কিছু একটা। ও তো অনেক খেয়েছি – গুগলি ঝিনুকে ঝালচচ্চরি, ছোটবেলায়। কখন ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি ।
নেপালিদের মধ্যে অনেক প্রাচীন প্রজাতি আছে – যারা পাহাড়ের কোলেপিঠে মানুষ । তাদের খাবারের অনেকটা জুড়ে তাই জংগলের সংগ্রহ করা খাবার । নানারকম আলু – গিঁঠা, ভ্যাকুর । সেদ্ধ করা, ছাল ছাড়ানো আর নুন দিয়ে খাওয়া । কী সহজ জীবন । লঙ্কা নেই, জিরে ভাজা নেই – গরগরে করে মশলা আর খাওয়ার পর বদহজম হজমিগুলি জেলুসিল নেই । থারু এমনি একটি প্রজাতি । বাদুড় চেপাং প্রজাতির খাবার । থারুদের এস্পেশাল খাবার ঘঙ্গি । তিল দিয়ে গুগলি – আরও সহজ করে বললে তিলের স্যুপে খোলাসুদ্ধ গুগলি । মুখ লাগিয়ে সুড়ুত সুড়ুত করে টেনে খেতে হয় । কখনও গুগলি সোজা গলায়, তখন বিষম লেগে অস্থির । কখনও গুগলির খোলা মুখের মধ্যে ঢুকে কড়মড় করে দাঁতে – সে এক নাজেহাল অবস্থা । ফুলটস বিমার বাউন্সার গুগলি সব মিলিয়ে এ একেবারে রীতিমত গুগলির প্রতিশোধ । আমার বেজার মুখ দেখে হৃষীকেশ বলল – তুমি তাহলে ওয়াচিপা খাও। নেপালিরা চাপাচাপির পাত্র নয় – গুগলিতে বোল্ড হওয়ার পরে মিহি গলায় জিজ্ঞেস করলাম ওয়াচিপায় ছুপা রুস্তমটি কি ?
চিকেন ।
চিকেন ? কিচেনের একমেবাদ্বিতীয়ম চিকেন ? আশ্বস্ত হলুম । কিন্তু তেতো কেন ? ভাতের মধ্যে চিকেনের কুচি – ভুল করে করলা দিয়ে ফেলেছে নাকি ? একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি – আবার ভাবলাম খাবার নিয়ে এত বাছবিচার ঠিক নয়, সবাই যখন খাচ্ছে সোনামুখ করে আমিও হাসি মুখে ফাঁসি যাই । পরে জানা গেল – ওই তিতকুটে স্বাদের কারণ । মুরগির পালক পুড়িয়ে গুঁড়ো করে মেশান হয়েছে মশলার সাথে – আর ওইটাই এই রান্নার স্পেশালিটি । আমার কাছে ভাগ্যিস তখন নিজের মুখ দেখে নেওয়ার আয়না ছিল না !
এরপর যতদিন শক্তিখোরে ছিলাম আর বাহাদুরির চেষ্টা করিনি । বুঝেছি বাহাদুরদের দেশে বাহাদুরি না দেখানই ভালো । জংলি আলুসেদ্ধ, ডাল, ভাত, রাইশাক, বিনের তরকারি আর মাঝে মাঝে ছাল- চামড়া শুদ্ধ চিকেন – এর উপরেই দিন গুজরান করছিলাম । সকালে সরাইখানায় পেতাম সাহেবি খানা। প্যান কেক আর মধু – একবারে চাক ভেঙে আনা মধু । রাত্রে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ‘গোর্খা’ নামের এক নেপালি মদিরা, খেলেই গা বেয়ে টসটস করে ঘাম ঝরত।
কিন্তু কাঠমান্ডু এসেই আমার ভিতরের লড়াকু বাঙালি আবার জেগে উঠল। কী, একবার ঘঙ্গি খেয়ে আমি হাল ছেড়ে দেব ? আমি না নেতাজির শহরের ছেলে ? এবার হানা নেওয়ারি খাবারের দোকানে। নেওয়ারি আর এক ধরণের স্বদেশী খাবারের ঘরানা । নেওয়ারিতে নেওয়া গেল পুকালা আর ছেওলা । পুকালা হল মোষের মাংস – কিন্তু নিছক মাংস নয় – আস্ত জীবনবিজ্ঞানের পাঠক্রম।
পা ঘাড় পাঁজরা নয় – অন্ত্র, লিভার, অগ্নাশয়, প্লীহা, কিডনি – এইসব নানা অংশ সেদ্ধ করে ভাজা । আর খাওয়ার সময় বেচারা মোষের কোনটা কোন অংশ সেটা আবিষ্কার করা বেশ একটা মজার খেলা দেখা গেল নেপালি খাদ্যরসিকদের মধ্যে। আমি তো নেপাল থেকেই জীবনবিজ্ঞান শিখে ফিরলাম ।
সেদিনের দ্বিতীয় এক্সপেরিমেন্ট ছেওলা হল মোষের মাংস গ্রিল করা, আর সেটা চিঁড়ে দিয়ে খেতে হয় – হ্যাঁ, ছিঁড়ে ছিঁড়ে । সাঙ্ঘাতিক ছিঁড়ে ছিঁড়ে । শরীরতত্ত্বের পর সেদিন শিখলাম – চিবোতে কোন কোন পেশী লাগে আর কোন দাঁতের কী কাজ ! তবে খেতে শারীরিক পরিশ্রম হলেও, স্বাদে ছেওলা বেশ ঝাল ঝাল সুস্বাদু ।
নেপালের শেষ সন্ধ্যায় সে যাত্রা বন্ধুর বাড়ির নেমন্তন্ন, চায়ের । কানাঘুষো শোনা গেল – সেখানে হবে তিব্বতি আপ্যায়ন । যদিও হযবরল-তে আছে, রানাঘাটের পরেই তিব্বত, তবুও আমার তিব্বত যাওয়া হয়নি । তবু তিব্বতি চা-পানের আশায় মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। তার মধ্যে কাল বাড়ি ফেরা যাবে, খাওয়া যাবে আলুপোস্ত সেটাও খুশি খুশি ভাবের একটা কারণ । তবুও ওই যে বলেছিলাম, এত ছোট্ট একটা দেশ তবু আবাক করতে ছাড়ে না । শেষ সন্ধ্যায় খেলুম তিব্বতি মাখন চা । তিব্বতের পেমাগুল থেকে আসা চা ফুটিয়ে ফুটিয়ে তাতে ইয়াকের দুধ আর মাখন মিশিয়ে তৈরি হয় এই সাঙ্ঘাতিক চা। সেই চা খেয়ে সেই যে আমি দৌড় দিলাম, থামলাম এসে এই মানিকতলার মোড়ে ।
Bah bah darun laglo
LikeLike