আগের পর্বঃ ব্যাঙ ও লাওস, নেপালি বাদুর, ইথিওপিয়ার সিংহ
পাহাড়িয়া খাবার দাবার
অংশুমান দাশ
পাহাড়িয়াদের সংগে সাঁওতালদের ভীষণ ঝগড়া। দু’দলই ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা, কিন্তু সাঁওতালরা ঘটনাচক্রে ইংরেজদের কাছাকাছি এসেছিল, তাদের থেকে উপকৃতও হয়েছিল আবার লড়াইও করেছিল তাদের বিরুদ্ধে। সেই অর্থে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষায় তারা কিঞ্চিৎ অগ্রসর। দুই দলে ঝগড়া জমি জায়গা জঙ্গলের দখলদারি নিয়ে। পাহাড়িয়ারা এই লড়াইয়ে হেরে যায় – তাদের ভাগে পড়ে পাহাড়, আর সমতল দখল নেয় সাঁওতালরা। সমতলে জল বেশি, তারা শিখে ফেলে চাষবাস, পশুপালন, বাড়িঘর তৈরির আদব কায়দা। আর পাহাড়িয়ারা, শাপে বর, জঙ্গলের খাবার খেয়ে, নদীর মাছ ধরে দিব্যি বেঁচে থাকে। এই দিব্যি থাকাটা কিন্তু বেশিদিন টেকে না। সরকারের ইচ্ছা সবাইকে ‘সভ্য’ করবেন – তাই পাহাড়িয়াদের কাছে পৌঁছে যায় রেশনের চাল, পৌঁছে যায় জামাকাপড়, সাবান, সুগন্ধ তেল। ব্যাস, কুড়িয়ে, শিকার করে আর কে খায় ? পাহাড়িয়াদের খাবারের অভ্যাস যায় বদলে – ফলে জঙ্গল রক্ষা করার তাগিদ থাকেনা আর। এদিকে পয়সার চাহিদা বেড়ে যায়। কেউ কেউ জঙ্গলের গাছ কেটে বেচে দেন, কেউ শুরু করেন বরবটি চাষ – আর সেই বরবটি নিয়ে যায় মহাজনরা – বিনিময়ে ওই তেল সাবান সাদা নুন, যত শহুরে আভ্যেস। মুশকিলের কথা শহুরে অভ্যাস এলেও ইস্কুল ডাক্তার হাসপাতাল কিন্তু আসেনি। এখনও পাহাড়িয়ারা পাহাড়ের মাথায়। সপ্তাহে একদিন বাজার যান, তাদের গ্রামে কেউ আসেন না, তারাও কাউকে গ্রামে আসতে দেখলে ঘরে দরজা দেন, অবশ্য যদি দরজা থাকে। চার ভাগের তিন ভাগ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। ভারতবর্ষে আর মাত্র কুড়ি হাজার পাহাড়িয়া মানুষ বেঁচে আছেন।
আমার তো পাহাড়ে উঠেও একই কাজ – ধান ভানা, থুড়ি চাষবাস খাবারদাবারের খানাতল্লাশ। কিছুদিন রাজমহল পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে পাহাড়িয়াদের জ্ঞানভাণ্ডার লিখে ফেলার চেষ্টা করেছি। প্রায় ১২৪ রকমের জঙ্গুলে খাবার তারা খেত – গাছ পাতা মধু পাখি ফল মাশরুম পিঁপড়ের ডিম – কী নেই সেই তালিকায়! কেবল দুঃখের বিষয়, যেহেতু তারা আর এই সব খাবারদাবারে অভ্যস্ত নেই, তাই এদের মধ্যে একের তিন ভাগ বিলুপ্তির পথে। সেই সব গাছপালা লাগানর চেষ্টা করা হয়েছে আবার। তা সেই পাহাড়িয়ারা ডাকলেন একদিন। নেমন্তন্ন। আমারও মাথায় ভূত চাপল, বললাম তোমাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে জঙ্গলে খাবার সংগ্রহ করব। তারপর সেই রেঁধে তোমরা আমায় খাওয়াবে। সেই শুনে পাহাড়িন সুন্দরীরা তো হেসেই খুন।
নির্দিষ্ট দিনে পাহাড় টপকে হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হলাম গ্রামে। ঝুড়ি নিয়ে হাজির দু’জন। তাদের সঙ্গে আমি যাব, আরা বাকি ক’জন জাঁতায় পিষে বানিয়ে রাখবে ভুট্টার আটা। আমি চল্লুম ডালপালা সরিয়ে, আকাশে ঝুলন্ত বিকট মাকড়শা, গাছের ডালে পিঁপড়ের বাসা আর মাটিতে বিচিত্র কেন্নো এড়িয়ে। প্রথম স্টপ পাহাড়ি আলু। ঝপাঝপ কাস্তে চলল, চলল খুরপি। বেরিয়ে এল এক হাত লম্বা আলু।
“বুঝলে কী করে এখানে আলু আছে?” আমার অর্বাচীন প্রশ্ন।
জমি পাহাড়িন তার অজস্র কুঞ্চিত মুখ কুঁচকে তাকায় আমার দিকে, “গাছটা দেখছিস না?”
