আগের পর্বঃ ব্যাঙ ও লাওস, নেপালি বাদুর, ইথিওপিয়ার সিংহ, পাহাড়িয়া খাবারদাবার, সাদা চামড়ার লেহ্যপেয়, পাশের বাড়ি বাংলাদেশে
কিরঘিজস্তানের ঘোড়া
অংশুমান দাশ
“কী স্তান?” নিজের অজ্ঞতায় নিজেই অবাক হই।
“কিরঘিজস্তান।”
“ও বাবা, ওখানে তো টপাটপ বোম পড়ে।”
“কই, না তো!”
“তাহলে নিশ্চয়ই তেল পাওয়া যায়। বালির দেশ, শেখ বেদুইন হা-রে-রে-রে-রে।”
গুগল আমাকে গুলিয়ে দেওয়ার হাত থেকে বাঁচায়।
“আরে, ঘোড়া পাওয়া যায়, ঘোড়া। এই তো পাকিস্তান, আফঘানিস্তান, তাজাকিস্তান, বেলুচিস্তান, কিরঘিজস্তান।”
“ও তাই বল, বেশি দূরে নয়। রাশিয়ার গায়ে। তাহলে তো ঘোড়া পাওয়া যাবেই। সেই যে,
সিভকা বুরকা জাদু কা লড়কা
চেকনাই ঘোড়া সামনে এসে দাঁড়া।
তারপরেই সেই ঘোড়ায় চড়ে তিনতলার জানালায় ফরসা লাল গাল নরুন চোখ রাজকন্যার আঙুলে সোনার আংটি পরিয়ে দিলেই ব্যস।”
“ঘোড়া চড়ে যেতেও হবে, আর খাবার বলতেও ওই ঘোড়া।”
“ঘোড়া? মানে, ঘোড়ার খাবার? মানে, ছোলা খেয়ে থাকতে হবে?”
“না না, ঘোড়া খেয়ে, ঘোড়ার মাংস।”
এইবার আমি ভিরমি খাই। কিন্তু সে তো বেজায় শক্ত হবে। এত বড়ো, এই রকম হি-ম্যানের মতো মাসল। এমন একটা চমৎকার প্রাণী, তার প্রাণই খেয়ে ফেলতে হবে? কী আর করা? পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে বলে বিমানে চড়ে বসি। মোগলরা সত্যিই ওইদিক থেকেই এসেছিল বলে শুনেছি। সারা পৃথিবীর পাহাড়ের মানুষজন এসে হাজির হচ্ছেন পাহাড়ি চাষবাস কেমন হয় কেমন হবে সে নিয়ে আলোচনা করতে। আমি যদিও পাহাড়ি নই, তবুও ওই যে চাষ, তাতেই আমার রশিতে টান পড়ল।
দেশটায় নামতে নামতে দেখি চতুর্দিকে পাহাড়–বরফ ঢাকা, শুকনো, গাছপালা নেই। জল নেই, পুকুর নেই। ব্যাটারা খায় কী? চাষ করে কোথায়? থাকে কোথায়? বলতে বলতে বাইরে এসে দাঁড়াই। শনশনে ঠাণ্ডা হাওয়া, বরফ ঢাকা পাহাড়ি বিমানবন্দর। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। শহরের নাম বিস্কেক। বন্দরের নাম মানস। তারপর দেখি রেস্তোরাঁর নাম মানস, বাড়ির নাম মানস, রাস্তার নাম মানস। হিজবিজবিজের কথা মনে পড়ে গেল। মানস এদের জাতীয় হিরো। মানস এদের রক্ষা করেছেন, এখনও করছেন সব বিপদ-আপদ থেকে। আমাদের মহাভারতের মতো মানসের রূপকথা মুখে মুখে গান হয়ে ফেরে, বদলে যায়, নতুন কাহিনি জোড়ে। দেশের ঠিক মাঝখানে মানসের মস্ত ঘোড়ায় চড়া মূর্তি। আবার ঘোড়া।
পরদিন রাতে ঘোরাঘুরি সেরে ঢুকি ঘোড়ার খোঁজে।
এদেশের মানুষ বেশ লম্বাচওড়া। লাল রঙের। একসময় রাশিয়ায় ছিল। এখন আপাদমস্তক ইউরোপীয় কালো কালো পোশাক। আমার রাশিয়ান বইয়ে দেখা ছবির নেশা চটকে যায়। তবে আতিথেয়তায় জুড়ি নেই, আর খেতেও পারে তেমনি।
এইসব রাশিয়া ঘেঁষা দেশে খাবারে স্টার্টার, মানে শুরুর দিকের গা (বা হাত বা পেট) গরম করার খাবারদাবার আসে প্রচুর। ফলে মূল খাবার আসতে আসতে খিদে আর তেমন বেঁচে থাকে না। মাছ ভাজা, মুরগি ভাজা, কলা, আঙুর, লেবু, নানারকম রুটি – সময় কাটাতেই যেটুকু হাত চালাতে হয়, তাতে হাতেও ব্যথা। পেটও ভরে যায়। প্রথমে আসে চা, নানারকম রুটি—বুরসুক, কাটামা। ময়দার তৈরি ভাজা রুটি, লাপেস্কি—গোল রুটি। আসে বসক, ছোট্ট ছোট্ট পাউরুটি। চুচুক, ঘোড়ার চর্বির সসেজ। ভাপা, সেদ্ধ, ভাজা—মাংস, মাংস আর মাংস। মশলা ছাড়া, নিরীহ। কাবাব। এক প্লেট গরুর কাবাব চেয়ে একদিন আমার সে কী অবস্থা। ‘এই তো তুমি খাও, আমরা আছি’ বলে সকলে গল্প করতে থাকে বিজাতীয় ভাষায় আর আমি কাবাব, থুড়ি হিমশিম খাই।
রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পরে এদেশের বহিরাঙ্গে একটা মস্ত পরিবর্তন হয়েছে। জানা গেল, আগে স্থানীয় পোশাক পরা লোকজন দেখা যেত রাস্তায়। আমি একজনও দেখিনি। উলটে কমবয়সীরা সবাই কালো বা সাদা পোশাকে, অথবা ছাই ছাই, ইউরোপের নকল। খাবারেও তার প্রভাব। রেস্তোরাঁয় ইউরোপের ফাস্ট ফুড। স্থানীয় খাবারের রেস্তোরাঁ, তাই বেশ দামি। আমাদের খাবার পরিবেশন করেই রেস্তোরাঁর পরিচারকরা নিজেরাই দশ মিনিট নাচগান করে দেখালেন। আমাকে ভারতীয় জেনে অনিল কাপুর আর শ্রীদেবীর ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ সিনেমার প্রশংসা করে গেলেন।
দেশি খাবার বলে শুরুতে দিয়ে যায় এক ভাতের স্যুপ। ভাত, গোটা মুগ ডাল আর সামান্য মাংস কুচি দেওয়া স্বাদহীন এক বাটি ঝোল। এরপর আসে বহু অপেক্ষার ঘোড়া। বেসবার্মাক। বহুক্ষণ ধরে মাংসের নিজের তেলেই সেদ্ধ ও রান্না করা ঘোড়া। কুচি কুচি মাংস, সামান্য বোটকা গন্ধ। উপর দিয়ে নুডলস, পার্শলে আর ধনেপাতা ছড়ানো। মশলা কম, ফলে সবসময়ই মাংসের আসল গন্ধ ও স্বাদ পাওয়া যায়। বেসবার্মাক মানে পাঁচ আঙুল। এই খাবার হাত দিয়ে খেতে হয় বলে এর নাম এইরকম। ঘোড়ার মাংস দিব্যি গরুর মতো খেতে। তবে সাধারণত ছোটো ছোটো টুকরো করেই খেতে দেখছি, অথবা হ্যাম-এর মতো পাতলা পাতলা পিস। চর্বি বেশ কম। সাংঘাতিক উৎসাহ পেয়েছি একথা বুক ঠুকে বলতে পারি না।
সাদা সাদা চীজ-এর মতো কী একটা নামিয়ে দিয়ে গেল, বেশ রাস্টিক চেহারা। কামড় দিলাম, ভাঙল না। উলটে দাঁত খুলে আসার জোগাড়। যেটুকু জিভে গেল, বাপ রে কী নুন! ওটা নাকি নুন দেওয়া দই জমিয়ে রাখা। দই ঘোড়ার দুধের মনে হয়। বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমি আবার ঘোড়ায় উঠি, থুড়ি ঘোড়ার মাংস খাই।
মাংস আর দুগ্ধজাত খাবার, এই এদেশের মূল খাবার। এমনকি পাউরুটিতে দই লাগিয়েও খেতে হয়েছে। মাংস রান্নার পদ্ধতিও বেশ সহজ। মারো, মুণ্ডু-চামড়া আর নাড়িভুঁড়ি বাদ দাও আর গরম জলে টগবগ করে ফোটাও। চর্বি আর রক্ত যা ভেসে উঠছে উপরে, মগে করে তুলে তুলে ফেলে দাও। সেদ্ধ হলে টেবিলে রেখে হামলে পড়ো। এত সহজ রান্না, তাই এদের ঘোড়ার মাংসে ঘোড়া ঘোড়া গন্ধ, ছাগলের মাংসে ছাগলের, ভেড়ার মাংসে ভেড়ার। উট খাইনি ওদেশে, তাই উটের খবর জানি না। ইয়াকের দুধও চলে, আর কুরুট নামের শক্ত চীজ, আমাদের পাহাড়ি দেশে যা কিনা ছুরপি।
এখানে নানারকম বাদাম আর শুকনো ফলের মস্ত বাজার। দেখলে মনে হয় হোলির আগে বড়বাজারে এসে পড়েছি। কিছুটা এদের দেশের, কিছুটা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা। কিন্তু সবমিলিয়ে রংবাহারি। গুলজাদা, আমার সহকর্মী দিয়েছিলেন এক প্যাকেট ঘরে শুকানো আপেল। শুকনো খটখটে, কিন্তু চিবোলেই মুখ মিষ্টি রসে ভরে যায়। মুখ চালানোর ইচ্ছে হলেই আমি এক কুচি আপেল মুখে ফেলে কিরঘিজস্তানের চমৎকার মানুষজন আর রাশি রাশি খাবারের কথা ভাবতে থাকি।
ছবিঃ লেখক