“কিন্তু এরকম গাছ তো অনেক, আলু হয়েছে কি হয়নি বুঝলে কী করে?”
“পাতার রং দেখে, আর আমরা ঠিক জানি কোথায় কী পাওয়া যায়, কখন পাওয়া যায় – এই যে পাঁচটা পাহাড় দেখছিস, এর কোথায় কী পাওয়া যায় সব আমি জানি।”
পাঁচটা পাহাড়! আমার মুখ ঝুলে আসে, পাঁচটা বাসস্টপ পেরোতেই তো আমাদের গুগল ম্যাপ দেখতে হয়!
ঝপাঝপ আরও তিন চার রকম আলু-কচু বেরিয়ে আসে। পাহাড়ি আতা। হুশহুশ করে সাপ তাড়িয়ে তুলে আনা হয় লতানে পাহাড়ি কাঁকরোল। পটাপট জংলি বড় বড় পাতা।
“পাতায় কী হবে?”
“কিছুই জানিস না দেখছি,” সোমরিয়া বলে।
একদম ঠিক কথা। সঙ্গে এসেছে দু’টো তাগড়া কুকুর, আমাকে বকে ভুক ভুক। আমি মনে মনে বলি – ভুখ তো বটেই, ভুখের জন্যি এতকিছু। তবে এই যে কখন কোথায় কী তুলব, কাকে বাঁচিয়ে রাখব ভবিষ্যতের জন্য আর কার ফসল তুলব এখন – এ বিদ্যার কিছুই জানি না আমি। আমি তো ছার, বিজ্ঞানীরাও তল পাবেন না সোমরিয়া পাহাড়িনের জ্ঞানভাণ্ডারের।
শাক উঠল। পাহাড়ি পটল। আরও সব কী কী । এরপর নামতে থাকলাম পাহাড় থেকে। জমি পাহাড়িন হুই নিচের দিকে হাত দেখিয়ে বলল, “এবার ওই ঝরনায় যাব। কাঁকড়া ধরতে।”
এতটা নামা ওঠায় পেটের খিদে, যাকে সারমেয় ভাষায় বলে ভুক, আর পায়ের ব্যাথা – দুই-ই বেশ জানান দিচ্ছে। আমি ব্যাজার মুখে হাঁচোরপাঁচোর করে নামতে থাকলাম। আমার থেকে বিশ বছরের বড় দুই মহিলা নামছেন তরতর করে। তার আগে দুই কুকুর। নামছি, কিন্তু ভাবছি এই পথে আবার উঠে আসতে হবে – পুরো স্বর্গারোহণ পর্ব। যাই হোক, ঝরনায় পাথর তুলে তুলে পাথরের তলা থেকে কাঁকড়া শিকার হল – ছোট ছোট লাল কাঁকড়া। কী করে যে ধরলেন ওই অসম্ভব দ্রুতগামী জীবদের – পাহাড় দেবতাই জানেন। এবার ফিরতে হবে। সেই হাঁসফাঁস যাত্রার বিবরণ দিয়ে নিজের অপমানের বোঝা আর বাড়াব না।
ফিরে এসে দেখি টগবগ করে জল ফুটছে হাঁড়িতে। আলু ধুয়েটুয়ে ঢুকে গেল ওই হাঁড়িতে, শাকসবজি ধুয়ে কাস্তে দিয়ে কুচি কুচি করে কাটা হল, ভাজা হল মহুয়ার তেলে। সেই গাছের পাতায় মুড়ে নুন লঙ্কা রসুন সহযোগে কাঁকড়া চলে গেল আগুনে। আর ভুট্টার আটা সেদ্ধ করে মাখা হল এক তাল। এইসব হল গান গাইতে গাইতে।
আমার হাতে পাতার ঠোঙায় এল পচাই – ভুট্টার তৈরি পাহাড়ি দেশি পানীয় (এইরকম বললে বেশ কেতাদুরস্ত শোনায় – তবে কিনা আসলে তা দেশি মদ – এবং অত্যন্ত বিটকেল খেতে – আমি একচুমুক করে খাই আর হু হু করে তালে তালে ঘাড় নাড়ি – আহা, যেন কত উপভোগ করছি – এইরকম একটা ভাব)।
খাবার এল পাতার থালায় পাতার বাটিতে। ঝাল, কিন্তু নুন মশলা একটু কমের দিকেই বটে। আমার শহুরে জিভ সাদাসিধা সরল খাবার পেয়ে অবাক। কিন্তু ওই যে সারমেয় ডেকে উঠল – ভুক ভুক। আমি মনে করলুম – ভুখ তো বটেই। এর জন্যই সবাই দৌড়ে চলেছে, এ এক যন্ত্রণা বটে।
ছবিঃ লেখক